মনে হচ্ছে, আমেরিকার অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের ওপর কলঙ্ক লেপনের ‘মহাপরিকল্পনা’ এঁটেছেন।
এই বৃহস্পতিবার একটি তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানে, বাইডেন চীনা অর্থনীতিকে ‘বিস্ফোরণোন্মুখ টাইম বোমা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। নিঃসন্দেহে বেশ আকর্ষণীয় উপমা! তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা বিশ্বে যে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, যে কেউ বিপরীত উপসংহারেও আসতে পারেন।
প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বর্তমানে গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, যার উদাহরণ ফিচ রেটিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান সূচকের অবনমন। ফিচ গত দুই দশকে অন্যান্য নেতৃস্থানীয় অর্থনীতির তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ‘শাসনের ক্ষয়’কে এই অবনমনের জন্য দায়ী করেছে।
ফিচের বক্তব্যের প্রতিধ্বনিত করে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল উল্লেখ করেছে যে, ফিচের অবনমনের একটি কারণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মোকাবেলায় কোনো রাজনৈতিক ইচ্ছার অনুপস্থিতি।
যখনই অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়, তখনই যুক্তরাষ্ট্র সবার মনোযোগ সরাতে চীন-বিরোধী নানা নেতিবাচক তত্ত্ব প্রচার শুরু করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পুরনো কৌশল।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ব্যর্থতার সাম্প্রতিক তরঙ্গ পর্যন্ত, ইতিহাস ইঙ্গিত দেয় যে ‘আঙ্কেল স্যাম’ ক্রমাগতভাবে একটি ‘স্ফুলিঙ্গ’ হিসেবে বিরাজ করছেন- যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ভূমিকা রেখে চলেছে।
এটা অস্বীকার করবার কিছু নয় যে, চীনা অর্থনীতি বর্তমানে রপ্তানি ও বিনিয়োগ হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্ত বাধা সত্ত্বেও, চীন অন্যদের দোষারোপ না করে বরং সমস্যা সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এরইমধ্যে, বেইজিং তার বাজারের সম্ভাবনা উন্মোচন করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এর প্রবৃদ্ধির গতিপথ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বছর জুড়ে, চীনের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্মণ দেখাচ্ছে। বছরের প্রথমার্ধে দেশের জিডিপি ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ প্রধান উন্নত অর্থনীতির তুলনায়, চীন শুধুমাত্র দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার অবদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বও প্রদর্শন করে। বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে উচ্চ আশাবাদ পোষণ করছে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হিসেবে চীনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিশ্বের দুটি বৃহৎ অর্থনীতি হিসাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে জোরদার করার জন্য একটি সম্মিলিত দায়িত্ব রয়েছে।
দুঃখজনকভাবে, চীন প্রশান্ত মহাসাগরের ওপার থেকে যা পেয়েছে তা কোনো সহযোগিতামূলক হাত নয়, বরং কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং নানা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ। ‘ডিরিস্কিং’ বা ‘ঝুঁকিমুক্তকরণ’ এই শব্দের আড়ালে অন্যান্য দেশকে চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্ররোচিত করে আসছে ওয়াশিংটন।
আধিপত্য বজায় রাখার এবং নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো ওপায়ে চীনকে আটকানোর নীতি নিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন এবং শিল্প নেটওয়ার্কের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আর যুক্তরাষ্ট্রের এই অপকৌশলই বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে একটি বিপদজ্জনক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্ট একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে যে, ওয়াশিংটন ‘ঝুঁকি কমানোর কথা বলে আসলে ঝুঁকিতে ফেলছে তার নিজের এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে। তার তথাকথিত ‘ঝুঁকিমুক্তি’র পদক্ষেপগুলো ‘বিশ্বকে নিরাপদ নয়, বরং আরও বিপজ্জনক করে তুলছে’।
বিশ্ব অর্থনীতি একটি বিচ্ছিন্ন নদী নয়, একটি বিস্তৃত এবং আন্তঃসংযুক্ত সমুদ্রের মতো, যেখানে কোনও জাতি বিচ্ছিন্নভাবে উন্নতি করতে পারে না। দোষারোপের খেলায় লিপ্ত হওয়া এবং শুধুমাত্র চীনের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন কূটকৌশল তার নিজের অর্থনীতিত এবং এরইমধ্যে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির সমস্যাগুলোকে কমাবে না বরং আরও বাড়িয়ে তুলবে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।