দেহঘড়ি পর্ব-০৩২
2023-08-20 18:49:27

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

বেল’স পোলজির ভালো দাওয়াই টিসিএম

বেল’স পোলজি এমন একটি সমস্যা যা মুখের একপাশের পেশীতে হঠাৎ দুর্বলতা সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ দুর্বলতা অস্থায়ী এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যেতে শুরু করে। বেল’স পোলজির কারণে মুখের অর্ধেক অংশ পক্ষাঘাতপ্রস্ত হয়, যার ফলে ওই অংশ ঝুলে পড়ে এবং অন্য অংশ থেকে নিচু হয়ে যায়। এটা হলে মুখের এক পাশে দিয়ে হাসা যায়, কিন্তু আক্রান্ত পাশ দিয়ে যায় না। এছাড়া আক্রান্ত পাশের চোখও বন্ধ করা যায় না।

বেল’স পোলজি এক ধরনের নিউরোপ্যাথি যা মুখের পেশীকে দুর্বল করার মাধ্যমে পক্ষাঘাত সৃষ্টি করে। এটি ইডিওপ্যাথিক ফেসিয়াল প্যারালাইসিস নামেও পরিচিত। বেল’স পোলজি হঠাৎ করে দেখা দেয় এবং এক বা দুই দিনের মধ্যে আরও খারাপ হয়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেল’স পোলজির কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে মাথার কোনও অংশে প্রদাহ সৃষ্টিকারী সংক্রমণ বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ার কারণে এটি হয় বলে মনে করা হয়। এমন প্রদাহ বা সংক্রমণের কারণে সপ্তম ক্রানিয়াল স্নায়ুতে রক্ত প্রবাহের অভাব হয়।

প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ বেল’স পোলজিতে আক্রান্ত হয়। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় সমস্যায়। শ্বাসযন্ত্রের উপরের অংশের সমস্যা এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেল’স পোলজিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে যে কোনো বয়সে এবং যে কারোর এটা হতে পারে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেল’স পোলজি সময়ের সাথে সাথে এমনিই সেরে যায়। এর জন্য কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটা স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে, যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাকি জীবন মুখের দুর্বলতা বয়ে বেড়াতে হতে পারে।

মুখের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থায় সাধারণত প্রিডনিসোন স্টেরয়েড গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা (টিসিএম) ও আকুপাংচার বেল’স পোলজি নিরাময়ের একটি নিরাপদ ও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি। যারা স্টেরয়েড এড়াতে চান তাদের জন্য এটি সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

বেল’স পোলজি হলে সপ্তম ক্র্যানিয়াল নার্ভের প্রদাহ মুখের একটি অংশের পেশী নিয়ন্ত্রণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা মুখের পক্ষাঘাত হলে প্রথমেই প্রাথমিক স্ট্রোক পরীক্ষার নির্দেশিকাগুলো মেনে বোঝার চেষ্টা করুন স্ট্রোকের কারণে সেটা হয়েছে কিনা। যদি স্ট্রোকের লক্ষণ না থাকে, তাহলে বোঝার চেষ্টা করুন বেল’স পোলজির লক্ষণ আছে কিনা। বেল’স পোলজির প্রধান প্রধান লক্ষণ হলো: মুখের দুর্বলতা বা মুখের পক্ষাঘাত, যা পুরো মুখ বা মুখের একটি অংশকে প্রভাবিত করে; মুখের একপাশ ঝুলে যাওয়া; অল্প জ্বর; মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা; আক্রান্ত পাশের কানের পিছনে ব্যথা; ঘাড় শক্ত হওয়া; এক চোখ বন্ধ করতে না পারা; মুখ দিয়ে লালা ঝরা; স্বাদ বোধ নষ্ট হওয়া; এবং একদিকে শব্দের প্রতি অধিক সংবেদনশীলতা। কখনও কখনও মুখের ফোলা স্নায়ু থেকে ব্যথা হতে পারে। তবে বেল’স পোলজির কারণে তীব্র ব্যথা হয় না।

টিসিএম তত্ত্বে, যে কোনও রোগের জন্য শরীরের উপর প্রভাব ফেলা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্যাথোজেন বা রোগজীবাণুকে দায়ী করা হয়। বেল’স পোলজিকে বায়ু ও ঠান্ডার আক্রমণের ফল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এমন আক্রমণ মাথা ও মুখমণ্ডলের মধ্য দিয়ে মূল জীবন শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্তের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। ‘ছি’ হলো এমন একটি শক্তি যা শরীরকে বাহ্যিক রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করে, কিন্তু মানসিক চাপ, ক্লান্তি, ঠান্ডা বাতাস সরাসরি মুখে প্রবাহিত হওয়া বা সাম্প্রতিক অসুস্থতার কারণে যদি ‘ছি’ দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে বাতাসের আক্রমণে এটা পরাস্ত হতে পারে।

টিসিএমে বেল’স পোলজির সামগ্রিক নিরাময়ের বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে প্রধান ভেষজ প্রতিকার, আকুপাংচার ও ভিটামিন সম্পূরক। এ রোগের চিকিৎসার জন্য একজন সনদপ্রাপ্ত টিসিএম বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত, যাতে শারীরিক লক্ষণভেদে প্রত্যেক রোগীকে সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রটোকল দেওয়া যায়।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

