পশ্চিম মুখে আমার যাত্রা-পর্ব ২
2023-09-13 10:55:58

গত সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আমরা রিতু জেলায় শিলাচিত্র শুটিং করতে নো ম্যান’স ল্যান্ডে প্রবেশ করার কথা জানিয়েছিলাম। তারপর কী ঘটলো? আজকের অনুষ্ঠানে শোনাবো আমাদের সে যাত্রা বাকি গল্প।

ফোনে নেটওয়ার্ক সংকেত না থাকায় আমরা কোনও লাইভ অনুষ্ঠান করতে পারিনি। আমি স্বর্ণা আপুর সঙ্গে আলোচনা করে ভিডিও বানানোর সিদ্ধান্ত নিই। এ শিলাচিত্রগুলোর অবস্থান পাহাড় বা ক্লিফে। সেখানে পৌঁছতে আমাকে পাহাড়ে আরোহণ করতে হয়। ক্লিফে দুটো পা রাখার জায়গা ছাড়া আর কোনও স্পেস নেই। আমি ক্লিফে দাঁড়িয়ে ভিডিও শুটিং করি। স্বর্ণা আপুও খুব ভাল উপস্থাপনা করেন। নিরাপদে আমরা সেদিনের কাজ সম্পন্ন করি। আমরা যখন রিতু জেলার হোটেলে ফেরার যাত্রা শুরু করি তখন রাত ৯টার মতো বাজে। অন্ধকার হবার আগে সীমান্তের নো ম্যান’স ল্যান্ড ছেড়ে আসতে হয়। আরও কয়েক ঘন্টা পর রাতে ১১টার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। আর ওই রাতে কোনও খাবার খাই না। রুমে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ি। তিব্বতে আসার পর আমি দিনে সর্বোচ্চ ৫-৬ ঘন্টার মতো ঘুমাতে পারি। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। আর এমন সময়সূচিও পরবর্তিতে আমাদের দৈনিক জীবনে পরিণত হয়। দু এক দিন পর একবার হোটেল পরিবর্তন করি। একটি জেলা থেকে অন্য একটি জেলায় গেলে কমপক্ষে দু ঘন্টার মতো সময় লাগে। সর্বোচ্চ ৭ ঘন্টার বেশি সময়ও লাগে। আমি ভালভাবে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারি না। রিতু জেলায় এক দিনের মতো থাকার পর পরের দিন আমরা জান্দা জেলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। জান্দা জেলায় আরও মজার দৃশ্য ও গল্প আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর পর আমরা রিতু জেলাকে বিদায় জানাই এবং জান্দা জেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। যাবার পথে ৫টি উঁচু পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে কোন কোনটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার মিটারেরও বেশি। আমি গাড়ির সামনের আসনে বসি। পাহাড়ের সড়ক থেকে দেখলে মনে হয় আমরা যেন রোলার কোস্টারে চড়েছি। অনেক তীক্ষ্ণ বাঁক সড়কে। আর যেন হাত বাড়ালে মেঘ স্পর্শ করা যায়। ৩৭০ কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে পৌঁছতে আমাদের ৭-৮ ঘন্টা লাগে। মাঝপথে দুপুরের খাবার খেতে অজানা এক গ্রামে একটু থামি আমরা। স্বর্ণা আপু সে সময় বেশ অসুস্থ বোধ করেন। তাই অল্প কিছু খাবার খাওয়ার পর কাছাকাছি একটি ক্লিনিকে যান। ওখানে আবার এক ঘন্টার মতো অক্সিজেন নেন। আমি তাকে দেখতে যাই এবং তার সঙ্গে থাকি। আমার তখন অক্সিজেন নেওয়ার দরকার হয় না। তবে বাকি পথ পাড়ি দিতে অক্সিজেন লাগতে পারে। ক্লিনিকে বিশেষ এক ধরনের ব্যাগ বিক্রি হয়। এটি বেলুন বালিশের মতো; ভেতরে অক্সিজেন ভরে রাখা যায় এবং এ অক্সিজেন শেষ হলে যে হোটেলে অক্সিজেন তৈরি মেশিন আছে সেখান থেকে আবার অক্সিজেন ভরে নেওয়া যায়। এটা অক্সিজেন ট্যাংকের চেয়ে সুবিধাজনক ও সস্তা। তাই আমি একটি অক্সিজেন বালিশ কিনে নিই। স্বর্ণা আপুর অবস্থা একটু ভাল হওয়ার পর আমরা আবার জান্দা জেলামুখী যাত্রা শুরু করি। ওই দিন বিকেলে আমরা জান্দা জেলায় পৌঁছাই এবং হোটেলে যাই। তিব্বতে আসার পর আমি একবারও গোসল করিনি। বলা হয়, মালভূমিতে আসার প্রথম কয়েকদিন গোসল না করাই ভাল। কারণ অক্সিজেন ঘাটতির মধ্যে ঠান্ডা লাগলে সমস্যা গুরুতর হতে পারে। জান্দা জেলা আসার পর আমি প্রথম বারের মতো গোসল করি, ভাগ্যক্রমে এতে কিছুই হয়নি আমার। ওই দিনটি প্রায় পথেই চলে যায়। পরের দিন আমরা গুজ রাজবংশের ধ্বংসাবশেষে গিয়ে ভিডিও ধারণ করবো।

