চিন রাজার ইউয়ান জয়ের গল্প
2023-08-11 19:03:31

"লুই শি ছুন ছিউ" চীনের যুদ্ধযুগের একটি মহান কাজ। এর দার্শনিক চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, এবং সংরক্ষিত বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক তথ্য চীনা জাতির একটি মূল্যবান ঐতিহ্য। এতে চিন রাজ্যের রাজা ওয়েন কং-এর গল্প লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি যুদ্ধ না-করেই অন্যদের পরাজিত করেছেন এবং আন্তরিকতা ও সততার সাথে ইউয়ান শহর জয় করেন।

চিন ওয়েন কং (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৯৭–খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৮) চীনের বসন্ত ও শরতের সময়কালে চিন রাজ্যের শাসক ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই উচ্চ নৈতিক চরিত্র এবং প্রতিভাবান মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে পছন্দ করতেন। চিন ওয়েন কংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু তিনি খুব সহজ ও মিতব্যয়ী জীবন যাপন করতেন। তাঁর কথাবার্তা মার্জিত ছিল। তিনি আচার-আচরণে ছিলেন খুবই ভদ্র ও বিনয়ী। সিংহাসনে আরোহণের পর, তিনি সক্রিয়ভাবে অভ্যন্তরীণ রীতিনীতি সংস্কার করেন, গুণী ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন, করমুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, কৃষি ও বাণিজ্য উন্নয়নে উত্সাহিত করেন, জনগণের উত্পাদন ও জীবনের জন্য উপকারী নীতি গ্রহণ করেন এবং জনগণকে আন্তরিকতা ও সততার শিক্ষাদান করেন।

তিনি "অন্য রাজ্যকে সদগুণ দিয়ে জয় করা এবং বর্বরদের সামরিক শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার নীতি" অবলম্বন করেছিলেন। তিনি সম্রাট চৌ শিয়াং ওয়া’কে সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছিলেন। চিন ওয়েন কং’কে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য, সম্রাট চৌ শিয়াং ওয়াং ইউয়ানসহ চারটি স্থান চিন রাজ্যকে প্রদান করেন। চিন ওয়েন কং সম্রাট চৌ’র ইচ্ছা অনুসারে এই অঞ্চলগুলো গ্রহণ করেন। কিন্তু ইউয়ান অঞ্চল আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক ছিলো না, তাই চিন ওয়েন কং সৈন্য নিয়ে ইউয়ান অঞ্চল আক্রমণ করেন। চিন ওয়েন কং ৭ দিনের মধ্যে ইউয়ান জয় করবে বলে সৈন্যদের সাথে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ৭ দিন পরেও, ইউয়ান জয় করা যানি। তাই চিন ওয়েন কং সৈন্যদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সৈন্যরা ভেবেছিল যে, ইউয়ান খুব শীঘ্রই আত্মসমর্পণ করবে। চিন ওয়েন কং বলেন, "বিশ্বস্ততা হল সেই ধন, যা মানুষকে রক্ষা করে। ইউয়ান পাওয়ার জন্য সে ধন হারালে জনগণকে কী দিয়ে রক্ষা করা যাবে? অতএব, প্রতিশ্রুতি ভাঙা একেবারেই চলবে না।" তাই তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে চলে যান। দ্বিতীয় বছরে, চিন আবার ইউয়ান আক্রমণ করেন। এবার চিন ওয়েন কং এবং তাঁর সৈন্যরা এই মর্মে একমত হন যে, ইউয়ান জয় না করা পর্যন্ত তারা ফিরবেন না। ইউয়ানের লোকেরা যখন এই কথা শুনে, তখন তারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। ওয়েই রাজ্যের জনগণ চিন ওয়েন কংয়ের ইউয়ান জয় করার কথা জানার পরে ভেবেছিল যে, চিন ওয়েন কং-এর কৃতিত্ব সত্যিই চরমে পৌঁছেছে, তাই তারাও চিনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এটাকেই মানুষ বলে "ইউয়ান জয় করার পর ওয়েই পাওয়া"। প্রথমবার ইউয়ান আক্রমণ করার সময় চিন ওয়েন কং কি ইউয়ান জয় করতে চাননি? অবশ্যই চেয়েছেন। কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মূল্যে ইউয়ান জয় করতে চাননি। এ থেকে দেখা যায় যে চিন ওয়েন কং নিজের প্রতিশ্রুতিকে কতো গুরুত্ব দিতেন।

