ইউননান প্রদেশে চীন-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল এবং ইউনান ও তিব্বতের সংযোগ-এলাকায় অবস্থিত একটি তুলং জাতির থানা। থানায় কয়েক হাজার তুলং জাতির বাসিন্দা থাকেন। তুলং জাতিঅধ্যুষিত এলাকা ছিল চীনের একমাত্র এলাকা, যেখানে কোনো সড়ক ছিল না। দীর্ঘকালা বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বলে, তুলং জাতির অঞ্চলকে চীনে ইউননানের 'সর্বশেষ গোপন জায়গা' বলে ডাকা হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে তুলং জাতি ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে চাষ করত। তাঁদের জীবন আগে খুবই কঠিন ছিল। তুলং জাতির লোকসংখ্যা খুবই কম এবং তাদের থাকার পরিবেশ ছিল খুব খারাপ। একসময় গোটা জাতিই বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়েছিল।
তুলংচিয়াং থানার জীবনযাত্রার মানও খুবই নিম্ন ছিল। প্রতিবছরের নভেম্বর থেকে পরের বছরের মে মাস পর্যন্ত তুষারের কারণে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকত।
তুলং জাতির উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা ছিলো খারাপ পরিবহনব্যবস্থা। তুলং জাতির মানুষ পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে। সেখানকার পরিবহন-ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ১৯৯৯ সালে তুলংচিয়াং থানা ও কংশান জেলার মধ্যে একটি ছোট সড়ক চালু হয়। কিন্তু থানা থেকে জেলায় হেঁটে যেতে দশ দিনেরও বেশি সময় লাগতো। গ্রামগুলোর মধ্যে দূরত্ব কম, কিন্তু পাহাড়ি এলাকা বিধায়, এক গ্রাম থেকে অন্য এক গ্রামে যেতে কয়েক দিন লেগে যেতো। শিশুরা প্রতিদিন খুবই বিপজ্জনক পাহাড়ি সড়ক অতিক্রম করে স্কুলে যেতো। প্রতিটি সেতু বা নদীর উপরে অবস্থিত কেবলের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। একটু অসাবধান হলেই নদীতে পড়ে যাবার আশঙ্কা।
অবশ্য, গত বিংশ শতাব্দীর ৯০-এর দশকে তুলংচিয়াং থানার পরিবহন-ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কংশান জেলা ও তুলংচিয়াং থানার মধ্যে সড়ক-যোগাযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। তুলংচিয়াং সড়কে হেইফু সুড়ঙ্গ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটার উঁচুতে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। প্রতিবছর তুষারপাতের সময় সুড়ঙ্গের দুই মুখ বন্ধ হয়ে যেতো। মাখু গ্রামের বাসিন্দা মেং জে ইউন বলেন, ‘আগে তুষার পড়লে সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে যেতো। একদিন আমি সকাল আটটায় বাইরে গিয়ে ভোররাত ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে ঘরে ফিরতে পেরেছিলাম।‘
২০১৪ সালে হেইফু সুড়ঙ্গ আনুষ্ঠানিকভাবে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে তুলংচিয়াং থানা থেকে কংশান জেলায় যেতে মাত্র দুই ঘন্টা লাগে। তথন থেকে বিভিন্ন পণ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিভাবান ব্যক্তি এ সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে তুলং থানায় এসেছেন, যাতে স্থানীয় উন্নয়নে নতুন চালিকাশক্তি সৃষ্টি করা যায়। কংশান জেলার সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট কাও দ্য রং বলেছিলেন, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও বাইরে সহজে যাওয়া হলো তুলং জেলার হাজার হাজার বছরের স্বপ্ন।
মাখু গ্রামের বাসিন্দা থাং স্যিয়াও ছং জানান, ছোটবেলায় তিনি কখনও টেলিভিশন দেখেননি। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। তিনি বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ছোটবেলায় বাইরে যাওয়ার কোনো চিন্তাও তার ছিল না। বর্তমানে তিনি নতুন অ্যাপার্টমেন্টে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তিনি নিজের ছোট দোকান খুলেছেন। বর্তমানে তাঁর বার্ষিক আয় প্রায় ১ লাখ ইউয়ান আরএমবি। তিনি তার বর্তমান জীবন নিয়ে সুখী।
২০১৮ সালে তুলং জাতি সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়। এখন তাদের জন্য সরকারের নির্মিত জনবসতি মোট ২৬টি; অ্যাপার্টমেন্ট মোট ১০৬৮টি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাসের অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এছাড়াও, স্থানীয় পৌর সরকার বাসিন্দাদেরকে গৃহের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র সরবরাহ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা থাং স্যিয়াও ছং বলেন, তাঁর ছেলে একটি সুন্দর ও সুখী বাড়ি পেয়েছে।
তুলংচিয়াং থানার শিশুরা তাঁদের পিতামাতার মতো কঠিন জীবন কাটাবে না। আগে তুলংচিয়াংয়ে একটিমাত্র প্রাথমিক স্কুল ছিল। প্রাথমিক স্কুল থেকে পাস করে ৯০ কিলোমিটার দূরের কংশান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের যেতে হতো। শিশুরা বছরে মাত্র একবার বাড়ি ফিরতে পারতো। কোনো কোনো শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে প্রাণও হারিয়েছে।
কাও দ্য শেং তুলং জাতির শিক্ষা-উন্নয়নের সাক্ষী। তিনি ছিলেন তুলংচিয়াং থানার কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের প্রধান। এখন তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। ৩০ বছর আগে বাইরে কাজ করতেন কাও দ্য রং। তার ভাই তাঁকে জন্মস্থানে ফিরে শিক্ষার উন্নয়নে অংশ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ও তাঁর ভাই তখন বাইরের উচ্চ বেতনের চাকরি ত্যাগ করে জন্মস্থানে ফিরে আসেন। তিনি আজীবন তুলং জাতির শিক্ষা-উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করে, শিক্ষা হল জাতির আশা।
বর্তমানে তুলংচিয়াংয়ে নয় বছর বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়া হয়। এ জন্য প্রয়োজনী বিদ্যালয় নির্মিত হয়েছে।
৭০ বছরে তুলংচিয়াং থানায় বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় শিল্প চেইন গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়। অর্থনীতি উন্নয়নের পাশাপাশি বাসিন্দাদের বসবাসের পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। শিক্ষা ও চিকিত্সার মান অনেক উন্নত হয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনের পথে তুলং মানুষ পরিবেশ সুরক্ষার ওপরও গুরুত্ব দেয়। তাঁরা 'পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি উন্নয়ন, উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা' –এই ধারণায় বিশ্বাস করেন।