পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের ফুটবল স্বপ্ন
2023-08-16 14:36:25

ছিন পা পাহাড়ের ভেতরে শ্যানসি প্রদেশের হান চুং শহরের উ কুয়ান ই উপজেলার কেন্দ্রীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় হলেও খেলার মাঠে ফুটবল প্রশিক্ষণ চলছে। স্কুলের সামনে জেলা সড়ক। সেখানে গাড়ির গতি ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটারের নীচে থাকতে হয়। স্কুলের পেছনে রয়েছে নতুন নির্মিত একটি মহাসড়ক।

ফুটবল ভালবেসে গেল ১০ বছরে এ স্কুলের শিশুদের একের পর এক দল মাটির মাঠ থেকে সিমেন্টের মাঠ এবং শেষে সবুজ ঘাসের মাঠ পর্যন্ত ফুটবল খেলেছে। এ প্রক্রিয়ায় তারা আনন্দময় শৈশব পেয়েছে এবং শক্ত শরীর ও সাহস অর্জন করেছে। এমনকি কেউ কেউ ফুটবল খেলার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হয়েছে।

উ কুয়াং ই উপজেলার জনসংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার এবং সেখানে প্রায় প্রতিটি শিশু ফুটবল খেলে এবং সেখানকার সব স্কুলে ফুটবল ক্লাস চালু রয়েছে।ক্রীড়ার মাধ্যমে ছোট গ্রামের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন বাস্তবায়নের অনুশীলন চলছে এখানে।

খেলার মাঠের আয়তন সীমিত। তাই ফুটবল মাঠ চলে এসেছে স্কুলের দরজা পর্যন্ত। স্কুলে প্রবেশ করলে বিভিন্ন স্লোগান লেখা দেখা যায় সেখানে। এগুলোর বিষয় ফুটবলের মাধ্যমে শারিরীক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নৈতিক চরিত্রের বিকাশ। প্রতিদিন স্কুল শেষ হবার পর এক ঘন্টার মতো ফুটবল প্রশিক্ষণ চলে এখানে। এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি কখনো। স্কুলের প্রধান চাং সু ছুন নিজে বাচ্চাদেরকে শিক্ষা দেন। ছোট ছোট শিশুরা একটি লাইনে দাঁড়ায় এবং মূল কসরত শেখে। পাহাড়ি অঞ্চলের রোদ প্রখর। ৪৮ বছর বয়সি চাং সু ছুন লম্বা এবং তার শরীর রোদে পাকা। তার ছোট ভাই ৪৬ বছর বয়সী চাং সু ইয়াং লিউ পা মাধ্যমিক স্কুলের কমিউনিস্ট পার্টি কমিটির সম্পাদক। লিউ পা জেলার ফুটবল খেলা এই ভাইয়ের উদ্যোগে শুরু হয়।

আঠারো বছর বয়সী ছাং সু ছুন নোরমাল স্কুল থেকে স্নাতক হবার পর গ্রামে ফিরে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি সঙ্গে কেবল তিনটি ফুটবল নিয়ে আসেন; আর কিছুই না। তিনি ফুটবল খেলতে পছন্দ করেন এবং তার মতে ফুটবল হলো স্বাধীন ও মুক্তির ক্রীড়া। ওই সময় তার বাড়ির শিশুদের জন্য ফুটবল একটি অপরিচিত খেলা ছিল। চাং সু ছুন মনে করেন, শিশুরা খুব কর্মচঞ্চল, তাই তাদেরকে ফুটবল খেলা শেখালে তা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হবে।

একই সময়ে তার ছোট ভাই চাং সু ইয়াংও মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে চাং সু ইয়াং শিশুদেরকে নিয়ে দশ-বারো কিলোমিটারের মতো হাটাঁহাঁটি করেন এবং রাতে তারা দেখতে যান। দুই ভাই বলেন, ওই সময় তারা তরুণ ও শিশুদের সঙ্গে থাকতে আনন্দ বোধ করেন।

২০০৯ সালে নতুন স্কুলে যান চাং সু ছুন। ২০০৮ সালের বড় ভূমিকম্পের পর স্কুলের নতুন খেলার মাঠ বৃষ্টিতে নষ্ট হয়। তবে মাটি কর্দমাক্ত হলেও ফুটবল খেলা ছাড়েনি শিশুরা।

২০১১ সালের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় হান চুং শহরে অনুষ্ঠিত হয় তরুণ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। চাং সু ছুনের স্কুলে তখন মাত্র ২০০জন শিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্য থেকে ৩২জনকে নিয়ে মেয়ে ও ছেলে দুটি দল গঠন করা হয়। ওই সময় লিউ পা জেলায় প্রথম বারের মতো তরুণ ফুটবল দল গঠিত হয়। তরুণ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের সময় বৃষ্টি হয়। ওই অবস্থায় চাং সু ছুনের শিক্ষার্থীরা কর্দমাক্ত মাঠিতে ভাল খেলে। এমনকি বুটছাড়া খালি পায়ে ফুটবল খেলে তারা। এখনও চাং সু ছুনের কাছে ওই সময়ের একটি গ্রুপ ছবি সংরক্ষিত আছে। সেখানে সবার শরীর কাদায় ঢাকা হলেও মুখে লেগে আছে হাসি।

