পশ্চিম মুখে আমার যাত্রা-পর্ব ১
2023-09-06 14:06:31

গত ২২ অগাস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর - ১৩ দিনের জন্য আমি চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় ভ্রমণ করি। দু সপ্তাহের মতো এ সময়ে আমি বিশ্বে সবচেয়ে মনোরম ভূমিতে যা দেখেছি, করেছি এবং শুনেছি তা সারাজীবন আমার মনে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অসাধারণ এ যাত্রার কথা যদি না বলি, তা হবে দুঃখজনক ব্যাপার।

জুন মাসে যখন আমি হেইলংচিয়াং প্রদেশে কৃষি বিষয়ক একটি ভিডিুউ শুটিং করছিলাম তখন অফিস থেকে তথ্য পাই যে, আমার তিব্বতে যাবার সুযোগ হচ্ছে। তিব্বতের এনগারি অঞ্চলে  যাবার কথা শুনে আমি দ্রুত আমার ফোনে জায়গাটি খুঁজি এবং সেখানকার তথ্য জানার চেষ্টা করি।  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এনগারি অঞ্চলের গড়  উচ্চতা সাড়ে ৪ হাজার মিটার। প্রথমে আমি আশ্চর্য হই এবং তারপর চিন্তিত হই। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেইজিংয়ের উচ্চতা মাত্র ৫০ মিটার। এত উঁচু জায়গায় গেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।  হেইলংচিয়াং থেকে বেইজিংয়ে ফিরে আসার পর আমি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হই। তখন ভাবি তিব্বতে যাওয়া হবে না আমার। তবে কেউ ভাবেনি যে, এ সফর কার্যক্রম পিছিয়ে দেওয়া হবে। যাই হোক তিব্বতে যাওয়ার ব্যাপারে তখন আমার মনে আর কোনও দ্বিধা থাকে না। ২২ অগাস্ট আমি ও হিন্দি বিভাগের একজন নারী সহকর্মী, নেপালি বিভাগের দুজন সহকর্মী এবং আমাদের বাংলা বিভাগের স্বর্ণা আপুর সঙ্গে বেইজিং থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা যাই বিমানযোগে। আমাদের সঙ্গে যান একজন ফটোগ্রাফার। তাঁর নাম ইয়াং। লাসায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ভিডিও পরিচালক চাং, উনি চীনের ফু চিয়ান প্রদেশ থেকে তিব্বতে যান।

কেন আমরা এনগারি অঞ্চলে সরাসরি না গিয়ে লাসায় দু দিনের মতো থাকি? আগেই বলেছি, উচ্চতার কারণে সাধারণ মানুষ তিব্বতের পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। মালভূমিতে অক্সিজেন অভাব খুব স্বাভাবিক। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, মাথা ব্যথা, ট্যাকিকার্ডিয়াসহ নানা লক্ষণ দেখা দেয়।  এনগারি অঞ্চলের তুলনায় লাসা শহরের উচ্চতা কম। ৩ হাজার ৪শ’ মিটার উঁচু লাসা শহরে দু দিনের মতো থাকার পর এনগারি অঞ্চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাত বছর আগে আমি তিব্বত প্রদর্শনীতে সাক্ষাৎকার নিতে একবার লাসা শহরে এসেছিলাম এবং এক সপ্তাহের মতো ছিলাম। তখন আমার বয়স কম ছিল এবং শারীরিক অবস্থা এখনকার চেয়ে ভাল ছিল। তাই ওইবার আমার কোন অসুস্থতা বোধ হয় না। তবে ৭ বছর পর আবার লাসায় আসার পর আমার অবস্থা অন্যরকম হয়। লাসায় আসার এক সপ্তাহ  আগ থেকে আমি এক ধরনের অক্সিজন সরবরাহের ওষুধ খেতে শুরু করি। ভেবেছিলাম লাসায় আমার কোনও সমস্যা হবে না। ২২ অগাস্ট আমরা ৬জন বেইজিং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে লাসার বিমানে চড়ি। সকালে সাড়ে ৭টার ফ্লাইটের কারণে আমি সাড়ে ৪টায় বাড়ি থেকে বের হই, ওই রাতে প্রায় কোন ঘুম হয়নি। সাড়ে তিন ঘন্টার ফ্লাইটে আমি ৩০ মিনিটের মতো ঘুমিয়ে নিই। পরে শুনি ফটোগ্রাফার বিমান থেকে বেশ সুন্দর ছবি তুলেছেন, তবে আমার পাশে জানালা না থাকার কারণে আমি কিছুই দেখতে পাইনি। পরে একটি চলচ্চিত্র দেখার পর আমরা লাসা বিমানবন্দরে অবতরণ করি।

