আজীবনের অনারারি সম্পাদকের মর্যাদা পেলেন গ্রামে অবস্থানকারী প্রথম সম্পাদক
2023-08-25 10:00:05


সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিফর্ম খুলে কর্মীর পোশাক পরে ইলেকট্রিক কাজের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ পরিবারে আলো জালিয়েছেন তিনি। এখন তিনি ইউনিফর্ম খুলে গ্রামে অবস্থান করছেন। দারিদ্র্য বিমোচনে তিনি কোনও কঠিনতায় ভয় পান না। যার কথা বলছি, তার নাম ওয়াং ওয়েন কাং। তিনি স্টেট গ্রিডের ইনার মঙ্গোলিয়ার সিং আন শহরের হরছিন রাইট ফ্রন্ট ব্যানার জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি থেকে তোং ফাং হ্য গ্রামে নিয়োজিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্পাদক। ২০১৬ সাল থেকে তিনি পরপর ইনার মঙ্গোলিয়ার সিন আন শহরের হরছিন রাইট ফ্রন্ট ব্যানার জেলার শুয়াং হুয়া গ্রাম ও তোং ফাং হোং গ্রামে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি একজন সেনার আত্মা ও স্টেট গ্রিডের চরিত্র নিয়ে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে লড়াই করেছেন এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অবদান রেখেছেন।

তের বছর ধরে সেনাবাহিনীতে সেবা দেওয়ার পর ২০০০ সালে ওয়াং ওয়েন কাং সম্মানের সঙ্গে অবসর নেন। তাঁকে স্টেট গ্রিডের ইনার মঙ্গোলিয়ার হরছিন রাইট ফ্রন্ট ব্যানার জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ওয়াং ওয়েন কাং দারিদ্র্যবিমোচন দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সামনের সারিতে থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

তোং ফাং হোং গ্রামে আসার প্রথম দিকের স্মৃতি হাতড়ে ওয়াং ওয়েন কাং বলেন, “শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম। বিশেষ করে ২০১৮ সালে শুয়াং হুয়া গ্রাম থেকে তোং ফাং হোং গ্রামের প্রথম সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সময় কোনও গণভিত্তি ছিল না। জনগণের আস্থা অর্জন মুশকিল ছিল। তাই দারিদ্র্যমুক্তকরণে তাদের সহযোগিতা খুব ধীর ছিল।”

একজন সাবেক সেনা হিসাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পিছু হটা ওয়াং ওয়েন কাংয়ের প্রকৃতি নয়। তিনি ছয় মাস ধরে পরিবারের পর পরিবার পরিদর্শন করেন এবং বাসিন্দাদের খোঁজখবর নেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন নীতি কার্যকর করেন এবং গ্রামবাসীদের দেখাশোনা করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ভাতা দিতে তিনি কলম ও কাগজ নিয়ে একা একা গ্রামের ২২৭টি পরিবারে যান এবং তাদের ৮৩৫ জন সদস্যের কাছে সেটা পৌঁছে দেন।

তোং ফাং হোং গ্রামে প্রধানত ভুট্টা চাষ করা হয়। ভুট্টা ফলনের পর খড় বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয় অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এ খড় গরুর জন্য খুব ভালো খাবার। ২০১৮ সালের শরত্কালে ওয়াং ওয়েন কাং গ্রামবাসীদের নিয়ে গরু পালনের পথে এগিয়ে চলতে শুরু করেন।

“সম্পাদক ওয়াং। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আমার পরিবার গরু পালন করতে চায়।” কথাগুলো বলছিলেন তোং ফাং হোং গ্রামে যারা পথম গরু পালন শুরু করেছিলেন তাদের একজন - ৬১ বছর বয়সী চৌ লি চুন। সরকারের সহায়তায় ২০১৮ সালে চৌ লি চুন পরিবারকে দুটি গরু দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে তার গরু পালনের যাত্রা শুরু হয়।

চৌ লি চুন বলেন, “প্রথম দিকে সম্পাদক ওয়াং গ্রামের অভিজ্ঞ গরু পালকদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিন আমার বাড়িতে ছুটে আসতেন। খাবার, প্রজনন ও চিকিত্সাসহ সব কাজ দেখাশোনা করেছেন তিনি।” ২০১৯ সালে চৌ লি চুনের দুটি গরুর গর্ভে দুটি যমজ বাচ্চা আসে। তাতে খুব উত্সাহিত হন চৌ লি চুন। ওয়াং ওয়েন কাং অনতিবিলম্বে চৌ লি চুনের গরুর জন্য পশুচিকিত্সক নিয়ে আসেন।

