দেহঘড়ি পর্ব-০৩৪
2023-09-03 19:00:31

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

স্টিফ নেক থেকে মুক্তি দেবে টিসিএম

স্টিফ নেক বা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া মূলত ঘাড় বা কাঁধে ব্যথা এবং ঘাড় নাড়াতে অসুবিধা। এটি সাধারণত সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে অনুভূত হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদেনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এ সমস্যা। স্টিফ নেকের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো পেশী বা নরম টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া। সাধারণত স্টারনোক্লিডোমাস্টয়েড পেশী, লেভাটর স্ক্যাপুলা পেশী, ট্র্যাপিজিয়াস পেশী ও রম্বয়েড পেশী আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে স্টিফ নেক হয়।

স্টিফ নেকের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো অনুপযুক্ত পদ্ধতিতে ঘুমানো। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ভুল শারীরিক ভঙ্গির কারণেও এটা হতে পারে। যেমন দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার স্ক্রিন বা মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা, খেলাধুলার আঘাত যা আকস্মিকভাবে মাথা ঘুরিয়ে দেয়, এবং অতিরিক্ত চাপ বা উদ্বেগের ফলে পেশীতে টান পড়া। বেশিরভাগ মানুষ ঘুম থেকে ওঠার পর স্টিফ নেক উপলব্ধি করেন, তবে এর সঠিক কারণটি নিরূপণ করা বেশ কঠিন। দীর্ঘকালের ভুল শারীরিক ভঙ্গির কারণে ঘাড় ও কাঁধের চারপাশের নরম টিস্যু ও পেশীগুলো দুর্বল হয়ে এ সমস্যা হয়।

স্টিফ নেকের টিসিএম চিকিৎসা

স্টিফ নেক চিকিৎসায় মূলত আকুপাংচার, কাপিং, ভেষজ ওষুধ ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এর কারণ, লক্ষণ ও সময়কাল বিবেচনা করে টিসিএম চিকিৎসকরা নির্ধারণ করেন এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি কত সময়ের জন্য অবলম্বন করা হবে।

আকুপ্রেশার

স্টিফ নেকের চিকিৎসায় হৌ সি ও লুও চান পয়েন্টে আকুপ্রেসার প্রয়োগ করতে হয়। হৌ সি পয়েন্টে প্রেসারের ক্ষেত্রে উভয় হাত ওই পয়েন্টে রাখতে হবে এবং তারপর বৃত্তকারে ঘুরাতে হবে। এসময় আপনি স্থানটিতে অসাড়তা অনুভব করবেন। ঘাড়ে মূল শক্তি ‘ছি’ ও রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সেখানে আলতো করে বামে, ডানে, উপরে ও নীচে নাড়ানোর প্রয়োজন হয়।

লুও চান পয়েন্টে আকুপ্রেশারের ক্ষেত্রে ঘাড়ের যেখানে ব্যথা, তার বিপরীত দিকে ম্যাসাজ করতে হবে। ঘাড়ের বাম দিকে ব্যথা হলে, ডান বিন্দুতে ম্যাসেজ করতে হবে। আঙুলের ডগা দিয়ে বিন্দুটিতে ম্যাসাজ করতে হবে, যতক্ষণ না ব্যথা অনুভূত হয়। বিন্দুতে আঙুল ঘোরানোর সময় চাপ বজায় রাখতে হবে।

জীবনধারা পরিবর্তন

আপনার শারীরিক ভঙ্গির প্রতি সচেতন হোন এবং সেটা উন্নত করার চেষ্টা করুন। সারাদিন যাই করুন না কেন, খেয়াল রাখুন আপনার ঘাড়, কাঁধ ও পিঠ যেন সোজা থাকে। যখন আমরা সঠিক ভঙ্গি অবলম্বন করি, তখন মেরুদণ্ডের চারপাশের পেশীগুলো ভারসাম্যপূর্ণ থাকে এবং শরীরকে সমানভাবে সমর্থন করে।