প্রথম দুদিন আমাদের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তখন মূল কাজ ছিল যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। আমাদের হোটেল বিমানবন্দর থেকে অনেক দূর। আরও এক ঘন্টা পর আমরা লাসায় আমাদের হোটেলে পৌঁছাই। তখন পর্যন্ত সবার অবস্থা ভাল ছিল। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ খেতে বের হই আমরা; ট্যাক্সিতে করে একটি সিছুয়ান খাবারের রেঁস্তোরা যাই। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে তিব্বতে শাকসবজি ও ফলের চাষ কম। তারা মূলত প্রতিবেশী সিছুয়ান প্রদেশ ও সিন চিয়াং থেকে ফল ও সবজি আনে। তিব্বতে সিছুয়ান খাবার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং সেটা খুব জনপ্রিয়। যেদিন আমরা ওই রেঁস্তোরায় যাই, সেদিন ছিল চীনের ঐতিহ্যবাহী ভালবাসা দিবস - ছিসি দিবস। সে উপলক্ষ্যে রেঁস্তোরাটি বিশেষভাবে সাজানো ছিল এবং পথে  নানা তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকা দেখে আমাদের মন ভাল হয়ে যায়। শুনেছি এনগারি অঞ্চলে খুব বেশি রেঁস্তোরা পাওয়া যাবে না, তাই আমরা পছন্দের সব খাবার অর্ডার করি এবং ভাল করে খাই। তারপর আমরা বাইরে বেড়াতে যাই। রেঁস্তোরাটি  পোতালা প্রাসাদের কাছাকাছি। পোতালা প্রাসাদ তিব্বতের প্রতীক-ভবন এবং কোনও পর্যটক যখন তিব্বতে আসেন তখন অবশ্যই এখানে আসেন। সাত বছর আগে আমি পোতালা প্রাসাদের সামনে যেখানে যে ভঙ্গীতে ছবি তুলেছিলাম আজ একই জায়গায় একই ভঙ্গি আবার ছবি তুলি। সময় কত দ্রুত চলে যায়, তাই না? আমরা পোতালা প্রাসাদের কাছাকাছি জায়গায় একটু ঘুরি এবং স্থানীয় বিখ্যাত একটি দুধ চা ব্র্যান্ডের পানীয় পান করি। তারপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিই।