পরে ওই স্কুলে নির্মিত হয় পাকা মাঠ। এ মাঠের ওপর পড়লে বেশ আঘাত লাগে। নিজেদের রক্ষা করতে শিশুরা হাঁটুতে প্যাড এবং লম্বা-হাতা পোশাক পরে। পাশাপাশি চাং সু ছুন কোচ হিসেবে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনি পুরনো একটি ল্যাপটপ নিয়ে আসেন, যেটা দিয়ে শিশুদেরকে ভিডিও দেখান এবং সে ভিডিও অনুসরণ করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন।

প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রামের এই ফুটবল দল নিজেদের মর্যাদা বাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে চাং সু ছুনের নেতৃত্বে বাচ্চারা প্রথম বারের মতো প্রাদেশিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পাহাড়ি অঞ্চলের বাচ্চার বুট সম্পর্কেও জানতো না। তবে এক একটি দল পরাজিত করে তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে। যদিও তারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে, তবুই শিশুদের নিয়ে গর্বিত চাং সু ছুন। তিনি বলেন, ওই বারই তারা প্রথম বারের মতো প্রাদেশিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং সবাই এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়ে যে, কী করতে হবে বুঝতে পারছিল না তারা। তবে তারা যে সর্বোত্তম চেষ্টা করেছে সেটাই যথেষ্ট বলে মনে করেন চাং সু ছুন।

ওই অভিজ্ঞতা থেকে চাং সু ছুন বুঝতে পারেন যে, ফুটবল খেলার দক্ষতা বাড়াতে চাইলে বাইরে আরও বেশি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। তখন থেকে চাং শিশুদেরকে নিয়ে বাইরে যেতে সব সুযোগই কাজে লাগান।

একবার শীতকালীন ছুটির সময়ে তারা প্রতিযোগিতা অংশ নিতে নান চিং শহরে যান। বসন্ত উত্সবের ভিড়ের কারণে ট্রাফিক জ্যাম ছিল, যেকারণে প্রতিযোগিতার স্টেডিয়ামে পৌঁছেতে তাদের ভোর ৪টা বেজে যায়। বাচ্চারা যাতে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে সেজন্য আয়োজকরা প্রতিযোগিতা দু ঘন্টার মতো পিছিয়ে দেন।

গেল কয়েক বছরে চাং সু ছুন শিশুদের নিয়ে কুই চৌ, ছিং হাই, সিছুয়ান, লিয়াও নিংসহ নানা প্রদেশ গেছেন। তাদের যত্ন নিতে তিনি ট্রেনে সারা রাতে জেগে থাকেন।

নিজ নিজ ঘরে ফেরার পর প্রতিটি শিশু তাকে ফোন করার পরই কেবল তার অস্থিরতা দূর হয়। ফূটবল ছাড়াও তিনি শিশুদের নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানানোর চেষ্টা করেন।

২০১৩ সালে তিনি শিশুদের নিয়ে ৩০ ঘন্টার ট্রেন যাত্রা করে ছিন হুয়াং তাও শহরে যান প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে এবং তারপর তিনি নিজের খরচে শিশুদের নিয়ে সৈকতে যান এবং তাদেরকে সীফুড খাওয়ান। তিনি বলেন, ওই শিশুদের মা-বাবা অন্য শহরে কাজ করেন বলে এদেরকে নিয়ে মা-বাবার ভ্রমণ করার সুযোগ খুব কম। তাই সুযোগ হলে তিনি বাচ্চাদেরকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন।

২০১৪ সালে লিউ পা মাধ্যমিক স্কুলে চালু হয় ফুটবল ক্লাস এবং পেশাদার কোচ নিয়োগ করা হয়। চাং সু ছুন নিজের শিক্ষার্থীদের তার ছোট ভাইয়ের হাতে তুলে দেন এবং মাধ্যমিক স্কুলে তাদের ফুটবল প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকে।

লিউ পা জেলা মেয়ে ফুটবল দল অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায়ের ফাইনাল প্রতিযোগিতার একমাত্র জেলা পর্যায়ের দল। জাতীয় পর্যায়ের কয়েকজন যুবক ও তরুণ খেলোয়াড় আছে এ দলে। প্রায় ৩০০জন শিক্ষার্থী জাতীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শতাধিক ছেলে-মেয়ে চীনের বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ফুটবল পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে।

তু ছিং সিয়া তাদের একজন। চাং সু ছুন তাকে বাছাই করে নিজের স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। নতুন স্কুল তার বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমটার দূরে ছিল। তাই সে মাঝে মাঝে বাড়িতে ফিরতে পারতো না। চাং সু ছুন বাবার মতো তার যত্ন নিতেন। প্রতি শুক্রবার তাকে বাস স্টেশনে পৌঁছে দিতেন এবং তার বাস ভাড়া পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। রোববার বিকেলে আবার সে স্কুলে ফিরে আসতো। অনেক শিশু থাকলেও চাং সু ছুন একইভাবে প্রত্যেকের যত্ন নেন।

