দেহঘড়ি পর্ব-০৩০
2023-08-06 15:19:49

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

ল্যারিঞ্জাইটিস সারে টিসিএমে

ল্যারিঞ্জাইটিস এমন একটি রোগ যাতে আক্রান্ত হলে স্বরযন্ত্র ফুলে যায় এবং প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কোভিড-নাইনটিনের মতো ভাইরাল সংক্রমণ, কণ্ঠের অত্যাধিক ব্যবহার, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, পরিপাক ব্যবস্থা থেকে অ্যাসিড উঠে আসে, ধূমপান এবং অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসার কারণে সাধারণত ল্যারিঞ্জাইটিস হয়। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণেও ল্যারিঞ্জাইটিস হতে পারে। কণ্ঠের ব্যবহার যারা বেশি করেন, তাদের মধ্যে এই রোগের হার বেশি। কেন্দ্রীয় শীতাতপ বা উষ্ণায়ন ব্যবস্থা এ রোগকে খারাপ করতে পারে। ল্যারিঞ্জাইটিস সাধারণত সপ্তাহখানেক স্থায়ী হয় এবং এটা গুরুতর কোন সমস্যায় রূপ নেয় না, তবে যতদিন থাকে বেশ ভালই ভোগায়।

ভয়েস বক্স নামে পরিচিত ল্যারিঙ্কস বা স্বরযন্ত্রে থাকে ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রী। এগুলো শ্বাস নেওয়া, গেলা ও কথা বলার জন্য অত্যাবশ্যক। ভোকাল কর্ড হলো তরুণাস্থি ও পেশীকে আবৃত করা শ্লেষ্মা ঝিল্লির দুটি ছোট ভাঁজ, যার কম্পনের মাধ্যমে শব্দ সৃষ্টি হয়।

ল্যারিঞ্জাইটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের হয় এবং মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। এটি শিশুদেরকেও প্রভাবিত করতে পারে, এবং পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এটি আরও গুরুতর হতে পারে। কারণ তাদের স্বরযন্ত্র ছোট ও সরু। এসব ক্ষেত্রে স্বরযন্ত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ল্যারিঞ্জাইটিসের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রদাহ, ফুলে যাওয়া, চুলকানি, গলা বসে যাওয়া, কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া, ক্রমাগত কাশি, জ্বর এবং গলা পরিষ্কার করার তাগিদ অনুভব করা।

চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি বা টিসিএমে মনে করা হয়, ফুসফুসকে আক্রমণকারী ঠান্ডা, তাপ বা বিষাক্ত পদার্থ, ফুসফুসে জমা কফ এবং ফুসফুসে ঠান্ডা শক্তি ইয়িনের অভাবজনিত কারণে ল্যারিঞ্জাইটিস হয়। তবে অন্যান্য রোগজীবাণুও এর জন্য দায়ী হতে পারে।

ল্যারিঞ্জাইটিসের টিসিএম চিকিৎসা

চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সাধারণত ভেষজ ওষুধের মাধ্যমে ল্যারিঞ্জাইটিসের চিকিৎসা করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এ চিকিৎসায় আকুপাংচারও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। জানিয়ে দিচ্ছি ল্যারিঞ্জাইটিসের কয়েকটি ভেষজ ফর্মুলেশন সম্পর্কে:

বায়ু থেকে সৃষ্ট ঠান্ডার কারণে যখন ল্যারিঞ্জাইটিস হয়, তখন এর চিকিৎসায় দেওয়া হয় লিউ ওয়েই থাং; বায়ু-তাপজনিত কারণে এ রোগ হলে, সে তাপ দূর করতে দেওয়া হয় ইয়িন ছিয়াও সান; ফুসফুসের কফ-তাপ পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয় ছিং ফেই থাং; ইয়িনের ঘাটতি দূর করতে এবং ফুসফুস পরিষ্কার করতে দেওয়া হয় ইয়াং ইয়িন ছিং ফেই থাং; এবং কফ তরল করতে মূল শক্তি বা ‘ছি’র চলাচল নির্বিঘ্ন করতে দেওয়া হয় পান সিয়া হৌ ফু থাং।

 

 

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

১২০ বছরের পুরনো কুয়াংচৌ রেড ক্রস হাসপাতাল

কুয়াংচৌ রেড ক্রস হাসপাতাল চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুয়াংতুং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংচৌয়ের একটি প্রসিদ্ধ জেনারেল হাসপাতাল। প্রায় ১২০ বছর আগে ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি একটি গ্রেড-এ চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কুয়াংচৌ জরুরি হাসপাতাল এবং জিনান বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হাসপাতাল নামেও পরিচিত এই হাসপাতালটি। এটি সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান হাসপাতাল, এবং কুইচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াংচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াংতুং ফার্মাসিউটিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শানথৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের প্রশিক্ষণ হাসপাতালও।

