কম্পিউটার গেমস, আসক্তি, সন্তান, ও পিতামাতা
2023-08-07 17:01:00

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা তথা কাওখাও-এর জন্য প্রস্তুতির স্বার্থে এক বছর ইন্টারনেট গেমস খেলেনি এবং তাঁর খেলার অ্যাকাউন্ট ঠিক রাখতে তাঁর মা সবসময় তাঁর পক্ষে অনলাইনে গেমস খেলেছেন। ফলে, এখন তাঁর মা তাঁর চেয়েও ভালো কম্পিউটার গেমস খেলেন। কাওখাও পরীক্ষার পর ছেলে খেয়াল করে যে, তার অ্যাকাউন্টের মান মায়ের সাহায্যে অনেক উন্নত হয়েছে। সেই ভিডিও পোস্ট করার পর অনেকে এমন মন্তব্য করেন: “আহা! যদি আমার বাবা বা মায়ের সাহায্যে আমিও তোমার মতো পরিশ্রমের সাথে লেখাপড়া করতাম!”

বস্তুত, এটি কেবল একটি উদাহরণ মাত্র। এ থেকে বোঝা যায়, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের গেমস আমাদের জীবনে কতোটা সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি বিষয়। নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ নতুন পরিবেশে মধ্যবয়সী পিতামাতা এবং গেমসে আসক্ত শিশু-কিশোরদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবো।

 

বস্তুত, গত বছরের শেষ দিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কিশোর-কিশোরী অধিকার বিভাগ এবং চীনের ইন্টারনেট তথ্যকেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে চীনা শিশু-কিশোরদের  ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন রচনা করা হয়। ২০২১ সালে চীনের ১৮ বছর বয়সের নিচে এবং ৬ বছরের উপরে ছাত্রছাত্রীদের মোট সংখ্যা ১৯.১ কোটি জনেরও বেশি ছিল, যাদের মধ্যে ৯৬.৮ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ৯০.৭ শতাংশ মোবাইল ফোন দিয়ে ইন্টারনেট সার্ফিং করে।

 

মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিজেদের বাচ্চাদের সহজে আসক্ত হবার আশঙ্কা নিয়ে সচেতন অনেক বাবা-মা। প্রতিবছরের গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ছুটিতে বাচ্চাদে মোবাইল ফোন দেখা বা গেমস খেলা নিয়ে বিভিন্ন পরিবারে অশান্তি দেখা দেয়। অনেক বাবা-মা বলেন, তাদের বাচ্চার হাতে মোবাইল ফোন থাকলে, সে সারদিন শান্ত থাকে, মোবাইল ফোন নিয়ে নিলেই সে ঝামেলা শুরু করে।

 

ইন্টারনেটে গেমস অ্যাকাউন্ট উন্নতে করতে সাহায্যকারী পিতামাতা শিশু-কিশোরদের কাছে প্রিয় বাবা-মা। চীনের ইউথ পত্রিকার সংবাদদাতা অনেক বাচ্চা ও তাদের পিতামাতার মধ্যে জরিপ পরিচালনা করেছেন। তিনি কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে গেমস খেলা নিয়ে পিতামাতা ও বাচ্চাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন।

 

সাক্ষাত্কারের সময় তিনি খেয়াল করেন যে, যেসব বাবা-মা ১৯৮০ সালের আগে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে গেমস খেলা নিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি উদ্বিগ্ন। আর যেসব বাবা-মা ১৯৮০ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা বাচ্চাদের কম্পিউটার গেমস খেলা নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম উদ্বিগ্ন; তাঁরা এক্ষেত্রে অনেক শিথিল। ম্যাডাম চাং ছিয়ান তাঁদের মধ্যে একজন।

 

তিনি ও তাঁর স্বামী দু’জন ১৯৮০ সালের পর জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে বাড়িতে গেম কনসোল ব্যবহার করেছেন তাঁরা। দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এবং বর্তমানে তাদের চাকরি ও জীবনমান মোটামুটি ভালো। বাচ্চাদের কম্পিউটার গেমস খেলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের ছোটবেলায় এমন গেমস খেলেছি। আমাদের জীবন ও পড়াশোনার ওপর গেমসের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তাই, আমি কেন আমার বাচ্চাকে গেমস খেলতে নিষেধ করবো?”