জান্দা হলো তিব্বতের এনগারি অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক স্থান। এখানে রহস্যময় ও কিংবদন্তিতুল্য শাংশুং রাজবংশ ছিল। গুজ রাজবংশ তিব্বত সাম্রাজ্য বা বোদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই রাজবংশের রাজাই শাংশুং বংশধরদের পূর্বপুরুষ। গুজ রাজবংশ ছিল সেই সময়ে তিব্বতের সবচেয়ে সভ্য স্থানীয় সরকার। সে রাজ্যের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষের অবস্থান জান্দা জেলার জাবুরাং গ্রামে শতদ্রু নদীর তীরে। এর উচ্চতা ১৬০ তলাবিশিষ্ট আধুনিক আকাশচুম্বী ভবনের সমান। ধ্বংসাবশেষের ভিতরে রয়েছে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে উজ্জ্বল মাস্টারপিস — গুজ প্রাচীরচিত্র। তার পাশেই জান্দা জেলার থুওলিন থানার জাবুরাং গ্রাম। পর্যটকরা এখানে ভিড় করেন। এতে সেখানকার অধিবাসীদের ‘ব্যবসার সুযোগ’ তৈরি হয়েছে এবং একের পর এক পারিবারিক হোটেল চালু হচ্ছে। সারি সারি তিব্বতি-শৈলীর সুসজ্জিত পারিবারিক হোটেলগুলো পর্যটকদের প্রথম পছন্দ।

এই রহস্যময় ও মহান ভূমিতে রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আকর্ষণীয় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। এটি তিব্বতের এনগারি অঞ্চলের জান্দা জেলা। এখানে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। এখানকার ধর্মীয় বিশ্বাস ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি একে অপরের পরিপূরক।

জান্দা জেলার আশপাশ লম্বা মাটির বনে বেষ্টিত। কয়েক শ’ মিলিয়ন বছর আগে, এই মাটির বনগুলো সমুদ্রের নিচে ছিল এবং প্রকৃতিতে আকাশ-পাতাল পরিবর্তনের পর বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

জান্দা অঞ্চলের মধ্যেই গুজ রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এটি একটি প্রাচীন ও রহস্যময় রাজবংশ। সাত শ’ বছর শাসন করার পর তারা রাতারাতি ইতিহাস থেকে মুছে যায়।

ভিতরে প্রবেশ করার পর আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া সবচেয়ে উজ্জ্বল গুজ প্রাচীরচিত্রগুলো দেখে ভীষণ অবাক হই। মনে প্রশ্ন জাগে কীভাবে এক লাখ গুজ মানুষ হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল?