হাসপাতালটির সদর দপ্তর কুয়াংচৌ শহরের কেন্দ্রস্থলে পার্ল নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এক হাজার ৬৫০ শয্যার এ হাসপাতালে বছরে প্রায় ১৫ লাখ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং প্রায় ৪০ হাজার রোগীকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালটি দুটে ক্যাম্পাসে বিভক্ত – ছাংকাং শাখা হাসপাতাল (যেটি ছাংকাং পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে পরিচিত) এবং কুয়াংচৌ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র (যেটি বাইয়ুন ক্যাম্পাস নামে পরিচিত)। হাসপাতালের ইন-পেশেন্ট ভবন এবং সদর দপ্তরের বিজ্ঞান ও শিক্ষা ভবনের উন্নয়নে ২০২২ সালে নতুন করে ৬০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে একটি উচ্চ-মানের ল্যামিনার ফ্লো ওয়ার্ড, ইলেকট্রনিক রেডিওথেরাপি সরঞ্জাম, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পরিদর্শন লাইন, স্বয়ংক্রিয় ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা, জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র, ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে।

চীনের দক্ষিণাঞ্চলের সেরা চিকিৎসাকর্মীদের সমাবেশ ঘটেছে কুয়াংচৌ রেড ক্রস হাসপাতালে। এখানে কর্মরত ২ হাজারেরও বেশি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মী, যাদের মধ্যে রয়েছেন রাষ্ট্রীয় পরিষদের বিশেষ ভাতাভোগী বিশেষজ্ঞ, ‘কুয়াংতুং প্রদেশের অসামান্য তরুণ চিকিৎসা প্রতিভা’, ‘কুয়াংতুং প্রদেশের বিখ্যাত টিসিএম চিকিৎসক’, কুয়াংতুং প্রদেশের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ক্ষেত্রের শীর্ষ প্রতিভা, ‘কুয়াংচৌয়ের চিকিৎসা প্রতিভা’, ‘কুয়াংচৌ উচ্চ-স্তরের প্রতিভা’সহ ৩ শতাধিক বিশেষজ্ঞ।

কুয়াংচৌ রেড ক্রস হাসপাতাল ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ক্লিনিকাল ট্রায়াল বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান, ওষুধের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ বিষয়ক জাতীয় কেন্দ্র, ক্লিনিকাল ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণ বিষয়ক জাতীয় কেন্দ্র, দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিত্সা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কেন্দ্র হিসাবেও দায়িত্ব পালন করে। এখানে রয়েছে চায়না চেস্ট পেইন সেন্টার, ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড স্ট্রোক সেন্টার, কুয়াংতুং প্রদেশের শিশু লিউকেমিয়া চিকিত্সা কেন্দ্র, কুয়াংতুং প্রদেশের মেডিকেল কসমেটোলজি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কুয়াংচৌর আঞ্চলিক জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র, কুয়াংচৌর ট্রমা ও দগ্ধ চিকিৎসা কেন্দ্র, গর্ভবতী মহিলাদের আঞ্চলিক চিকিত্সা কেন্দ্র, ইত্যাদি।

কুয়াংচৌ রেড ক্রস হাসপাতালে শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণের মান অসাধারণ। এটি জিনান বিশ্ববিদ্যালয়, শানথৌ বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াংতুং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুইচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যেখানে কর্মরত ১৫ জন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী সুপারভাইজার এবং ৬৪ জন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সুপারভাইজার।

 

#ভেষজের গুণ

রক্তপ্রবাহ বাড়ায় সিচুয়ান লাভিজ

বহুবিধ ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ সিচুয়ান লাভিজ। চীনা ভাষায় এর নাম ছুয়ানসিয়োং। এটি একটি বহুবর্ষজীবী ভেষজ, যা প্রধানত চীনের ইয়ুন-কুই-ছুয়ান মালভূমিতে জন্মায়। এই উদ্ভিদ দুই ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সিচুয়ান লাভেজের মুষ্টি-আকৃতির শিকড় ভেষজ ওষুধে ব্যবহৃত হয়।

রক্তের প্রবাহকে উদ্দীপিত করতে চিরাচরিত চীনা ওষুধ বা টিসিএমে সিচুয়ান লাভিজ ব্যবহৃত হয়। হৃদরোগ, মাসিকের সমস্যা, সিস্ট ও রক্ত জমাট বাঁধার চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত করা হয় এর শিকড়। একটি ‘উষ্ণতা দানকারী’ ভেষজ হিসাবে বিবেচিত সিচুয়ান লাভিজ শরীরের মূল শক্তি ‘ছি’র ঠান্ডা শক্তি ইয়িনের ঘাটতি দূর করে। এ ভেষজটি পিত্তথলি, লিভার ও পেরিকার্ডিয়ামের উপর প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়। এই অঙ্গগুলোকে যেহেতু আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়, তাই আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সিচুয়ান লাভিজ ব্যবহার করা হয়।

সিচুয়ান লাভেজে থাকা যৌগগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালকালয়েড, ফেনোলিক অ্যাসিড, এসেনসিয়াল তেল ও থলেইট ল্যাকটোন। মনে করা হয়, এই ভেষজে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, নিউরোপ্রোটেকশন, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেশন, অ্যান্টিফাইব্রোসিস এবং সেরিব্রোভাসকুলার প্রভাব এবং এগুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলছে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।