চাং শা চীনের হু নান প্রদেশে রাজধানী। তারকার শহর নামে খ্যাতি আছে এ শহরের। এ শহরের ইতিহাস ৩ হাজার বছরের পুরনো। মিডিয়া ও সংস্কৃতির শহর, ইন্টারনেট সেলিব্রিটি শহর, যুববান্ধব শহরসহ নানা নাম অর্জন করেছে চাং শা।
চীনের মহান নেতা মাও সে তুংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল চাং শার। ১৯১১ সালের বসন্তকালে ১৮ বছর বয়সী মাও সে তুং লেখাপড়া করতে গ্রাম থেকে শহরে এসে হুনান প্রদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ওঠেন।
সেখানে তিনি নতুন জ্ঞান অর্জন করেন এবং নানা নতুন তথ্য জানেন। সেখানেই তিনি চীন এমনকি বিশ্ব সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানতে পারেন। তাঁর জীবনের অনেক ‘প্রথম ঘটনা’ ছাংশা শহরেই ঘটেছে। তিনি লেখাপড়া ও বিপ্লব করতে করতে ১৭ বছর সময় কাটান ছাংশায়। বেইজিংয়ের পর তিনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটান ছাংশায়। সেখানকার সবকিছু তাঁর কাছে খুব পরিচিত।
১৯৭৪ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চেয়ারম্যান মাও ১১৪ দিনের মতো ছাংশায় ছিলেন। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। বিশ্রাম নিয়ে ছাংশায় ফেরেন তিনি। অসুস্থ হলেও তিনি তারুণ্য ও যৌবনকালের প্রিয় জায়গা দেখতে যান। তাই কমলা দ্বীপ, ইউয়ে লু পাহাড়, আই ওয়ান প্যাভিলিয়নসহ প্রতিটি জায়গায় যান তিনি।
২০০৯ সালে ছাংশার কমলা দ্বীপে যুবক মাও সে তুংয়ের একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। এটা চীনে একমাত্র যুবক মাও সে তুংয়ের ভাস্কর্য। এটি মাওয়ের সব ভাস্কর্যের মধ্যে সবচেয়ে ভারী। বর্তমানে প্রতিদিন অনেক পর্যটক ছাংশা ভ্রমণ করতে আসেন।
এখনকার চাং শা কি রকম? ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। প্রাচীনকালে চাং শার উচ্চ বিদ্যালয়ের টোরি এখনও দাঁড়ানো আছে। তবে পাশে একটি ভিনাইল রেকর্ড থিমযুক্ত কফি শপ খোলা হয়েছে। ইউয়ে লু পাহালে উঠলে আপনি দেখতে পাবেন মাও সে তুং ও অন্য নেতাদের সম্পর্কিত স্মৃতিচিহ্ন এখনও আগের মতো ওখানে আছে। ফোনের অ্যাপে ওখানটা পরিদর্শনের নতুন রুট দেখতে পাবেন আপনি। ওই রুট তৈরি ও আপলোড করেন পর্যটকরা। চাং শা শহরে অতীত ও বর্তমান সহাবস্থান করে। এখানে পুরনো ও নতুন, ইতিহাস ও আধুনিকতার সম্মিলন ঘটেছে।
আকাশে চাং শা তারকা আছে, মাটিতে একটি চাং শা নগরী আছে। তিন হাজার বছর আগে থেকে মানুষ চাং শায় বসবাস শুরু করেছিল। দু হাজার বছর আগের নগরী এখন শহরের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক সড়কে পরিণত হয়েছে। চাং শা সহনশীল একটি শহর। এখানে আপনি যেমন দেখতে পাবেন হান রাজবংশ আমলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা তরুণ-তরুণীদের, তেমনি দেখতে পাবেন ট্রেন্ডি পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের। সহনশীল ও প্রাণবন্ত এ শহরে সবাই নিজের পছন্দের জিনিস পেতে পারে।
চাং শা হচ্ছে ইউনেস্কো-নির্বাচিত চীনের প্রথম মিডিয়া ও সংস্কৃতির শহর। সংস্কৃতি ও পর্যটন ক্ষেত্রে চীনের প্রথম দফার দৃষ্টান্ত-শহরও এটি। এখানকার টিভি স্টেশন ও প্রকাশনা শিল্প খুব বিখ্যাত এবং চাং শা চীনের নির্মাণ যন্ত্রপাতির শহর। এ শিল্পের উত্পাদন টানা ১৩ বছর চীনের প্রথম স্থানে রয়েছে। চাং শা জাদুঘরের প্রধান চৌ হুই ওয়েন এমনভাবে নিজের শহরের বর্ণনা করেন -- চাং শা একদিকে হাজার বছরের ইতিহাস থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের পানে ছোটে।
হাজার বছর আগের বিখ্যাত জেনারেল কুয়ান ইউয়ু চাং শার একটি জায়গায় সৈন্য ও ঘোড়া মোতায়ন করেছিলেন। তাই এ জায়গার নাম হয়ে যায় মা লান শান, বা ঘোড়া রেলিং পাহাড়। বর্তমানে মা লান শান সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি জাতীয় পর্যায়ের দৃষ্টান্ত-শিল্প পার্ক। ভিডিও নির্মাণ এ সংক্রান্ত শিল্পে জড়িত ৩৪০টি কোম্পানি এখন এখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং ২০২৩ সালে মা লান শানের ভিডিও সংস্কৃতি ও সৃজনশীল শিল্প পার্কের উত্পাদন মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ইউয়ান, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। এখানে ৫০ হাজার কর্মীর গড় বয়স ২৭ বছরের কম। কোনও ডিপ্লোমা বা যোগ্যতা ছাড়া যে কেউ এখানে নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারে। প্রত্যেক প্রতিভাবান যুবককে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ইউয়ান পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তাদের জন্য মঞ্চ গড়ে তোলা হয়।
