সিছুয়ান-তিব্বত সড়কের কারণে এখন সিছুয়ান থেকে তিব্বতে যাতায়াত করা অনেক সুবিধাজনক হয়েছে। এই সড়কটি নির্মাণের প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো সুড়ঙ্গ ও সেতু নির্মাণ করতে হয়েছে। নির্মাণকর্মীদের বিপুল পরিশ্রমের ফল হিসেবে বর্তমানে অনেক পর্যটক গাড়ি চালিয়ে সিছুয়ান থেকে তিব্বতে যেতে পারছেন।
চীনে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। প্রবাদটি হচ্ছে: 'সমৃদ্ধ হতে চাইলে প্রথমে সড়ক নির্মাণ করতে হবে'। সিছুয়ান-তিব্বত মহাসড়ক স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নত করা, দারিদ্র্যমুক্তি, শিল্পের উন্নয়ন, উচ্চমানের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সমাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
আজকের অনুষ্ঠানে আমি পরিবহন খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চারটি গল্প আপনাদের শোনাবো।
প্রথম গল্প সিছুয়ানের গানজি তিব্বতী জাতির স্বায়ত্বশাসিত বান্নারের লুদিং জেলার থুয়ানচিয়ে গ্রামের মাশরুম গ্রিনহাইস নিয়ে। ৩১৮ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত থুয়ানচিয়ে গ্রাম এরলাং সুড়ঙ্গের সিদংখৌ'র দৃশ্য খুবই সুন্দর। কিন্তু আগে থুয়ানচিয়ে গ্রাম খুবই দরিদ্র ছিল। পরিবহনব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। আগে স্থানীয় বাসিন্দারা ভূট্টা চাষ করতেন। তাঁদের আয় খুবই কম ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্রামে গ্রিনহাউসে মাশরুম ও মরিচ চাষ হচ্ছে। এতে গ্রামবাসীদের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। থুয়ানচিয়ে গ্রামের চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র সম্পাদক চৌ চু স্যিয়াং এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাসিন্দাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ২০১২ সালের ২ হাজার ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে সাড়ে ১২ হাজার ইউয়ান হয়। বর্তমানে আমাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় ১৫ হাজার ইউয়ান।’
থুয়ানচিয়ে গ্রামে 'নতুন গ্রাম নির্মাণ পরিকল্পনা' বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গ্রামটি 'জাতীয় সভ্যতা গ্রাম ও থানা', 'মরিচ উত্পাদন গ্রাম' ও 'বছরে মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ইউয়ান গ্রাম'-এর মর্যাদা লাভ করেছে। গ্রিনহাউসে মাশরুম চাষ করার মাধ্যমে গ্রামবাসীরা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন। কিন্তু থুয়ানচিয়ে গ্রামের সমৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। তাঁরা বর্তমানে গ্রিনহাউসে চীনা ঔষধি গাছ চাষের চেষ্টা করছেন।
দ্বিতীয় গল্পটি চীনের ইয়াচিয়াংসং শিল্পক্ষেত্রের। শিল্পক্ষেত্রটি গানজি বান্নারের ইয়াচিয়াং জেলার বাজিয়াওলৌ থানার রিজি গ্রামে ও ৩১৮ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত। ইয়াজিয়াং জেলায় উত্পাদিত মাশরুমের পরিমাণ বেশি ও মান উচ্চ এবং চীনে খুবই জনপ্রিয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে চীনা মাশরুম সমিতি জেলাটিকে 'চীনা সংরং মাশরুম জেলা'-র মর্যাদা প্রদান করে। কিন্তু সংরং মাশরুম চাষ করা কঠিন। এজন্য ইয়াজিয়াং জেলা সংরং শিল্পক্ষেত্র নির্মাণ করেছে, যাতে খাবার-মাশরুমের শিল্পচেইন গড়ে তোলা যায়। জেলাটির কৃষি ও পশুপালন এবং গ্রাম ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি ব্যুরোর পরিচালক লিউ তি ওয়া এ সম্পর্কে বলেন, ‘জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাকৃতিক সংরং মাশরুম চাষের সময়। কোনো কোনো বছরে অক্টোবর পর্যন্ত চাষ হয়। সেজন্য আমরা প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকি। আমরা সমগ্র শিল্পচেইন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। গ্রিনহাউস প্রযুক্তিতে সারা বছরজুড়ে মাশরুম চাষ করা যায়।’ এখন সংরং ছাড়াও মাশরুমক্ষেত্রে অন্য কয়েক ধরনের মাশরুম চাষ করা যায়।
