গ্রীষ্মের ছুটিতে চীনের বিভিন্ন জাদুঘরে কিশোর-কিশোরীরা
2023-08-14 15:01:48

বর্তমানে চীনা ছাত্রছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। ছুটিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, ক্রীড়া বা খেলাধুলা করা, শরীরচর্চা করা, এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা চীনা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ প্রচলিত। গরম আবহাওয়ায় বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শনী দেখাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন প্রদেশের জাদুঘরে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ছুটিতে বাচ্চাদের নতুন বিনোদনের পদ্ধতি এটি। চীনা ছাত্রছাত্রীরা কেন জাদুঘরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয় নিয়ে কথা বলবো।

 

অতীতে জাদুঘর ছিল কেবল বড়দের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। বিশেষ করে, যারা বিশেষ জ্ঞান বা তথ্য নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে জাদুঘরে যাওয়ার প্রবণতা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে, বর্তমানে জাদুঘরে ঘুরে বেড়ানো চীনাদের জন্য একটি সাধারণ ব্যাপার। চীনের সি’আন শহরের পাথর স্টেলসের জাদুঘর খোলার পর ব্যাপকভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ১১ বছর বয়সের ছেলে মা ইউয়ে ছেনও নানীর সাথে জাদুঘরে বেড়াতে এসেছে। নানী লিউ ছিন মনে করেন, বাচ্চাদের জন্য জাদুঘরে ছুটি কাটানো একটি ভালো পদ্ধতি, কারণ এখানে বিভিন্ন ধরনের সভ্যতার ইতিহাস রয়েছে; ভিন্ন ধরনের জাদুঘরে গেলে ভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়, যা বাচ্চাদের জন্য বেশ ভালো।

 

গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে হ্যনান প্রদেশের জাতীয় জাদুঘর প্রায় প্রতিদিনই ভর্তি থাকে। দৈনিক দর্শকের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। এ সংখ্যা ২০১৯ সালের একই সময়ের প্রায় দ্বিগুণ।

 

চীনের চিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী সুচৌ শহরের জাদুঘরের উপপ্রধান সুন মিং লি বলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলাকালে প্রতিদিন সকাল ৮টায় পরের ৭ দিনের টিকিট বুকিং খোলা হয়। তবে, কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব টিকিট বুকিং হয়ে যায়। দর্শকদের চাহিদা মেটাতে এখন জাদুঘরের খোলা থাকার সময়ও রাত ৯টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

 

চীনের হ্যপেই প্রদেশের তিংচৌ জাদুঘরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের মোট সংখ্যা ৫০ হাজারটিরও বেশি। জুলাই মাসে এখানে পরিদর্শকের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার পার্সনটাইমস, যা ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে ১৮৬ শতাংশ বেশি।

 

চীনের শানতোং জাদুঘরের প্রধান লিউ ইয়ান ছাং মনে করেন, এখন জাদুঘরের প্রতি আকর্ষণ একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জুলাই মাসের সাপ্তাহিক ছুটিতে তাদের জাদুঘরে দর্শকের সংখ্যা ২০ হাজার জনেরও বেশি ছিল, যা গত কয়েক মাসের চেয়ে অনেক বেশি। লিউ বলেন, দর্শকদের চাহিদা মেটাতে তাদের জাদুঘরের দক্ষ কর্মীরা পালাক্রমিকভাবে বিভিন্ন প্রদর্শনী হলে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন এবং প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার সকালে জাদুঘরের একজন কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বক্তৃতাস্থলে উপস্থিত থাকেন। পরে তাঁরা ‘জাদুঘর রাত’ বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন  করেন। এভাবে ছুটির দিনে আরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে আকর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। জাদুঘরের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন জাদুঘরের সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল পণ্য শিল্পের উন্নয়নও দ্রুত উন্নত হচ্ছে।

 

এবারের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নানচিং জাদুঘর ১০ ধরনের বিশেষ পণ্য তৈরি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জাদুঘরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের ছবি বা ডিজাইনসহ নোটবুক, জাদুঘরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ আকারের ধাতুর বুকমার্ক। প্রতিদিন এসব পণ্য প্রচুর বিক্রিও হচ্ছে।

 

সংবাদদাতাদের জরিপ থেকে জানা গেছে, জাদুঘরের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি একটি সাময়িক ব্যাপার নয়, বরং বিভিন্ন ফ্যাক্টরের প্রভাবে সৃষ্ট ফলাফল। প্রথমত, চীনাদের ঐতিহ্যিক সভ্যতার প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। জীবনমান উন্নয়নের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিনোদনের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

 

চীনের শানতোং প্রদেশের চিনান শহরের একজন শহরবাসী ইয়ু শাও জিং বলেন, তিনি সাংস্কৃতিক মেলা ও প্রদর্শনীর অনুরাগী। বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় স্থানীয় জাদুঘর তাঁর জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটি স্থান। জাদুঘরে দাঁড়িয়ে অতীতের লোকদের বাস্তব জীবনকে অনুভব করা যায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ ও পুরাকীর্তির মাধ্যমে বাস্তব চিন্তাভাবনা ও প্রাচীনকালে লোকদের চেতনা উপলব্ধি করা যায়। মানবজাতির উত্স নিয়ে অনেক কৌতুহল রয়েছে ইয়ুর। তাই তিনি কয়েক হাজার বছরের আগের তথা প্রাচীনকালের শাং আর চৌ আমলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ প্রদর্শনী দেখতে বেশি পছন্দ করেন।

 