প্রাচীন চীনারা যুদ্ধের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিল এবং বেশিরভাগই প্রতিরক্ষামূলক রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করত। "ছুন শু জি ইয়াও” গ্রন্থের মধ্যে রাজনীতি অংশে বলা হয়েছে: "যারা যুদ্ধ পছন্দ করে তাঁরা ধ্বংস হবে; যারা যুদ্ধ সম্পর্কে জানে না, তাঁরা বিপদে পড়বে; যারা যুদ্ধ পছন্দ করে না কিন্তু যুদ্ধ সম্পর্কে জানে, তারাই বিশ্বনাথ।" এর মানে, যারা যুদ্ধের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রাখে না এবং যুদ্ধকে উপেক্ষাও করে না, তারাই বিশ্ব জয় করবে। সুন জি বলেছিলেন: "যুদ্ধ, সৈন্য এবং নাগরিকদের জীবন ও মৃত্যুর, দেশের টিকে থাকা বা ধ্বংস হওয়ার সাথে সম্পর্কিত একটি প্রধান বিষয় এবং এটি সাবধানে বিবেচনা করতে হবে।” অতএব, প্রাচীন চীনারা বিশ্বাস করত যে, সবচেয়ে আদর্শ যুদ্ধ হল "লড়াই না করে শত্রুকে পরাস্ত করা", অর্থাত রক্তপাত ছাড়াই জয়লাভ করা। এটি করার জন্য, মহান জাতীয় শক্তি ও প্রশংসনীয় পুণ্য অপরিহার্য। কিছু লোক মনে করতে পারেন যে, কেবলমাত্র একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীই যথেষ্ট। তবে, যুদ্ধের মাধ্যমে যে বিজয় অর্জন করা যাবে, তা কেবলমাত্র যুদ্ধের বিজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; জনগণের হৃদয় জয় না-করতে পারলে যুদ্ধের দামামা বন্ধ হবে না।

একটি আন্তর্জাতিক নৈতিকতা হিসাবে "বিশ্বস্ততা"-র অর্থ হল, দেশগুলোকে অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বিনিময়ে অনেস্ট ও বিশ্বস্ত হতে হবে। প্রতিশ্রুতি মুখ থেকে বের হলে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং কাজ শুরু করলে শেষ করতে হবে। এটি চীনা সংস্কৃতির একটি মৌলিক নৈতিক ধারণা। বসন্ত ও শরতের সময়কালে, সকল রাষ্ট্র যুদ্ধের সময় কিছু অলিখিত আইন মেনে চলতো। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধ ঘোষণা না-করে অন্য দেশ আক্রমণ করা হতো না। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ কখন হবে, কোথায় হবে, যুদ্ধের নিয়মকানুন কী হবে—এসব ব্যাপারে দু’পক্ষ একমত হয়েই যুদ্ধে নামতো। যুদ্ধ ঘোষণার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতো: প্রথমে অন্য পক্ষের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে হবে; তারপর যুদ্ধের জন্য শত্রুপক্ষের কাছে দূত পাঠাতে হবে; এবং অবশেষে সম্মত তারিখে যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধের নীতি অনুসারে, "সৈন্যদের ড্রামের সাথে অগ্রসর হওয়া", "একটি বাহিনী সারি গঠনের আগে আক্রমণ করা যাবে না","একই পারিবারিক উপাধির দেশগুলোকে ধ্বংস করা যাবে না" "দূতদের হত্যা করা যাবে না", "বন্দীদের হত্যা করা যাবে না", ইত্যাদি। কিন্তু বসন্ত ও শরত্কালের শেষে, রাজ্যগুলোর উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রসার ও ঐতিহ্যগত আচার ব্যবস্থার পতনের ফলে, যুদ্ধের এসব আইন ধ্বংস হয়ে যায়। "হান ফেই জি" গ্রন্থে বলা হয়েছে: "যুদ্ধে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়"। যুদ্ধরত সময়কালে, দেশগুলো ষড়যন্ত্র ও ধূর্ততার মাধ্যমে বিজয় লাভ করতে থাকে এবং "বিশ্বাসের" আন্তর্জাতিক নৈতিকতাকে আর অনুসরণ করা হতো না। কিন্তু একজন জ্ঞানী রাজা অশান্ত পরিবেশেও "বিশ্বস্ততার" মূল্য ও ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেন। (ইয়াং/আলিম/ছাই)