এটা কল্পনা করা কঠিন যে, রাজকীয় শহরটি যে একটি দুর্দান্ত সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা এনগারি অঞ্চলের জান্দা জেলার মাটির বন দিয়ে বেষ্টিত একটি পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছিল। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পর্যটকরা অনেক বিস্ময় আবিষ্কার করতে পারেন। গুজ রাজবংশের ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে এই প্রাচীন রাজবংশের গৌরব ও দুঃখ উপলব্ধি করা যায়। এই রহস্যময় রাজ্যের কিংবদন্তি, যা প্রতি বছর সারা বিশ্বের পর্যটকদের এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে টেনে নিয়ে আসে, জান্দাকে পরিণত করেছে এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে।

গুজ রাজবংশের পূর্বসূরি শাংশুং রাজ্যে ফিরে পাওয়া যাক। এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্ভবত নবম শতাব্দীর শুরুর দিকে। তিব্বত মালভূমিকে একীভূতকারী তিব্বত সাম্রাজ্য বা তুবো (বোদ) রাজবংশের পতনের পরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭ শতকের শেষ নাগাদ ১৬ জন রাজা এই রাজ্য শাসন করেন। এটি তুবোর পশ্চিমে এনগারি অঞ্চলে তুবো রাজপরিবারের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত একটি স্থানীয় শাসনব্যবস্থা। তুবো ধ্বংসের পর বৌদ্ধধর্মকে পুনরুদ্ধার করেছিল এই রাজবংশ। তাই তিব্বতের ইতিহাসে গুজ রাজবংশের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

স্বর্ণা আপু ওই দিন একটি ভিডিও শুটিংয়ের কাজে যান। আমার তেমন কোনও কাজ ছিল না তাই আমি একটি লাইভ অনুষ্ঠান করি এবং বাকি সময়টায় ইচ্ছা মতো এ মহান রাজবংশের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাই। আমাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় একজন ব্যক্তি। তার নাম ক্য সাং। কথা বলতে বলতে বুঝেছি উনি ইতিহাসের একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাছে যখন বাংলাদেশ থেকে চীনে আসা প্রখ্যাত সন্ন্যাসী অতীশ দীপঙ্করের প্রসঙ্গ তুলি, তিনি আমাকে বলেন, অতীশ দীপঙ্করের প্রভাব এখনও এনগারি অঞ্চলে রয়েছে এবং স্থানীয়রা অনেকে তার নাম শুনেছেন। আমাদের হোটেলের কাছে থুও লিন নামে একটি মন্দির আছে। থুও লিন মন্দিরে অতীশ দীপঙ্কর তিন বছর সময় কাটিয়েছিলেন। এ কথা শুনে আমি ও স্বর্ণা আপু সেটা দেখার ব্যাপারে অনেক আগ্রহী হই এবং তাঁকে জিজ্ঞাস করি, পরদিন তিনি আমাদেরকে নিয়ে ওই মন্দিরে একটু দেখতে যেতে পারবেন কি না? তিনি রাজি হন। আসলে পরদিন আমাদের অন্য একটি সময়সূচি ছিল। তবে আমরা এ মন্দির ও প্রখ্যাত সন্ন্যাসী অতীশ দীপঙ্করের গল্প আরও জানতে চাই। ঠিক করা হয়, আমরা পরদিন বিকেলে থুও লিন মন্দিরে যাব।

ওই দিন রাতে আমি ও স্বর্ণা আপু মাছের হটপট খেতে একটি রেস্টুরেন্ট যাই। রেস্টুরেন্টের মালিক ছুংছিং শহরের বাসিন্দা। উনি জানান, এনগারি অঞ্চলে এখন চলছে শাংশুং সাংস্কৃতিক উত্সব আর এই উৎসব উপলক্ষ্যে সবাই ১০ দিনের ছুটি ভোগ করছে। তাই অনেক মানুষ এনগারি অঞ্চলের রাজধানী অথবা যেখান থেকে আমরা এসেছি সেখানে গেছে। জান্দা জেলায় রেস্টুরেন্ট ছাড়া প্রায় সব দোকান বন্ধ ছুটির কারণে। মালভূমি এলাকায় আসার পর আমি একবার রাতের আকাশে তারা দেখতে চাই। স্থানীয় এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাস করি, এনগারিতে তারা দেখার উপযোগী জায়গা কোথায়। জানতে পারি, রাত ২টার পর তারা দেখা যেতে পারে। আমি একটু ভেবে সে পরিকল্পনা ত্যাগ করি। প্রতিদিন আমাদের কাজ থাকে। তাই মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকা অসম্ভব। আসলে এখানে আসার পর প্রতিদিনই আমার ঘুমের ঘাটতি থাকে। পরদিন পিয়াং ও ডংগা দুটি জায়গায় বৌদ্ধ গুহার ধ্বংসাবশেষে দেখার কথা ছিল। তবে আমি খুব ক্লান্ত বোধ করি। তাই ওখানে না গিয়ে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিই। এখানে পিয়াং ডংগা বৌদ্ধ গুহা সম্পর্কে কিছু তথ্য।