 দ্বিতীয় দিনও ইচ্ছা মতো কাটাই। বারখো নামে একটি স্ট্রিটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তের শ’ বছর আগে, তত্কালীন থাং রাজবংশ আমলের রাজা একজন রাজকুমারীকে তিব্বতের রাজার কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। এই রাজকুমারীকে স্বাগত জানাতে পোতালা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তিব্বতের রাজা। রাজকুমারী আসার পর প্রাসাদের অদূরে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এ মন্দিরের নাম জোখাং মন্দির। জোখাং মন্দিরের পাশে একটি সড়ক আছে, নাম বারখো ট্রিট।  প্রার্থনা করতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জোখাং মন্দিরে আসে। আমার প্রথম তিব্বত সফরে আমি প্রায় প্রতিদিন বারখো স্ট্রিটে আসি। এখানে যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তেমনি এখান থেকে আধুনিক তিব্বতি মানুষের জীবনযাপনের রীতি সম্পর্কে জানা যায়। বারখো ট্রিটে আমি দেখি অনেক ছেলে-মেয়ে তিব্বতি জাতির পোশাক পরে ছবি তুলছেন। আমিও তাদের মতো এমন ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নিই। এ সড়কে এমন ছবি তোলার দোকানের সংখ্যা ৩শ’র বেশি। আমাদের দলের ফটোগ্রাফারের পরামর্শে আমি ৩ শতাধিক দোকানের  মধ্য থেকে একটি বাছাই করি। প্রথম তারা আইপ্যাডে নানা ভঙ্গী ও স্টাইলের ছবি আপনাকে দেখাবে এবং আপনি সেগুলো থেকে নিজের পছন্দের ভঙ্গী বাছাই করতে পারবেন। তারপর তারা সেভাবে মেক আপ করায় এবং পোশাক পরায়। পরে ফটোগ্রাফার আপনাকে নিয়ে বারখো সড়কের নানা জায়গায় গিয়ে ছবি তোলেন। তাদের জন্য এটি নিত্যদিনের ও পরিচিত কাজ। তাই দু ঘন্টার মধ্যে ছবি তোলা শেষ হয়। তারপর সব ছবির মধ্য থেকে নিজের পছন্দের কয়েকটি আপনি বাছাই করতে পারবেন, যেগুলো তারা ফটো সম্পাদনার মাধ্যমে আরও সুন্দর করে তুলবে। এ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া শেষ হয়।  তিন ঘন্টার মধ্যে আমি বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন  করি। ছবিগুলো আমার ভাল লাগে আর দিনটি আমার সুন্দর স্মৃতিতে পরিণত হয়। দুপুরে আমরা স্থানীয় বিখ্যাত একটি তিব্বতি রেঁস্তোরায় খেতে যাই। তিব্বতি জাতির খাবার মূলত রুটি, ইয়াক বা চমরি গরুর মাংস ও দই নিয়ে তৈরি। এবার আমাদের দলের ভিডিও পরিচালক চাং আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি আগের রাতে ফু চিয়ান প্রদেশ থেকে লাসায় পৌঁছেছেন। তবে এখানে আসার পর তিনি অসুস্থ বোধ করেন। তখন থেকে আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভালভাবে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে পারেন না। কঠিন ও কষ্টকর এ যাত্রায় তার অনেক কষ্ট হয়। যাই হোক ওই রাতে আমিও অসুস্থ বোধ করি। আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা হয়। পরবর্তী দিন সকালের ফ্লাইটে আমরা এনগারি অঞ্চলে যাবো। ফ্লাইট যাতে মিস না করি, সেজন্য আমি মধ্য রাতে কিছু ওষুধ খাই। ভাঙা ভাঙা ঘুমে সে রাত শেষ হয়।

তিব্বতের আসার তৃতীয় দিন আমরা আমাদের গন্তব্যস্থল এনগারি এলাকায় যাই। দুই ঘন্টা পর আমাদের উড়োজাহাজ এনগারি খুন শা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ওই বিমানবন্দর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৪শ’ মিটার উঁচুতে এবং বিমান থেকে নামার পর আমি লক্ষ্য করি আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেছে। জীবনে কখনও এত উঁচু জায়গায় আসিনি। আমার জন্য চ্যালেঞ্জ সবে শুরু হয়। এনগারি বিমানবন্দর আকারে ছোটখাট। প্রতিদিন দু বার লাসা থেকে এখানে বিমান আসে। এমনকি শীতকালে মাত্র একটি ফ্লাইট আসে। এনগারি অঞ্চল দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সীমান্ত এলাকা। এর আয়তন ৩৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর অধীনে ৭টি জেলা আছে এবং এর স্থানীয় সরকার বসে সিছুয়ানহ্য জেলায়। এখানে বাস করে তিব্বত, হান, মঙ্গোলিয়া ও উইগুরসহ ৩৪টি জাতির মানুষ। হাজার হাজার পাহাড় ও নদীর উত্স হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এ অঞ্চলটিকে। বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয়, পবিত্র পর্বত গ্যাং রেনপোচে, পবিত্র হ্রদ মাপাংইউংচুও সব এখানে অবস্থিত। যাই হোক, এনগারি আসার পর আমাদের যাত্রাও আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বিমানবন্দরে আমাদের জন্য আপেক্ষায় রয়েছে তিনটি এসইউভি। পরের ১০ দিনের যাত্রায় আমাদের জন্য সেবা প্রদান করে ওই তিনটি গাড়ি। কারণ এবার আমরা ৪-৫টি জেলায় যাব, যেখানে স্থানীয় চালক ছাড়া  যাবার কোনও উপায় নেই। ট্রেন বা বিমানে করে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তখন আমি জানতাম না এ গাড়িযাত্রা এত মজার ও স্মরণীয় হতে পারে।

