দেহঘড়ি পর্ব-০৩৫
2023-09-10 19:45:18

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে টিসিএম

ডায়াবেটিস একটি ব্যাপক বিস্তৃত রোগ। বিশ্বে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ মারা যায় এ রোগে। অগ্ন্যাশয় যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন উত্পাদন করতে পারে না কিংবা শরীরের কোষগুলো যখন হরমোনের প্রভাবের প্রতি ঠিকমতো সাড়া দিতে পারে না, তখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস হয়। এ রোগের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত তৃষ্ণা, অতিরিক্ত প্রস্রাবের বেগ, ওজন কমে যাওয়া এবং দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া। চিকিত্সা না করা হলে, ডায়াবেটিস কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম, চোখ, কিডনি ও স্নায়ুর ব্যাধিসহ বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএম সুদীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে ডায়াবেটিস ও এর জটিলতা নিয়ন্ত্রণে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকে চীনে সিয়াও-খ্য নামে যে রোগ পাওয়া যায়, সেটি আসলে এখনকার ডায়াবেটিস। সিয়াও-খ্য হলে তৃষ্ণা ও ক্ষুধা বেড়ে যেত, প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব হতো এবং ওজন কমে যেত। তখন বিশ্বাস করা হতো অত্যধিক চর্বিযুক্ত, মিষ্টি বা রিচ ফুড খাওয়ার ফলে এ রোগ হয়।

বর্তমানে টিসিএম চিকিৎসকরা মনে করেন, ডায়াবেটিসের যে প্রধান ৪টি কারণ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যেটি দেহের ঠান্ডা শক্তি বা ‘ইয়িন’র ক্ষয়ের জন্য দায়ী করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থায় রক্তের শর্করার মাত্রার ওপর সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া হয় এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রধান লক্ষ্য। তবে টিসিএমে আলাদা আলাদা রোগীর মধ্যে দেখা দেওয়া আলাদা আলাদা উপসর্গগুলো উপশমের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই উপসর্গগুলোকে তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় - ঊর্ধাঙ্গ, মধ্যাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গের অপচয়।

ঊর্ধাঙ্গের অপচয়ের ক্ষেত্রে অত্যধিক তৃষ্ণা দেখা দেয়। এর অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে থাকে মুখের শুষ্কতা, খিটখিটে মেজাজ, পাতলা হলুদ আবরণসহ জিহ্বা লাল হয়ে যাওয়া এবং হৃদস্পন্দন বাড়া। এ ধরনের ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় কপটিস চাইনিসিস, ওফিওপোগন জাপোনিকাস এবং র‌্যাডিক্স রেহমাননিয়া দিয়ে তৈরি ক্বাথ ব্যবহার করা হয়।

মধ্যাঞ্চলের অপচয়ের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ হলো অত্যধিক ক্ষুধামন্দা। এছাড়া নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ, ওজন হ্রাস, ঘন ঘন মুখে ঘা, অত্যধিক তৃষ্ণা, বারে বারে প্রস্রাব হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, হলুদ আবরণযুক্ত লাল জিহ্বা এবং দ্রুত হৃদস্পন্দন। এ ধরনের ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় সাধারণত জিপসাম ফাইব্রোসাম, রাইজোমা অ্যানিমারহেনা এবং গার্ডেনিয়া জেসমিনয়েডস দিয়ে তৈরি ক্বাথ ব্যবহার করা হয়।

নিম্নাঞ্চলের অপচয়ের ক্ষেত্রে প্রস্রাব ঘোলাটে হয়ে যায়। এর অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে থাকে নিম্ন কটিদেশে ব্যথা, হাঁটুর দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, কানে শোঁ শোঁ শব্দ, শুষ্ক ঠোঁট, চুলকানি, কোনও আবরণহীন লাল জিহ্বা এবং দ্রুত হৃদস্পন্দন। কিডনিতে ইয়িনের ঘাটতির কারণে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এ ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাধারণত, স্কিজ্যান্ড্রা, চাইনিজ ইয়াম, উলফবেরি বা গোজি বেরি দিয়ে তৈরি সিক্স-ফ্লেভার রেহমাননিয়া ব্যবহৃত হয়।

চীনের জ্যেষ্ঠ টিসিএম চিকিত্সক ইউ ইয়ান থাং ইউয়ে বলনে, বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে ডায়াবেটিসের টিসিএম চিকিত্সার প্রধান লক্ষ্য হলো প্লীহাকে শক্তিশালী করা এবং কিডনিকে পুনরুজ্জীবিত করা।

গত কয়েক দশকে পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল ডায়াবেটিসের চিকিত্সায় পশ্চিমা ওষুধের পরিপূরক হিসাবে টিসিএমের ব্যবহারকে সমর্থন করেছে। পরিপূরক হিসাবে এর ব্যবহার চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রোগের ঝুঁকি কমায়।