বিশ্বসেরা টিসিএম হাসপাতাল থিয়ানচিনে

থিয়ানচিন টিসিএম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষণ হাসপাতাল ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি চীনের উত্তরাঞ্চলীয় থিয়ানচিন শহরের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম টিসিএম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। উৎকৃষ্ট মানের সেবার কারণে এ হাসপাতালটি নানা মর্যাদা অর্জন করেছে এবং নানা অভিধায় অভিহিত হয়েছে। যেমন এটি চীনের প্রথম ধাপের ট্রিপল-এ গ্রেডের হাসপাতাল, চীনের একশত উন্নত হাসপাতালের একটি, ন্যাশনাল হেলথ সিস্টেমের উন্নত হাসপাতাল এবং চীনের নির্ভরযোগ্য মডেল হাসপাতাল। এছাড়া, এটি আকুপাংচার ও মক্সিবাস্টন বিষয়ক ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ন্যাশনাল রিজিওনাল মেডিক্যাল সেন্টার এবং টিসিএমের ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বেইস।

মোট ৩৮ দশমিক ৩৮ একর এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ২ হাজার ৬শ’। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে আর বছরে ভর্তি করা হয় ৬৫ হাজারেরও বেশি রোগীকে। মোট ৪৩টি ক্লিনিক্যাল ও টেকনিক্যাল বিভাগ রয়েছে এ হাসপাতালে।

এ হাসপাতালে মোট কর্মীর সংখ্যা ২ হাজার ৬শ’র বেশি, যাদের মধ্যে রয়েছেন চীনের প্রকৌশল একাডেমির দুইজন শিক্ষাবিদ, টিসিএমের তিনজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, জাতীয়ভাবে বিখ্যাত পাঁচজন টিসিএম চিকিৎসক, পাঁচজন ছিহুয়াং স্কলার, দুইজন তরুণ ছিহুয়াং স্কলার এবং রাষ্ট্রীয় পরিষদের বিশেষ ভাতাভোগী ১৯জন বিশেষজ্ঞ। এছাড়াও রয়েছেন বেশ ক’জন জ্যেষ্ঠ টিসিএম বিশেষজ্ঞ, থিয়ানচিন মিউনিসিপ্যাল সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত পাঁচজন বিশেষজ্ঞ এবং থিয়ানচিনের ২৭ জন বিখ্যাত টিসিএম চিকিৎসক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি উদ্ভাবন দল এবং ৪৪ জন ডক্টরাল সুপারভাইজার এবং ২১২ জন স্নাতকোত্তর সুপারভাইজার কর্মরত এখানে।

গণস্বাস্থ্য প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া এ হাসপাতালে সম্মিলন ঘটেছে রোগপ্রতিরোধ, চিকিত্সা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার। এটি টিসিএম চিকিৎসার অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান হলেও পশ্চিমা চিকিৎসার উপর সমান জোর দেয়। ফলে এখানে অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার। এ সমন্বিত পদ্ধতিতে এ হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া হয় স্ট্রোক, করোনারি হৃদরোগসহ বিভিন্ন কঠিন ও জটিল রোগের। এ হাসপাতালের অধ্যাপক শি সুয়েমিন সূচিত ‘সিং নাও খাই ছিয়াও থেরাপি’ আকুপাংচার ও মক্সিবাস্টনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। ‘সিং নাও খাই ছিয়াও থেরাপি’ হলো মস্তিষ্ক সক্রিয় করা এবং মস্তিষ্কের ছিদ্রগুলো পরিস্কার করার চিকিৎসা। এই চিকিৎসা পদ্ধতি থিয়ানচিনের এই হাসপাতালকে শুধু চীনের নয়, গোটা বিশ্বের নেতৃস্থানীয় টিসিএম হাসপাতালে পরিণত করেছে।

 

#ভেষজের গুণ

ঔষধি গুণে ভরা আমেরিকান জিনসেং

অন্যান্য জিনসেংয়ের মতো আমেরিকান জিনসেংয়েও রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। এ ভেষজ ডায়াবিটিস, ক্যান্সার ও ফ্লু প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সাহায্য করে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মনোযোগে অসুবিধা দূর করে।

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান জিনসেং টাইপ-২ ডায়াবিটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়। খালি পেটে ও ভরা পেটে উভয় ক্ষেত্রে গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর সক্ষমতা রয়েছে এ ভেষজের। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবিটিসে আক্রান্তদের মধ্যে যারা অধিক চিনিযুক্ত পানীয় গ্রহণের আগে বা গ্রহণের সময় আমেরিকান জিনসেং গ্রহণ করেছেন তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম বাড়ে। ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে আমেরিকান জিনসেংয়ের ফল এর শিকড়ের চেয়ে বেশি কার্যকর।

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে টিউমারের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকান জিনসেং। কোলোরেক্টাল ক্যান্সার কোষ নিয়ে পরিচালিত আরেক গবেষণায় গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, শক্তিশালী ক্যান্সার-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে আমেরিকান জিনসেংয়ে।

অন্য দুটি গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, যারা জিনসেং থেকে উৎপাদিত কোল্ড এফএক্স গ্রহণ করেছেন, তাদের প্লেসিবো নেওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় কম ঠান্ডা লেগেছে। এবং যারা সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের উপসর্গগুলো প্লাসিবো গ্রহণকারীদের তুলনায় কম স্থায়ী হয়েছে।

কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, আমেরিকান জিনসেং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বেশ কিছু ক্লিনিকাল গবেষণা বিজ্ঞানীদের এ বিশ্বাসকে সত্যি প্রমাণ করেছে। ওইসব গবেষণা দেখা গেছে, আমেরিকান জিনসেং কোষের কর্মক্ষমতা বাড়ায়, যা প্রকারন্তরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।