৪ থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় আসিয়ান শীর্ষসম্মেলন এবং পূর্ব এশীয় সহযোগিতা নেতৃবৃন্দের সভা শুরু হয়। আসিয়ান সদস্য দেশ, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ এবং কুক দ্বীপপুঞ্জের মতো সংলাপ অংশীদার এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ২০টিরও বেশি দেশের নেতা ও প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করছে।
আয়োজক দেশ ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে যে, এটি আসিয়ান ও অংশীদারদের মধ্যে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে বড় শীর্ষসম্মেলন। ইন্দোনেশিয়ান পক্ষের মতে, এবারের আসিয়ান শীর্ষসম্মেলনের থিম হল ‘আসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র নির্মাণ’। বৈঠকের মধ্যে থাকবে আসিয়ানের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন, "দক্ষিণ চীন সাগরে আচরণবিধি” নিয়ে আলোচনা করা, এই অঞ্চলের পারমাণবিক অস্ত্র-মুক্ত করার অবস্থা নিশ্চিত করা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধি উন্নত করা। অংশগ্রহণকারীরা কয়েক ডজন সহযোগিতার বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাবে।
সভার থিম থেকে বোঝা যায়, এই বৈঠকের কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। বৈঠকটি অর্থনৈতিক সহযোগিতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহযোগিতামূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। এ ধরনের একটি কর্মসূচী বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া এবং এই অঞ্চলের দেশগুলির সাধারণ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।
আসিয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোর আমন্ত্রণে, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং চীন-আসিয়ান (১০+১) শীর্ষ বৈঠক এবং আসিয়ান-চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া (১০+৩) শীর্ষবৈঠক এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষসম্মেলনে যোগ দেবেন এবং ইন্দোনেশিয়ায় সফর করবেন।
প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এটি তার কোন এশীয় দেশের প্রথম সফর। এটি পাঁচ বছরে চীনা প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ইন্দোনেশিয়া সফর, যা দু’দেশের মধ্যে সার্বিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকীর সঙ্গে মিলে যায়। এই সফরটি চীন ও আসিয়ানের মধ্যে সার্বিক সহযোগিতার পাশাপাশি চীন-ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক উন্নয়নেও অনেক তাত্পর্যপূর্ণ।
এ বৈঠক নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। অভিন্ন উন্নয়নের প্রচার, জনমতের ভিত্তি সুসংহত করা, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একীকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া এবং প্রকৃত বহুপাক্ষিকতার নীতি মেনে চলা।
চীন ও ইন্দোনেশিয়া সমুদ্রজুড়ে একে অপরের মুখোমুখি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আঞ্চলিক অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি সবসময় চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ উচ্চ পর্যায়ের মতবিনিময় হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের পর তিনিই ছিলেন চীন সফরে আসা প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান। গত জুলাইয়ে, উইডোডোও বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ছেংতুতে গিয়েছিলেন। এবারের সফরের সময়, লি ছিয়াং উইডোডোর সঙ্গে আলোচনা করবেন, চীন-ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক এবং অভিন্ন স্বার্থ জড়িত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে মতবিনিময় করবেন এবং শিল্প ও বাণিজ্য মহলের সঙ্গে সান্ধ্যভোজ-সহ অন্যান্য কার্যক্রমে যোগ দেবেন।
দুই দেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে, চীনা প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের জন্য অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিউনিটি গঠন করা, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় গভীর করা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো এবং যৌথভাবে আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি প্রচার করার জন্য নতুন সুযোগ হয়ে দাঁড়াবে।
চীন ও ইন্দোনেশিয়া উভয়ই জনবহুল দেশ এবং দুই দেশের বাজার পরস্পরের পরিপূরক। বর্তমানে, জাকার্তা-বান্দুং হাই-স্পিড রেলওয়ের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। তা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের কাঠামোর অধীনে একটি যুগান্তকারী প্রকল্প এবং স্থানীয় জনগণকে বাস্তব সুবিধা দেবে। এ ছাড়া, সবুজ জ্বালানি, মত্স্য শিল্প, বন্দর অর্থনীতি এবং শিল্প পার্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা দু’দেশের আধুনিকায়নে সহায়তা প্রদান করবে। লি ছিয়াং সফরের সময়, উভয় পক্ষ নতুন সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে।
বিপরীত দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, হোয়াইট হাউস আগেই ঘোষণা করেছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পূর্ব এশিয়া সহযোগিতা শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেবেন না, তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস উপস্থিত থাকবেন। ইন্দোনেশিয়ান সূত্র থেকে জানা গেছে, যদিও ইন্দোনেশিয়া বাইডেনকে আনার অনেক চেষ্টা করেছিল এবং এমনকি পূর্ববর্তী বছরগুলিতে নভেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈঠকের সময়সূচী সামঞ্জস্য করেছিল, বাইডেন তারপরও শেষ পর্যন্ত না আসার সিদ্ধান্ত নেন।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক বিষয়ে আসিয়ানের মূল ভূমিকাকে সম্মান করার দাবি করে। বাস্তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং তার নিজের অগ্রণী ভূমিকা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। কারণ একবার আসিয়ানের ভূমিকা অনেক বড় হয়ে গেলে এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য কমে যাবে এবং তার কিছু লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এ কারণে, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ‘ওকাস’ জোট এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে চার-মুখী সংলাপ প্রক্রিয়া চালু করছে। পাশাপাশি কিছু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়ে আসিয়ানের কেন্দ্রীয় অবস্থার ধারণা ও তা দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
অতীতের দিকে ফিরে তাকালে, তা মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল নির্মাণের সময়ই হোক বা এশিয়ার আর্থিক অস্থিরতা বা কোভিড-১৯ মহামারী হোক, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং জয়-জয় সহযোগিতার মনোভাব সমুন্নত রেখেছে। দুশ্চিন্তায় বা দুর্ভোগে- একে অপরকে সাহায্য করেছে এবং বিশ্বের পার্থক্য পাশে রেখে অভিন্নতা অনুসন্ধানে প্রাচ্যের প্রজ্ঞা দেখিয়েছে। বর্তমানে, যখন কিছু পশ্চিমা দেশ "ছোট বৃত্তে" এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা বাধা সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটে, আসিয়ান-সহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সাধারণ ধারা চিনতে পারে, বহুপাক্ষিকতার আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে আটকে রাখতে পারে এবং এশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
(ইয়াং/তৌহিদ/ছাই)