যখন কম্পিউটারে কাজ করবেন, তখন কম্পিউটারের স্ক্রিন চোখের স্তরে রাখুন এবং আপনার পা মেঝেতে সমতল করে রাখুন। ঘাড় বা কাঁধ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখবেন না। কাজের ফাঁকে ছোট ছোট বিরতি নিন। প্রতি ঘন্টায় অন্তত একবার উঠুন এবং হাত প্রসারিত করুন।

কাঁধ ও কানের মাঝখানে ফোনের রিসিভার বা মোবাইল ফোন আটকে রেখে কথা বলা পরিহার করুন। প্রয়োজনে একটি ইয়ারপিস ব্যবহার করুন। দীর্ঘ সময় ধরে হ্যান্ডফোন, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেটের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। ভারী স্লিং ব্যাগ বহন এড়িয়ে চলুন। কারণ এটি ঘাড় ও কাঁধের পেশীর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। সম্ভব হলে এর পরিবর্তে ব্যাকপ্যাক ব্যবহার করুন।

এমন বালিশ ব্যবহার করবেন, যা আপনার মাথা ও ঘাড়কে সোজা রাখতে সাহায্য করে। আপনার ঘুমানোর অবস্থানের ভিত্তিতে বালিশের উচ্চতা ঠিক করুন। চিৎ হয়ে ঘুমানোর জন্য বালিশের আদর্শ উচ্চতা ৬ থেকে ৯ সেন্টিমিটার। এক পাশে ফিরে শোওয়ার জন্য বালিশের উচ্চতা একজনের মুষ্টির সমান হওয়া উচিৎ, যাতে আপনার ঘাড় ও কাঁধের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটি বালিশ পূরণ করতে পারে। এমন বালিশ ব্যবহার করুন যা খুব বেশি শক্তও না আবার খুব নরমও না। উপুড় হয়ে ঘুমানো এড়িয়ে চলুন।

ব্যায়াম

ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার পিঠ, পেট ও নিতম্বের পেশীর মূল শক্তি বজায় রাখুন। শক্তিশালী পেশী মেরুদণ্ডকে সমর্থন করতে এবং ঘাড়ের ব্যথা প্রতিরোধ করতে পারে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

শত বছরের পুরনো চীনের চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ অধিভুক্ত হাসপাতাল

চীনের চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ অধিভুক্ত হাসপাতালটি শত বছরের পুরনো একটি জেনারেল হাসপাতাল। উত্তরাঞ্চলীয় লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী শেনইয়াংয়ে অবস্থিত এ হাসপাতালটি মূলত একটি প্রদর্শনী হলের ওপর গড়ে উঠেছে। প্রদর্শনী হলটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে এবং এর ৩ বছর পর ১৯০৯ সালে সেখানে হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়।

এ হাসপাতালটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চীনে জাপানের আগ্রাসনের ইতিহাস। ১৯৩১ সালে চীনের উত্তরপূর্বাঞ্চলে আগ্রাসন চালানোর পর জাপান এ হাসপাতালটি দখল করে নেয় এর নাম দেয় মানছুখুও রেড ক্রস সোসাইটির ফ্যংথিয়ান হাসপাতাল। তবে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের পরাজয়ের পর এটি চীনের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। ওই বছরই এটার নামকরণ করা হয় চীনের রেড ক্রস সোসাইটির লিয়াওনিং হাসপাতাল। ১৯৪৯ সালের মার্চে হাসপাতালটিকে চীনের চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এ সিদ্ধান্ত হাসপাতালটিকে আমূল পরিবর্তনে সহায়তা করে। জাপানের আগ্রাসন-পরবর্তী সময়ে এটা চিকিৎসা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যুদ্ধাহতদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বর্তমানে দুই হাজার শয্যাবিশিষ্ট চতুর্থ অধিভুক্ত হাসপাতাল একটি বৃহৎ পরিসরের তৃতীয়-পর্যায়ের প্রথম-শ্রেণীর হাসপাতালে পরিণত হয়েছে; গড়ে উঠেছে চিকিৎসা, শিক্ষাদান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার এক সমন্বিত কেন্দ্র হিসাবে। সদর দফতরের চংশান ক্যাম্পাস এবং হেপিং ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত এ হাসপাতালটি ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে।