গাড়িতে দেড় ঘন্টার যাত্রার পর আমরা এনগারি অঞ্চলের প্রথম হোটেল শ্যানসি হোটেলে পোঁছাই। নাম থেকে বোঝা যায় এটি চীনের শ্যানসি প্রদেশের সাহায্যে নির্মিত একটি হোটেল। তবে মালভূমি এলাকার সঙ্গে আমিসহ বেশ কয়েকজন খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলাম না। হোটেল রুমে রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, তবে বাকি সময়ও আমাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। তাই আমরা  ওষুধের দোকান থেকে কিছু বহনযোগ্য অক্সিজেন ট্যাংক কিনি।  বিকেলেও আমার অসুস্থতা যায় না। উপায়ন্তর না দেখে হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে এক ঘন্টার মতো অক্সিজেন নেই। এতে আমার মাথাব্যথা একটু কমে। তবে রাতে প্রায় কোনও ঘুমই হয়না। ওষুধ খাই এবং বসে কিছুক্ষণ অক্সিজন নিই। এনগারি অঞ্চলে আমার প্রথম দিন এভাবে শেষ হয়।

ভ্রমণের চতুর্থ দিন আমরা রিতু জেলায় যাই। যাবার পথে বেশ কয়েকটি উঁচু পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। সর্ব্বোচ্চ উচ্চতা ৫ হাজার ১শ’ মিটারেরও বেশি। রিতু জেলায় আমরা শিলাচিত্র নিয়ে অনুষ্ঠান করতে যাই। রিতু জেলা হলো চীনের শিলাচিত্রের জন্মস্থানগুলোর মধ্যে একটি। এসব চিত্র তৈরি  করা হয়েছে মূলত পাথর খোদাই করে। এতে ব্যবহৃত হয় অল্প পরিমাণে গেরুয়া পেইন্টিং। আর এর বিষয়বস্তু সমৃদ্ধি - শিকার, চারণভূমি, লড়াই, প্রাণী, বাসনপত্র, প্রাকৃতিক বস্তু, ইত্যাদি।

তিব্বতের রিতু কাউন্টির বিস্তীর্ণ ভূমিতে লুকিয়ে আছে একটি প্রাচীন ও রহস্যময় শৈল্পিক ঐতিহ্য তথা শিলাচিত্র। হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকা এই পাথরের খোদাইগুলো প্রাচীন সভ্যতার উজ্জ্বলতা ও প্রজ্ঞার সাক্ষী। এনগারির রিতু জেলায় শিলাচিত্রের সৌন্দর্য দেখার জন্য যাত্রা করি আমরা।

রিতু জেলার শিলাচিত্রগুলো গিরিখাত, গুহা ও পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত এবং এগুলোর অনন্য উজ্জ্বল রঙ ও দুর্দান্ত সৌন্দর্য শ্বাসরুদ্ধকার। এই শিলাচিত্রগুলোর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। এসব চিত্র তিব্বতের প্রাচীন মানুষের জীবন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে। শিলাচিত্রের বিষয় বৈচিত্র্যময়, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের দৃশ্য, পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তি, চাষের দৃশ্য ইত্যাদি। প্রতিটি শিলাচিত্র সেই সময়ের মানুষের জ্ঞানের প্রকাশ।

রিতু জেলার সরকার ও স্থানীয় বাসিন্দারা এই শিলাচিত্রগুলোকে রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এই মহান শিলাচিত্রগুলো দেখতে এবং হাজার হাজার বছরের সভ্যতার বর্ষণ ও জ্ঞানের আলোকসজ্জা উপভোগ করতে পর্যটকদের সংখ্যা এখানে ক্রমাগত বাড়ছে।

শিলাচিত্রের উপরে খোদাই করা প্রাণীর মধ্যে রয়েছে নীল ভেড়া, অ্যান্টিলোপ, হরিণ, ইয়াক, গাধা, কুকুর, চিতাবাঘ ইত্যাদি। শিলাচিত্র ছবির এই অবশিষ্টাংশগুলো তিব্বতের আদিম মানুষের ‘নথিপত্র’ ও শিল্পকর্ম। এটা সত্যিই দর্শনীয়।