 

কেউ কেউ মনে করেন, ছোটবেলা থেকে বাচ্চাকে কম্পিউটার গেমস খেলতে দেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। এতে বাচ্চারা সহজে কম্পিউটারে আসক্ত হতে পারে। তবে, যেসব পিতামাতার গেমস সম্পর্কে ধারণা রয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে কম্পিউটার গেমস খেলা ও চলচ্চিত্র দেখার মধ্যে বড় পাথর্ক্য নেই। এখন অনেক বাচ্চার মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ার মূল কারণ গেমস নয়, বরং পিতামাতা অবহেলা এর জন্য দায়ী। পিতামাতা খেলার সময় নিয়ন্ত্রণ করেন না বলে এমনটা হতে পারে। যদি পিতামাতা বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সময় ঠিক করে দেন, এবং বাচ্চাকে পরামর্শ দেন, তবে তারা গেমসে আসক্ত হবে না।

 

পিতামাতা যদি সঠিকভাবে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে গেমস খেলার বিষয়টি দেখেন, তাহলে সেটি বাচ্চার জন্য সুখবর। কারণ, তারা আরও সহজে বাচ্চাদের খেলার আগ্রহ বুঝতে পারেন। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যদি পিতামাতা মোবাইল ফোনকে ভয় না করেন এবং সন্তানের খেলার সময় নির্দিষ্ট করে দেন, তাহলে আর কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে, পারস্পরিক সমঝোতা হবে পারিবারিক শিক্ষার ভিত্তি। বাচ্চাদের সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিওয়া জরুরি।

 

অনেক বাচ্চার চিন্তাধারায় গেমস ইতিবাচক প্রভাবও ফেলে।  ছেলে উ চুন বলে, ছোটবেলায় একটি গেমস খেলার পর ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ তাঁর অনেক বেড়েছে। কারণ, ছোটবেলা থেকে সে বাবা-মায়ের সাথে একটি কম্পিউটার গেমস খেলেছে, যে গেমসে দুটি সামরিক জোটের লড়াইয়ের গল্প আছে। এ থেকে ইতিহাস সম্পর্কে জানার কৌতুহল তার বেড়েছে। প্রাথমিক স্কুল থেকেই ইতিহাস নিয়ে তার পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু হয়। মাধ্যমিক স্কুলের পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে বিভিন্ন ধরনের ইতিহাসের বই পড়ে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি পড়ার পাশাপাশি চীন ও বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য ও ধারণা পেয়েছে সে।

 

তাঁর পিতামাতা কম্পিউটার গেমসের ব্যাপারে কোনো বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। ফলে ছেলে উ চুন গেমস খেলার মাধ্যমে ইতিহাস সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানতে পেরেছে, অথচ খেলার প্রতি আসক্ত হয়নি।

 

এ সম্পর্কে চীনের যুব গবেষণাকেন্দ্রের গবেষক সুন হং ইয়ান বলেন, জরিপ থেকে জানা গেছে, গেমস খেলতে পছন্দ করে, এমন বাচ্চাদের প্রতিক্রিয়া হয় তুলনামূলকভাবে দ্রুত, বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও তাঁরা এগিয়ে থাকে।

 

আধুনিক কম্পিউটার গেমস প্রযুক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানের সাথে জড়িত জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। গেমসের মধ্যে কয়েক শ বছরের আগের ঐতিহাসিক গল্প থাকে এবং গেমস খেলার মাধ্যমে কম্পিউটার সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়। কিছু কিছু গেমসের গল্প বেশ আকর্ষণীয়, যা নাটক ও উপন্যাসের চেয়েও মজাদার।

 

বাচ্চাদের খেলাধুলা পছন্দ। তাদের এ থেকে বিরত রাখা অসম্ভব ব্যাপার। ইতিবাচক পরামর্শ ও নির্দেশনায় তারা খেলার মাধ্যমে আরও অনেক জ্ঞান ও তথ্য জানতে পারে। একসাথে কম্পিটার গেমস খেলার মাধ্যমে পিতামাতা ও বাচ্চাদের সাথে সম্পর্কও ঘনিষ্ঠতর হতে পারে। নির্ধারিত সময়ের জন্য বাচ্চার সাথে গেমস খেলা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় নয়, বরং এক ধরনের সমঝোতা। এভাবে বাবা-মা বাচ্চাদের চেতনা ও মনে প্রবেশ করতে পারেন।