পিয়াং ডংগা চীনে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বৃহত্তম বৌদ্ধ গুহার ধ্বংসাবশেষ। এখানকার পাহাড়ে এক হাজারেরও বেশি গুহা রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, যার মোট আকার ১২ হাজার বর্গমিটার। এটা ‘দ্বিতীয় দুনহুয়াং’ নামেও পরিচিত। ডংগাপিয়াং গুহায় বহু সংখ্যক প্রাচীরচিত্র রয়েছে। এগুলোর পেইন্টিং শৈলীতে স্পষ্ট প্রতিবেশী কাশ্মীর ও ভারতের সমসাময়িক শিল্পফর্মের প্রভাব। মধ্য এশিয়ার শিল্পের ছোঁয়াও আছে এতে। আর স্থানীয় সংস্কৃতির মিশেল তো আছেই।

তিব্বতের ডংগাপিয়াংয়ে একটি রহস্যময় ও প্রাচীন স্থান রয়েছে, যা পাহাড়ের গভীরে লুকানো বৌদ্ধ গুহা। আজ আমরা সেই রহস্যময় সাংস্কৃতিক ভাণ্ডার দেখবো।

ডংগাপিয়াং বৌদ্ধ গুহা হলো প্রাচীন ভিক্ষুদের খনন করা গুহাগুলোর একটি জটিল অংশ। এখানে মহামতি বুদ্ধের মূর্তি ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রয়েছে।

গুহার প্রাচীরচিত্রগুলো চমত্কার ও রঙিন; বুদ্ধ মূর্তিগুলো গম্ভীর। এগুলো বৌদ্ধ সংস্কৃতির মূল্যবান সাক্ষী।

ডংগাপিয়াং বৌদ্ধ গুহার রহস্য অন্বেষণ করার জন্য অভিযাত্রীরা সাহসের সাথে এই রহস্যময় পর্বতশ্রেণীতে পা রেখেছিলেন, ধাপে ধাপে পাথরের দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গুহাগুলোর আবিষ্কার করেছিলেন।

গুহার গভীরে তাঁরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এই মূল্যবান আবিষ্কারগুলো ডংগাপিয়াং বৌদ্ধ গুহার দীর্ঘ ইতিহাসই তুলে ধরে।

এই মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় জনগণ সক্রিয়ভাবে গুহাগুলোর সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারকাজে অংশ নেয়। তারা এসব গুহায় যাওয়ার পথ সহজতর করে।

ডংগাপিয়াং বৌদ্ধ গুহাগুলোও অনেক তীর্থযাত্রীকে আকৃষ্ট করে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে। তাঁরা তাদের ভক্ত হৃদয় দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের সর্বজনীন মূল্য উপলব্ধি করেন। হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডে বৌদ্ধ সংস্কৃতি মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে।

আমি সেখানে যেতে পারিনি। তবে তার জন্য আমি দুঃখিত নই। জান্দা আসার পথে আমি দুই পাশের পাহাড়ে বহু গুহা দেখেছি। অন্যদিকে বিকেলে থুও লিন মন্দিরে ওই সাক্ষাতকার আরও মজার ছিল।