২০১৩ সালে ৮শ’ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষায় এক দল রোগীকে ডায়াবেটিসের পশ্চিমা ওষুধ গ্লিবেনক্লামাইড দেওয়া হয় আর অন্য দল রোগীকে গ্লিবেনক্লামাইডের সঙ্গে চীনা ভেষজের একটি যৌগ – সিয়াও খ্য ট্যাবলেট – দেওয়া হয়। ৪৮ সপ্তাহ পর দেখা যায়, সিয়াও খ্য ট্যাবলেট গ্রহণকারীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান থিয়ানচিন প্রথম কেন্দ্রীয় হাসপাতাল

থিয়ানচিন প্রথম কেন্দ্রীয় হাসপাতাল চীনের উত্তরাঞ্চলীয় থিয়ানচিন নগরীতে অবস্থিত একটি আধুনিক তৃতীয় স্তরের জেনারেল হাসপাতাল। চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে উত্তর চীনের একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠান এটি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন, জরুরি চিকিৎসা এবং মাথা ও ঘাড়ের সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষ নাম রয়েছে এ হাসপাতালটির।

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত থিয়ানচিন প্রথম কেন্দ্রীয় হাসপাতালে বর্তমানে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ কাজ করছেন, যাদের মধ্যে ৬ শতাধিক জ্যেষ্ঠ পেশাদার ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ২৮০ জনেরও বেশি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, ৮৫০ জনেরও বেশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং অন্তত ৩০ জন জাতীয় পর্যায়ের খেতাবজয়ী।

৩ হাজার ২শ’ শয্যার এ হাসপাতালটি দুটি ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত। শুইসি ক্যাম্পাসে শয্যা সংখ্যা ২ হাজার এবং পুনর্বাসন ক্যাম্পাসে ১ হাজার ২শ’। এখানে রয়েছে প্রায় ৫০টি ক্লিনিকাল মেডিকেল টেকনোলজি বিভাগ এবং ৮টি মিউনিসিপ্যাল মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। নানখাই বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত থিয়ানচিন প্রথম কেন্দ্রীয় হাসপাতাল থিয়ানচিন মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ক্লিনিকাল কলেজ এবং থিয়ানচিন টিসিএম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষণ হাসপাতাল। এটি আবাসিক চিকিৎসকদের জন্য একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও।

হাসপাতালটি সক্রিয়ভাবে চীনের স্বাস্থ্যকর্ম-সম্পর্কিত নির্দেশিকা এবং ‘নতুন যুগে স্বাস্থ্যকর চীন’ কৌশল প্রয়োগ করে, মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে গ্রহণ করার উপর জোর দেয় এবং জীবন বাঁচানো, আহতদের সুস্থ করা, রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্সা এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করে।

 

#ভেষজের গুণ

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে পিপুল

পিপুল এক ধরনের মরিচ। এক প্রকার লতায় এ মরিচ জন্মায়। সাধারণত শুকিয়ে মশলা হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়। এর ইংরেজি নাম লং পিপার এবং বৈজ্ঞানিক নাম পিপার লংগাম। এ মরিচের মধ্যে মার্কিন বিজ্ঞানীরা পিপারলংগুমাইন নামের এক ধরনের ক্যান্সার-প্রতিরোধী রাসায়নিক আবিষ্কার করেছেন।

গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, পিপারলংগুমাইন প্রোস্টেট, স্তন, ফুসফুস, কোলন, লিম্ফোমা, লিউকেমিয়া, প্রাথমিক মস্তিষ্কের টিউমার এবং গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারসহ অনেক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে গবেষকরা এমন আণবিক কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হন, যার মাধ্যমে দেখা যায় খাওয়ার পর কীভাবে এ রাসায়নিক এইচপিএল-এ রূপান্তরিত হয়। এইচপিএল একটি সক্রিয় ওষুধ যা টিউমারের জন্য দায়ী জিএসটিপি-১ নামক একটি জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

ক্যান্সারের পাশাপাশি ক্ষুধা ও হজমশক্তি বৃদ্ধিতে এবং পেটব্যথা, বুক ব্যথা, বদহজম, গ্যাষ্ট্রিক, ডায়েরিয়া ও কলেরা নিরাময়ে ভাল কাজ করে পিপুল। এছাড়া হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও কাশিসহ ফুসফুসের সমস্যা দূর করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। অন্য যেসব রোগ ও শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে পিপুল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো মাথাব্যথা, দাঁতের ব্যথা, বেরিবেরি, কোমা, মৃগীরোগ, জ্বর, স্ট্রোক, অনিদ্রা, কুষ্ঠ, চরম ক্লান্তি, প্লীহা বৃদ্ধি, পেশী ব্যথা, নাক দিয়ে রক্তপাত, পক্ষাঘাত, সোরিয়াসিস, কৃমি, সাপের কামড়, টিটেনাস, তৃষ্ণা ও যক্ষ্মা।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।