বর্তমানে চৌ লি চুন খুব ভালো গরু পালন করেন। তিনি ৬টি গরু পালন করে বছরে ৬০ হাজার ইউয়ানের মতো উপার্জন করতে পারছেন।

আরও বেশি অধিবাসী যাতে গরু পালনের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেন এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে অবদান রাখতে পারেন, সেজন্য ২০২০ সালে গরু পালন-সম্পর্কিত একটি সমবায় গঠন করেন ওয়াং ওয়েন কাং। তিনি ৮টি সহযোগিতা দল গঠন করেন। অভিজ্ঞ গরু পালনকারী এ দলের নেতা হন। নতুন করে যারা গরু লালন দলে যোগ দিচ্ছেন, তাদেরকে লালন-পালন কৌশল থেকে বিক্রি পর্যন্ত ধারাবাহিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। বর্তমানে তোং ফাং হোং গ্রামের গরুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭৬-এ যেখানে আগে এ সংখ্যা ছিল ১৬৭। গ্রামটিতে যে শেষ চারটি দরিদ্র পরিবার ছিল, গরু পালনের মাধ্যমে ২০২০ সালে তারা দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসে। এর অর্থ তোং ফাং হোং গ্রামটি পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত হয়।

ওয়াং ওয়েন কাং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “২০২৫ সালে আমাদের গ্রামে গরুর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যাবে এবং গ্রামবাসীদের উপার্জন দ্বিগুণ ছাড়ানোর লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে।”

সেনাবাহিনী ত্যাগ করার পর সম্পাদক নিযুক্ত হন ওয়াং ওয়েন কাং। তাই তার জন্য গ্রামের কর্মকর্তাদের হোস্টেলে থেকে প্রতিটি দরিদ্র পরিবারে যেতে কত ধাপ লেগেছে, তা সেনাবাহিনীতে সারিবদ্ধ হয়ে নম্বর গণনার মতো মুখস্ত বলতে পারেন তিনি।

“গ্রামবাসীরা আপনাকে খোঁজেন। এটি আপনার ওপর তাদের আস্থার প্রতিফলন। দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য করতে শুধু চিত্কার করা নয়; বরং পরিশ্রমের মাধ্যমেই তা অর্জন করা যায়।” ওয়াং ওয়েন কাং সব সময় এ কথা বলেন। তিনি ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। বিনিয়োগ আকর্ষণ থেকে পরিবারের সামান্য বিষয় পর্যন্ত তিনি সবকিছুর ওপর মনোযোগ দেন। তাই গ্রামবাসীরা তাঁকে ‘সব সময় ব্যস্ত সম্পাদক’ হিসেবে প্রশংসা করেন।

“চীনে একটি প্রবচন আছে: মানুষকে মাছ দেওয়ার চেয়ে মাছ ধরার পদ্ধতি জানানো ভালো। কেবল প্রেসক্রিপশন ঠিক থাকলে দারিদ্র্য-রোগ নির্মূল করা যায়। স্থানীয় বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী দরিদ্রদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।” ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ওয়াং ওয়েন কাং দারিদ্র বিমোচনের ডায়রিতে এ সব কথা লিখেছেন।

২০১৯ সালের এপ্রিলে তোং ফাং হোং গ্রামে ভুট্টা চাষ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তা শি চাই উপজেলার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রযুক্তিবিদ প্রশিক্ষণে শিক্ষাদান করেন। ২৪৬ জন গ্রামবাসী প্রশিক্ষণে অংশ নেন। বীজ বাছাই, সার প্রয়োগ কমানো এবং বীজ বপণ করাসব নানা বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয় ক্লাসে।

২০২০ সালে গ্রামীণ গ্রিড নবায়ন করার আগে তোং ফাং হোং গ্রামে কেবল দুটি ট্রান্সফরমার ছিল, যার মোট ক্ষমতা ছিল ১৫০ কেভিএ। গ্রামে যেটি ব্যবহৃত হতো, সেটির ক্ষমতা ছিল মাত্র ১৭৬ ভোল্ট। সেটা দিয়ে মাঝ্যমধ্যেই রান্না করা, জল সিদ্ধ করা বা বাতি জ্বালানো যেত না।

গ্রামবাসীদের এ সমস্যা সমাধান করতে ওয়াং ওয়েন কাং তত্ক্ষনিকভাবে ইনার মঙ্গোলিয়ার হরছিন রাইট ফ্রন্ট ব্যানার জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কোম্পানির কাছে তোং ফাং হোং গ্রামকে সংস্কারের তালিকাভুক্ত করার আবেদন জানান তিনি।