দু বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তু ছিং সিয়া প্রথমে প্রাদেশিক দলে এবং পরে জাতীয় যুব দলে যোগ দেন। গত বছর তিনি থুং চি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি বলেন, “শিক্ষক চাংয়ের সাহায্য ছাড়া আমি ফুটবলার হতে পারতাম না আর আমার জীবন এরকম হতো না।”

চাং সু ছুন বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে যারা হাইস্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি, তারা আর পাহাড়ের বাইরে যেতে পারে না। তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। তাই তিনি যখন ফুটবল খেলোয়াড় বাছাই করেন, বেশি সংখ্যক মেয়েকে নিতে চান।

তেইশ বছর বয়সি লি চিয়া হাও শিক্ষক চাংয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে বেরোনোর পর এখন তিনি একজন ক্রীড়া ডেটা বিশ্লেষক হয়েছেন। তিনি বলেন, কয়েক বছরের ফুটবল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি আরও দৃঢ়, সাহসী ও আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্কুল ফুটবল জনপ্রিয় হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে লিউ পা জেলা ফুটবল ও এর সহায়ক শিল্প উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে। জেলার কেন্দ্রস্থল থেকে গাড়িতে করে ১ ঘন্টা সময় লাগে ইং পান নামের একটি গ্রামে যেতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেখানকার উচ্চতা দেড় হাজার মিটার এবং সেখানে রয়েছে ৬টি ফুটবল প্রশিক্ষণ মাঠ এবং একটি স্ট্যান্ডার্ড মাঠ। ফুটবল মাঠের পাশে নির্মিত হয়েছে ৮টি অ্যাপার্টমেন্ট ও দু’টি রেস্টুরেন্ট। সর্বোচ্চে ৫-৬শ জন এখানে বাস করতে ও খেতে পারে। গ্রামের প্রধান জানান, নদীর সৈকতের ওপর এসব অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং দেশের নানা জায়গা থেকে ফুটবল দল এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। এটি এই গ্রাম এমনকি এই জেলার নতুন একটি শিল্প।

ফুটবল মাঠের অদূরে বসবাসকারী লিও পাও পিং তার স্বামীর সঙ্গে একটি পরিবারিক হোটেল খুলেছেন। উচ্চতার কারণে গ্রীষ্মকাল হলেও এখানকার তাপমাত্রা মাত্র ২০ ডিগ্রি। একবার চীনের জাতীয় নারী ফুটবল দল এখানে প্রশিক্ষণ নেয় এবং সে সুযোগে তিনি তার প্রিয় কোচ সুই ছিং সিয়াকে দেখতে পারেন। লিও পাও পিং বলেন, “ফুটবল শুধু আমাদের আয় বৃদ্ধি করেছে তা নয়, অনেক প্রিয় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতেরও সুযোগ করে দিয়েছে।”

ইং পান ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসেছে জাতীয় নারী দল, শাংতুও ও শাং হাইয়ের মেয়ে ফুটবল দলসহ ২০০টি দল। এখানে প্রাদেশিক ও শহর পর্যায়ের ৩০টি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আগত ফুটবলার ও পর্যটকের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি।

চাং সু ইয়াং বলেন, “নতুন ফুটবল মাঠ আরও বেশি দলকে আকর্ষণ করে এবং অন্য দলের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রতিযোগিতার সুযোগ আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বাইরে যেতে হতো। এখন তারা এখানে আসেন।”

অনেক কিছুতে পরিবর্তন এলেও অনেক কিছু আগের মতোই রয়েছে। চাং সু ইয়াং আগের মতো ব্যাগে নানা টেস্ট পেপার নিয়ে ফুটবল মাঠে আসেন। শিশুরা ওখানে প্রশিক্ষণ নেয় আর সে ফাঁকে তিনি ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রশিক্ষণ শেষ হলে শিশুদেরকে অন্য প্রয়োজনীয় ক্লাস নেন। চাং সু ইয়াং মনে করেন, ফুটবলের জন্য লেখাপড়া ত্যাগ করা উচিত না। যদি শিশুরা আর ফুটবল খেলতে চায় না, তাহলে তারা লেখাপড়ার মাধ্যমে ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারে।

২০১৯ সালে ৩৬ বছর বয়সী চাও হাই এ প্রাথমিক স্কুলের উপ-প্রধান হন। তিনিও চাং সু ছুনের সঙ্গে কাজ করেন। চাং সু ছুনের উৎসাহে এ বছরে চাও হাই ফুটবল কোচের সনদ পেয়েছেন। নিজের মেয়েকেও এ স্কুলে নিয়ে আসেন এবং তাকে ফুটবল খেলা শেখান। চাং হাই বলেন, মেয়ে ভাল ফুটবল খেলতে পারুক বা নাই পারুক, তিনি আশা করেন এ খেলার মাধ্যমে তার মেয়ে খানিকটা শক্তি অর্জন করতে পারবে।(শিশির/রহমান/রুবি)