হাসপাতালটি ‘উৎসর্গ, দানশীলতা, ঐক্য ও অতিক্রম করে যাওয়া’ – এই সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখছে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়ে চলেছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের শক্তিশালী করে গড়ে তুলছে, ক্রমাগত চিকিৎসা-সেবা উন্নত করে চলেছে এবং উচ্চতর শৃঙ্খলা গড়ে তুলেছে।

একটি জেনারেল হাসপাতালে সাধারণত যতগুলো বিভাগ থাকে, তার সবই রয়েছে চতুর্থ অধিভুক্ত হাসপাতালটিতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ওষুধ, সাধারণ শল্য চিকিৎসা, জরুরি ওষুধ, নিবিড় পরিচর্যা ওষুধ, কার্ডিওলজি, ইউরোলজি, নিউরোলজি, রেডিওলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, নেফ্রোলজি, হেমাটোলজি, চক্ষুরোগবিদ্যা, শল্যচিকিৎসা, স্ত্রীরোগ, শিশুরোগ, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, ফিজিওথেরাপি, বহির্বিভাগ, চর্মরোগ, ফার্মেসি ও রিউমাটোলজি।

#ভেষজের গুণ

সলোমন’স সীলের এতো কদর কেন?

সলোমন’স সীল বা পলিগোনটাম একটি ভেষজ, যা ওষুধ, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অস্থিক্ষয়, প্রদাহ, ক্ষত, আলসার বা ফোঁড়া, অর্শ্বরোগ, ত্বকের লালভাব এবং টিস্যু শুকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ ও নিরাময়ে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এ ভেষজটি ভালো কাজ করে। জানিয়ে দিচ্ছে এর বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে:

অস্থি শক্ত রাখে: বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের হাড় দুর্বল হয়। হাড়গুলোকে সুস্থ রাখতে, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে এবং কোষের পুনর্জন্মে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরির জন্য অনেক বেশি পানির প্রয়োজন হয়। এই পানির যোগান দেয় সলোমন’স সীল।

সংযোগকারী টিস্যু সুস্থ রাখে: আমাদের টেন্ডন ও লিগামেন্ট যাতে খুব শক্ত বা খুব আলগা না হয়, সেজন্য সেগুলোতে সঠিক মাত্রার স্থিতিস্থাপকতা প্রয়োজন হয়। এই স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখতে সাহায্য করে সলোমন’স সীল।

প্রদাহ ও ব্যথা উপশম করে: সলোমন’স সিলে অ্যালানটোইন নামক একটি প্রাকৃতিক প্রদাহ-বিরোধী পুষ্টি রয়েছে। তাই এটি ব্যথা কমায়, স্নায়ু শান্ত করে, প্রদাহ কমায় এবং প্রশান্তিময় ঘুমে সাহায্য করে। এ উপাদানের কারণে এ ভেষজ লোশন, ত্বকের ক্রিম, চর্মরোগের ওষুধ, মুখের স্বাস্থ্যরক্ষা পণ্য এবং প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়।

হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: সলোমন’স সীলে অল্প, নিরাপদ পরিমাণে কনভালারিন নামক একটি কার্ডিওগ্লাইকোসাইড উপাদান রয়েছে, যা কিছু মাত্রায় হৃৎপিণ্ডের পেশী নিয়ন্ত্রণ করে। সেকারণে এ ভেষজ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধে ব্যবহার করা হয়।

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: একটি অ্যাডাপ্টোজেনিক ভেষজ হিসাবে সলোমন’স সিল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং এর মাধ্যমে শরীরকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা যেমন হাড়, সংযোগকারী টিস্যু ও অস্থিসন্ধির আঘাত সামলাতে দেহকে সাহায্য করে।

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।