ওয়াং ওয়েন কাংয়ের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি একটি বিশেষ দল গঠন করে গ্রামে জরিপ চালায় এবং দ্রুততার সঙ্গে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ইউয়ান অর্থ ব্যয়ে গ্রিড হালনাগাদ করে। আগে ক্ষমতা যেখানে ১৭৬ ভোল্ট ছিল, সেখানে বর্তমানে এটা ২২০ ভোল্টে উন্নীত হয়েছে।

২০১৮ সালের ৪ জুলাই স্টেট গ্রিডের ইনার মঙ্গোলিয়ার পূর্ব সিন আন শহরের হরছিন রাইট ফ্রন্ট ব্যানারের বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি দরিদ্র পরিবারগুলোকে আঙ্গিনা-অর্থনীতি উন্নয়নে উত্সাহিত করে। কোম্পানিটি প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে ৫০টি মুরগির ছানা কিনে দেয়। ছিয়াত্তর বছর বয়সী তৌ ইয়ু লিন এ ৫০টি ছানা দেখে অসুবিধায় পড়েন। কারণ কীভাবে তাদেরকে খাওয়াবে। এটি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর তিনি ওই ৫০টি ছানা ওয়াং ওয়েন কাংয়ের কাছে ফেরত দেন। ওয়াং ওয়েন কাং বাক্সে ৫০টি প্রাণচঞ্চল ছানা এবং ব্যাথাভরা মুখ দেখে তৌ ইয়ু লিনকে হেসে বলেন, “চাচা তৌ, এ ছানাগুলো সহজে পালন করা যায়। আপনার অসুবিধা নিয়ে আমি ইতোমধ্যেই ভেবেছি, আমি আপনার সমস্যা সমাধান করে দিতে পারি। এ ছানা লালন-পালন করতে আপনার নৌকা লাগবে না।”

এ কথা বলার পর ওয়াং ওয়েন কাং তৌ ইয়ু লিনকে পাহাড়ে নিয়ে যান। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, “চাচা তৌ, দিনের বেলা আপনি মুরগির বাচ্চাগুলোকে পাহাড়ে ছেড়ে দিবেন। ছানাগুলো পাহাড়ে খাবার খুঁজে খাবে। রাতে আপনি বন্য সবজির সঙ্গে ভুট্টা-ময়দা মিশিয়ে তাদেরকে খাওয়াবেন। শরত্কালে ভুট্টার কোব টুকরো টুকরো করে ছানাগুলোকে খাওয়াতে পারেন। এভাবে খাবারের সমস্যার সমাধান হয়।”

পাঁচ মাস ধরে লালন-পালনের পর ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ছানাগুলোর ওজন সাড়ে ৩ কেজিতে দাঁড়ায়। গ্রামে মোতায়েন কর্মদলের সাহায্যে তৌ ইয়ু লিন ২৭টি মুরগি বিক্রি করেন এবং প্রতি মুরগির দাম দাঁড়ায় ১০০ ইউয়ানে। তিনি এগুলো থেকে ২ হাজার ৭শ’ ইউয়ান উপার্জন করেন। এ গ্রীষ্মে তিনি ২ হাজার ৪শ’টি ডিম বিক্রি করেন এবং তা থেকে ২ হাজার ৮৮০ ইউয়ান উপার্জন করেন। বর্তমানে তোং ফাং হোং গ্রামে ৫ হাজার ৩২৬টি মুরগি পালন করা হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার ইউয়ান উপার্জন করছেন গ্রামবাসীরা।

ওয়াং ওয়েন কাংয়ের পরিশ্রম ও অবদান গ্রামবাসীদের চোখে পড়ে। এটাকে মনেও রাখেন তারা। সম্প্রতি তোং ফাং হোং গ্রামের প্রশাসন প্রামবাসীদের পক্ষ থেকে ওয়াং ওয়েন কাংকে আজীবন অনারারি সম্পাদকের সনদপত্র প্রদান করেছে।

শুয়াং হুয়া গ্রাম থেকে তোং ফাং হোং গ্রামে ওয়াং ওয়েন কাংয়ের মুখে সব সময় ‘আমাদের গ্রাম’ কথাটি উচ্চারিত হয়। তিনি বলেন, যে কোনও পদের মেয়াদ থাকে। তবে জনগণকে সেবা দেওয়ায় কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। অনারারি সম্পাদকের স্বীকৃতি চিরদিন তার সর্বোচ্চ সম্মান।

(রুবি/রহমান)