তবে এত সুন্দর ও  অসাধারণ দৃশ্য দেখার জন্য আমরা যে কত কঠিন একটি যাত্রা করছি তা আগে কেউ ভাবেনি। আমি আগেই বলেছি এবার ভ্রমণের জন্য আমরা তিনটি গাড়ি ও তিনজন চালক ভাড়া করি। ওই দিন আমরা এনগারি অঞ্চলের সরকার থেকে রিতু জেলায় যাই এবং বিকেলে রিতু জেলায় পৌঁছাই। তিব্বত ও সিনচিয়াং – এ দুটি জায়গার সময় বেইজিংয়ের সময় থেকে দুই ঘন্টার মতো পেছনে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে সূর্যাস্ত হয় রাত ৯টার দিকে। বিকেলে আমরা যখন রিতু জেলায় পৌঁছাই, তখন খবর পাই শিলাচিত্র দেখতে আরও ১শ’ কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় যেতে হবে। তাই আমরা  অবিলম্বে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাই। গ্রামে ঢুকার পর আমরা আবিষ্কার করি সামনে প্রায় কোনও পথ নেই, শুধু পাথর ও মাটির রাস্তা। তাছাড়া, আমাদের ফোনও নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যায়। তার মানে তিনটি গাড়ির মধ্যে আমরা প্রায় কোনও যোগাযোগ করতে পারি না। আমি চায়না টেলিকম নামে একটি কোম্পানির ফোনসেবা ব্যবহার করি এবং কখনও কখনও একটু একটু সংকেত পাই। এমন অবস্থায় আমরা একটি সেতুর সামনে এসে পৌঁছাই, যেটি কিছু দিন আগে বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়েছে। অন্য দিকে যেতে চাইলে ছোট নদীটি অতিক্রম করতে হবে। আমাদের চালকরা সব অভিজ্ঞ মানুষ, তবে অপরিচিত একটি নদী পার হতে তারা বেশ সাবধানে থাকেন। আমাদের গাড়ি যখন নদীর অন্য তীরে আসে ঠিক তখন ফটোগ্রাফার ও পরিচালকের গাড়ি ভিন্ন একটি দিকে এগিয়ে যায়। আমরা জোর গলায় তাদেরকে ডাকি, তবে কেউ শুনতে পান না। তাদেরকে ফোন করতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের ফোনও নেটওয়ার্কের বাইরে। পরে আমরা জানতে পারি পরিচালক চিন্তা করেছিলেন যে, শুটিংয়ের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে না, তাই গাড়িতে থাকা একজন স্থানীয় মানুষের কথা শুনে সবার আগে এক দিকে এগিয়ে যান। তবে ব্যাপার হলো যারা সঠিক পথ চেনেন তারা আমাদের বাকি দুটো গাড়িতে বসে আছেন। আমরা নষ্ট সেতুর পাশে ১০ মিনিটের মতো অপেক্ষা করি, কিন্তু তাদের গাড়ি ফিরে আসে না। কোন উপায়  না পেয়ে আমার গাড়ির চালক এবং আমি ওই গাড়ির পথ অনুসরণ করে তাদেরকে খুঁজতে যাই। কারণ আমার ফোন কিছুটা নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে, কোনও সমস্যা হলে বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো। চালক আমাকে নিয়ে আরও ১০-১২ কিলোমিটারের মতো যান এবং অবশেষে পরিচালকের গাড়ি খুঁজে পাই। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো কেউও হারিয়ে যাননি বা আঘাত পাননি। এমন জায়গায় যদি কেউ হারিয়ে যায়, তাহলে তিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। এমন ঘটনার পর আমরা আবার শিলাচিত্রের দিকে যাত্রা শুরু করি। বিকেলে ৭টার কাছাকাছি সময়ে আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছাই। 

তবে এখানেও আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছিল।   বিস্তারিতভাবে আগামী সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আমি তুলে ধরবো। আমার সঙ্গে থাকুন। আমার অসাধারণ তিব্বত ভ্রমণের কথা জানাবো আপনাদেরকে। (শিশির/রহমান/রুবি)