সমুদ্রতল থেকে ৩ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত বাথাং জেলার সংদুও থানার সংদুও গ্রামের গ্রিনহাউস সবজিক্ষেত্র হল আজকের অনুষ্ঠানের তৃতীয় গল্পের বিষয়। বাথাং জেলায় প্রচুর ফসল জন্মে। এখানে আপেল, আখরোট, ও সংরং মাশরুম চাষ করা যায়। কিন্তু স্থানীয় সবজির বৈচিত্র্য তেমন নাই। সেজন্য জেলাটিতে সবজির ঘাটতি ছিল। মালভূমি প্রাকৃতিক কৃষি উন্নয়ন কোম্পানির ব্যবস্থাপক মেং ফান ছিয়াং বলেন, বাথাংর কৃষিবাজারের অনেক সবজি ছেংতু ও ইউননান থেকে আসতো। পরিবহনের খরচ বেশি, সেজন্য দাম বেশি ছিল।
এ সমস্যা সমাধান করার জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে মালভূমি প্রাকৃতিক কৃষি উন্নয়ন কোম্পানি বাথাং জেলায় বিনিয়োগ শুরু করে। এ পর্যন্ত ৪০টি শীতকালীন গ্রিনহাউস, ১০টি শরত্কালীন ও বসন্তকালীন গ্রিনহাউস এবং একটি বুদ্ধিমান গ্রিনহাউস নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে সবজি চাষ হচ্ছে প্রচুর। কোম্পানির ব্যবস্থাপক মেং ফান ছিয়াং এ সম্পর্কে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের গ্রিনহাউসে টমেটো, কুমড়া, লম্বা বেগুন, গোল বেগুন, মরিচ ও সেলারিসহ ১২ থেকে ১৩ ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে।’ গ্রিনহাউস নির্মিত হওয়ার পর মালভূমিতে স্থানীয় নাগরিকদের খাবার সমৃদ্ধ হয়েছে। সবজির দাম অনেক কমেছে।
লিথাং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আমাদের চতুর্থ গল্প লিথাংকে নিয়ে। চীনে লিথাং জেলা 'আকাশনগর' বলে পরিচিত। এখানে বায়ু পরিস্কার এবং মাটি ও পানিতে কোনো দূষণ নেই। জেলাটি এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের নতুন কাঠামো গড়ে তুলেছে। বাথাং জেলার জিয়াওয়ায় গ্রিনহাউসে তরমুজ, ছোট টমেটো, কুমড়া ও সবুজ মরিচসহ ২০ ধরনের সবজি চাষ করা হয়। আগে মালভূমিতে মাত্র বাঁধাকপি, মূলা ও আলু চাষ করা হতো। ২০১৮ সালে গ্রিনহাউসে বিভিন্ন সবজি চাষ পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়। প্রতিবছর উত্পাদিত সবজির পরিমাণ ৬ লাখ কিলোগ্রাম এবং মূল্য ৬৫ লাখ ইউয়ান। লিথাং 'মেরু ফল ও সবজি' ব্র্যান্ড এখন চীনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের শহুরে বাজারে প্রবেশ করেছে; উচ্চমানের কৃষিপণ্য বাজার ও ভোক্তাদের প্রশংসা পেয়েছে। লিথাং জেলার আধুনিক কৃষি পরিচালনা কার্যালয়ের স্থায়ী উপপরিচালক ইয়াং চি হুয়া বলেন, ‘আমাদের ছোট টমেটো ছেংতু শহরের সুপারমার্কেটে বিক্রি হয়। এ সপ্তাহে আমরা তিন থেকে পাঁচ টন পণ্য ছেংতুতে পাঠাবো। আমাদের পণ্য খুবই জনপ্রিয়।’
ইয়াং চি হুয়া আরও বলেন, ‘আমরা ক্রমান্বয়ে আধুনিক কৃষির ভিত্তি স্থাপন করছি। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল, সিছুয়ান-তিব্বত সড়ক চালু হওয়ার পর পণ্যের পরিবহনসমস্যা সমাধান করা। আশার কথা, আমাদের জেলার পরিবহন খাতে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে।’
সিছুয়ান-তিব্বত মহাসড়কসংলগ্ন স্থানীয় এলাকাগুলোর মতো দারিদ্র্যমুক্তির গল্প চীনে অসংখ্য। চীনের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দারিদ্র্যবিমোচন-পথ অনুসরণ করা হয়েছে। আর এর ফলেই চীন সম্পূর্ণভাবে হতদারিদ্র্যমুক্ত হতে পেরেছে। (ছাই/আলিম)