বিকেলে আমি ও স্বর্ণা আপু বিশেষজ্ঞ ক্য সাংয়ের সঙ্গে থুও লিন মন্দিরে যাই। আমরা ছাড়া কখনও কখনও পর্যটকরাও আসেন সেখানে। মন্দিরে একজন তরুণ সন্ন্যাসীর সাক্ষাত্কার নিই আমরা। তিনি অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে নানা গল্প শুনান আমাদেরকে, যিনি হাজার বছর আগে পাহাড় অতিক্রম করে তিব্বতে আসেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করতে এখানে ১০-১২ বছর কাটিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ সময় তিনি তিব্বতে কাটিয়েছিলেন। তার সম্পর্কে আমি পরে একটি ভিডিও বানাবো তাই এখানে আর বিস্তারিত বলছি না। ওই বিকেলে আমরা থুও লিন মন্দিরে সুন্দর ও অর্থবহ সময় কাটাই। সে স্মৃতি কখনও ভুলব না।

দুদিনের কাজ শেষ করে আমরা তৃতীয় জেলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। এবার আমাদের গন্তব্য পুলান জেলা। দূরত্ব ৩৩০ কিলোমিটার। সেখানে যেতে এক দিন সময় লাগে। চালক আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, পুলেন জেলার উচ্চতা একটু কম। তাই আমাদের অসুস্থতাও কম হবে। এনগারি অঞ্চলে আসার পর আমরা প্রায় প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় ঘুমিয়েছি। যদিও প্রথম কয়েক দিনের তুলনায় আমার অবস্থা এখন ভাল, তবে আমি বলতে পারছি না যে আমি এখানকার পরিবেশের সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পেরেছি। যাহোক আমরা আরও সামনে এগিয়ে যাই। পুলান সারা এনগারি অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জেলা। কারণ পবিত্র পাহাড় ও পবিত্র হ্রদ সব এখানে আছে। এর আগে আমি শুধু চলচ্চিত্রে পবিত্র পাহাড় গ্যাং রেনপোচে দেখেছি। এবার তার কাছে যাবার সুযোগ পাই। আমি খুবই উত্তেজিত বোধ করি। তবে আমার জন্য দুঃসংবাদও আছে। গ্যাং রেনপোচের নীচে উচ্চতা হবে ৪ হাজার ৭০০ মিটারের মতো। তার মানে গাড়িচালক যেটি বলেছেন, তা আসলে ঠিক নয়। বরং আমাদের হোটেল ছাড়া, বাকি জায়গার উচ্চতা আগের তুলনায় বেশি হবে। তবে কোনও উপায় নেই। তিব্বতে আসার পর আমি একটি জিনিস শিখেছি - সমস্যা এলে সেটা সমাধান করতে হবে; তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়। সময়সূচি অনুযায়ী আমরা খ্য চিয়া নামে একটি মন্দিরে পুলান পোশাক নিয়ে একটি ভিডিও শুটিং করবো। আর দ্বিতীয় দিন ইয়াক পরিবহন দলের শুটিং করবো। তবে পুলান আসার পর জানতে পারি প্রথমেই ইয়াক পরিবহন দলের শুটিং করতে হবে। না হলে তারা পাহাড়ে চলে যাবে। তাই আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করে শুরুতে ইয়াক পরিবহন দলের শুটিং করি। তার মানে পরিকল্পনার চেয়ে আগে গ্যাং রেনপোচে দেখতে পাবো।


প্রিয় বন্ধুরা, তিব্বতে আমাদের যাত্রা চলতে থাকে। পরবর্তী অনুষ্ঠানে সে সম্পর্কে জানাবো আপনাদেরকে। যেমন আমি পুলান পোশাক পরেছিলাম। এটি নানা মূলবান পাথর দিয়ে সাজানো হয়। আপনি কি অনুমান করতে পারেন এমন একটি পোশাকের দাম কত? হ্যা ৫-১০ লাখ ইউয়ান অর্থাত ৭০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকার মতো। আর ইয়াক পরিবহন দল কী? তারা মূলত কী কাজ করে? পরবর্তী অনুষ্ঠানে সে সম্পর্কে জানতে পারবেন আপনাারা। আমার সঙ্গে থাকবেন আশা করি। (শিশির/রহমান/রুবি)