চাং শা একটি ইন্টারনেট সেলিব্রিটি শহরও। এখানে জন্ম নেওয়া নানা ব্র্যান্ড ইন্টারনেটে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দুধ চা, মিষ্টি ও রেঁস্তোরাসহ চীনে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের জন্ম চাং শায়। চাং শার লিও ইয়াং এলাকা চীনের আতশবাজির শহর। প্রতি সপ্তাহে চাং শায় শত আতশবাজির শো হয়। এটিকে আতশবাজি গালা বলা হয়। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আতশবাজি শো সবার মনে গভীর ছাপ ফেলে আর ওই আতশবাজিগুলো সব লিও ইয়াংয়ে উত্পাদিত। লিউ ইয়াং চীন এমন কি গোটা বিশ্বের আতশবাজি উত্পাদনের সর্বোচ্চ মানের প্রতিনিধিত্ব করে।
থাং রাজবংশের আমল থেকে চাং শার চীনামাটির বাসন বিদেশে রপ্তানি হতো। আফ্রিকার উত্তর পর্যন্ত অন্তত ৩০টি দেশে রপ্তানি হতো এসব বাসন। এখন চাং শা উন্মু্ক্তকরণের শহরও। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে চাং শার বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি ইউয়ানে। চলতি বছরের ২৯ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত চাং শায় অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় চীন-আফ্রিকা অর্থ-বাণিজ্য প্রদর্শনী। এর মাধ্যমে সেখানে চীন ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার হয়।
চাং শার একটি চা দোকানের মালিক মো শেং নিজেকে নতুন চাং শার মানুষ বলে আখ্যায়িত করেন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে তিনি তার অংশীদারের সঙ্গে চাং শায় তাদের প্রথম দোকান খোলেন। মো শেন উত্তর-পূর্ব চীনের মানুষ এবং বড় শহরে কাজ করতেন। এখন তিনি চাং শায় ব্যবসা করেন এবং বাস করেন, কারণ চাং শা তাকে আকর্ষণ করে। এখানে যেমন আছে ব্যবসায়িক পরিবেশ, তেমনি আছে সহনশীল সংস্কৃতি, যা মানুষ ও শহরকে গভীরভাবে যুক্ত করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন মানুষের ওপর নির্ভর করে। চাং শা মানুষ মূল্যবোধের ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়। শহরের সিপিসি কমিটির সম্পাদক উ কুই ইং বলেন, মানুষের সুখী জীবন দেশের জন্য বৃহৎ ব্যাপার। শহর কর্তৃপক্ষের আয়ের ৭০ শতাংশ ব্যয় করা হয় জীবিকা উন্নয়ন ও নিশ্চয়তায়। তিনি বলেন, “আমাদের শহরকে একটি সুখী শহর হিসাবে গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সবাই সুখী জীবনযাপন করবে।”
চাং শায় লেখাপড়া শেষ করে একটি নিউ মিডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন চেন চিং ইউয়ু। তিনি বলেন, “এখানে মানুষ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং জীবনযাপন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য পাই। আমি ও চাংশা পরস্পরকে বাছাই করেছি।”
কেন চাং শায় থাকেন - যদি এ শহরের যুবকদের কাছে এমন প্রশ্ন করা হয়, তাহলে প্রায়ই এমন উত্তর পাওয়া যাবে, এখানে অংশীদার খুঁজে পাওয়া যায় এবং যুবকের উন্নয়নের জন্য এ শহর ভাল পরিবেশ ও নীতি-সহায়তা প্রদান করে। সবাই সমান সুযোগ ও প্রচুর সম্পদ উপভোগ করে।
বসবাস, কাজ ও ভ্রমণের জন্য উপযোগী একটি শহর চাং শা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে চাং শার জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরে সেখানকার জনসংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার বেড়েছে। যুবকরা বিশ্বাস করে, এ শহরে তারা নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এবং এ শহর যুবকের কারণে আরও প্রাণবন্ত হতে পারে।
চাং শা শহরে সিয়াং চিয়াং নামে একটি নদী আছে। এই শহরে সিয়াং চিয়াং নদী হাজার বছর আগের মতোই প্রবাহিত হচ্ছে; তবে প্রতিটি ঢেউ নতুন।