 

অনেক পিতামাতা বুঝতে পারেন না যে, সমঝোতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া হবে শিক্ষার পূর্বভিত্তি। যখন বাচ্চারা গেমস খেলতে শুরু করেন, তারা পরামর্শ দিতে চান। সবসময় বাচ্চাদের এ জন্য বকাঝকা করলেই বরং তাদের গেমসে আসক্ত হবার আশঙ্কা বাড়ে। বাচ্চাদের সাথে পিতামার সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কাও আছে এক্ষেত্রে।

 

বস্তুত, অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের কাছ থেকে অনেককিছু আশা করেন। তারা চান সন্তান তাদের সব কথা শুনুক। কিন্তু বাস্তবে এমনটা সম্ভব নয়। বাচ্চাদের তাদের প্রিয় গেমস খেলা থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। তবে, তাদের সময় বেধে দেওয়া সম্ভব। তা ছাড়া, খেলায় রাখতে হবে যে, গেমসে ক্ষতিকর কিছু আছে কি না। চীনের শিক্ষা বিজ্ঞান গবেষণাগারের গবেষক ছু চাও হুই বলেন, পিতামাতা ও সন্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের দক্ষতার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই পার্থক্য রয়েছে। যেটা পিতামাতার জন্য সহজ, সেটা সন্তানের জন্য সহজ নাও হতে পারে। পিতামাতাকে বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে।

 

ছেলে ছুই চৌ পিং এখন বড় হয়েছে। ছোটবেলায় সে সবসময় কম্পিউটার গেমস খেলতো। সাধারণত রাত ৯টা থেকে গেমস খেলা শুরু করতো সে এবং শেষ করতো পরের দিন ভোরে। মাধ্যমিক স্কুল থেকে তাঁর গেমস খেলা শুরু হয়। তখন বাবা-মা এ ব্যাপার নিয়ে তার সাথে ঝগড়া করতেন। কিন্তু সে বাবা-মায়ের কথা না-শুনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গেমস খেলার অভ্যাস বজায় রাখে। এ কয়েক বছর বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্ক খুবই খারাপ ছিল।

 

গেমস ডিজাইন করার সময় সেগুলোকে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা থাকে। তাই, বাচ্চারা গেমস খেলতে শুরু করলে সহজে থামতে পারে না। আত্মনিয়ন্ত্রণের দক্ষতা দুর্বল এমন বাচ্চাদের জন্য তা আরো কঠিন। তবে বাচ্চাদের খেলা বা গেমস পছন্দ করা স্বাভাবিক। বাবা-মায়ের কাজ বাচ্চাকে আসক্ত হতে না দেওয়া। শুধু গেমসের ব্যাপারে নয়, অন্য যে কোনো কাজে আসক্তি খারাপ ব্যাপার। আসক্তি এক ধরনের মানসিক সমস্যা। যদি বাবা-মা শুধু বকাঝকা করেন, সমালোচনা করেন, তাতে কাজ হবে না।

 

বাবা-মাকে বাচ্চাদের সাথে গেমস খেলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে, বাবা-মা গেমসসম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। এতে বাচ্চা বাবা-মায়ের প্রতি বেশি সন্তুষ্ট থাকবে। সন্তানকে বুঝতে দিতে হবে যে, তাঁর পছন্দের বিষয়টি তাঁরাও গুরুত্ব দেন; তবে, বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

 

মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের কথা শোনা হবে বাবা-মায়ের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। যদি বাচ্চাদের সাথে আদান-প্রদান করতে চান, তাহলে বাচ্চাদে ৮০ শতাংশ কথা বলতে দিন এবং শুধু ২০ শতাংশ কথা নিজে বলু। বকাঝকা করার চেয়ে এটা বেশি কার্যকর।

 

গবেষক ছু মনে করেন, মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের কথা শোনা মানে বাচ্চাদের সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এভাবে পিতামাতা ও বাচ্চার মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। কম্পিউটার গেমস পিতামাতা ও বাচ্চার মধ্যে সুসম্পর্কের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়, বরং একে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে সন্তানের সাথে পিতামাতার ভাব বিনিময় হবে।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)