জাদুঘর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টিকারী সেতুর মতো। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিফলন। চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাগারের প্রধান লিন লিউ মনে করেন, জাদুঘরের জনপ্রিয়তার মূল কারণ চীনাদের সাথে ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কারণে চীনের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যিক সভ্যতার পুনরুত্থানের স্বাক্ষী হয়েছেন লোকেরা এবং আরো বেশি চীনা জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে চীনা সভ্যতার আমেজ অনুভব করতে চাচ্ছেন। চীনা জাতির সৃজনশীলতার সুন্দর প্রতিফলন এটি।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের ফলে, বিভিন্ন জাদুঘরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণাও বেড়েছে এবং এ সম্পর্কে গবেষণার ধরণ ও বিষয়ও বাড়ছে। চীনারা এ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

 

চলতি বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটি কোভিড মহামারীর পর প্রথম লম্বা ছুটি। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পের কর্মসূচিতে জাদুঘর পরিদর্শন একটি স্বাভাবিক বিষয়। এ সম্পর্কে সি’আন পাথর স্টেলস জাদুঘরের পর্যটক গাইড চাং লিন বলেন, এপ্রিল মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তিনি বুকড হয়ে আছেন।

 

লিয়াওনিং প্রদেশের জাতীয় জাদুঘরের উপপ্রধান তং পাও হৌ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দৈনিক পরিদর্শকের সংখ্যা বিশ্লেষণ করেন। এ সময় বাচ্চাদের সংখ্যা অনেক বেশি। মোট দর্শকের ৩০ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে শিশু-কিশোর। তাঁরা পরিবার বা স্কুলের শিক্ষকদের সাথে জাদুঘরে আসে। এখানে বিভিন্ন প্রদর্শনীর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শিশু-কিশোরদের চাহিদার কথা মাথায় রাখা হয়।

 

হ্যনান জাদুঘরে নব্যপ্রস্তরীয় যুগের হাড়ের বাঁশ, খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭০ সালের ব্রোঞ্জ চিমসহ বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ প্রদর্শন করা হয়। জাদুঘরের সংগীত হলে প্রাচীনকালের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ও আওয়াজ উপভোগ করা যায়। এ সংগীত হলে সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের নমুনা অনুসারে নতুন বাদ্যযন্ত্র কপি করা হয়। এটা কেবল প্রাচীন সংগীত বাজাতে পারে তা নয়, বরং তা দিয়ে আধুনিক সুরও বাজানো যায়।

 

থ্রিডি এবং এআর গ্লাসের মাধ্যমে প্রাচীনকালের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষকে আরও ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শকরা। কিভাবে দশর্কদের চাহিদা মেটানো যায়? এটি প্রতিটি জাদুঘরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে জাদুঘরে ঘুরে বেড়ানো হবে চীনাদের জীবনের একটি সাধারণ ব্যাপার। ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরের মোট সংখ্যা ১ লাখ ৪০০০টিরও বেশি ছিল। ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত চীনে জাদুঘরের মোট সংখ্যা ৬৫৬৫টি। বলা বাহুল্য, এ সংখ্যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তবে, লোকসংখ্যা বিবেচনা করলে প্রতি ১০ লাখ নাগরিকের জন্য একটি জাদুঘর যথেষ্ঠ নয়। জাদুঘরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা একটটি সুখবর। তবে, দর্শকদের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা একটি চ্যালেঞ্জ। দর্শকদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি, জাদুঘরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের স্বার্থ দেখাও এক্ষেত্রে জরুরি।

 

চীনের শানতোং প্রদেশের ছেংউ জেলার জাদুঘরে পূর্ব হান রাজবংশের সুবিখ্যাত শিল্পী ছাই ইয়োংয়ের ক্যালিগ্রাফি আর শিলালিপি প্রদর্শন করা হয়। এ জাদুঘরের প্রধান কুও লি বলেন, চীনা নাগরিকদের মধ্যে সুপরিচিত জাদুঘর ছাড়া, ছোট আকারের জাদুঘরগুলোও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আকর্ষণীয় প্রদর্শনী ডিজাইন করার মাধ্যমে আরও বেশি দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে।

 

চীনের হ্যপেই জাদুঘরের সামাজিক শিক্ষা বিভাগের পরিচালক লিউ ওয়ে হুয়া মনে করেন, ভবিষ্যতে জাদুঘর ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের সম্ভাবনা ব্যাপক। যেমন, প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী জাদুঘর নির্মাণ করা হবে, যাতে আরও বেশি লোক অবাধে জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যৌথভাবে আরও তাত্পর্যপূর্ণ ও প্রভাব বিস্তারকারী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে, যাতে জাদুঘরের সংস্কৃতির সম্প্রচার ও প্রভাব বাড়ানো সম্ভব হয়।

 

তবে, জাদুঘর একটি দর্শনীয় স্থানের মতো দেখার ব্যাপার নয়। শুধু সেখানে যাওয়ার জন্য যাওয়া ঠিক নয়। জাদুঘর পরিদর্শনের আগে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কিছু গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। এভাবে জাদুঘর দর্শন আরও সার্থক হতে পারে।

 

আরেকটি কথা, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো এড়ানো ভালো। কারণ, তখন ভিড় বেশি থাকে। বিশ্বের সকল দেশে প্রতি সপ্তাহের সোমবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। তাই, সোমবারও জাদুঘরে যাওয়া সম্ভব নয়। সপ্তাহের বাকি ৪টি কর্মদিনকে জাদুঘরে যাওয়ার জন্য বেছে নেওয়া যেতে পারে।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)