চীনে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’
2023-08-02 09:03:55


 

ইয়াংসি নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে একটি নতুন জ্বালানি-চালিত গাড়ি বা এনইভি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব খুচরা যন্ত্রাংশ কাছাকাছি শহরগুলোকে পাওয়া যায়। গাড়িতে এ অঞ্চল ও আশপাশের শহরের মধ্যে যাতায়াতে ৪ ঘন্টা বা তার চেয়ে কম সময় লাগে। যেমন, শাংহাই শহর গাড়ির চিপ ও সফটওয়্যার সরবরাহ করে এবং ২০০ কিলোমিটার পশ্চিমে চিয়াং সু প্রদেশের চাং চৌ শহর ব্যাটারি যোগান দেয়, ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে চ্য চিয়াং প্রদেশের নিং পো শহর সরবরাহ করে ইন্টিগ্রেটেড ডাই কাস্টিং মেশিন, যা দিয়ে গাড়ির শেল তৈরি করা হয়।

 

গাড়িনির্মাণ শিল্পে প্রতিফলিত হয়, একটি দেশ নির্মাণ-শিল্পের কতটা দক্ষতা অর্জন করেছে। নতুন জ্বালানি-চালিত গাড়ি এখন বৈশ্বিক গাড়ি শিল্প উন্নয়ন ও সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হয়ে উঠেছে। চীনের কাছে আছে এনইভি তৈরির মূল প্রযুক্তি এবং সম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থা। এনইভি উত্পাদন ও বিক্রিতে চীন টানা ৮ বছর ধরে প্রথম স্থানে রয়েছে। ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’ হচ্ছে চীনের এনইভি উত্থানের প্রতীক।

 

২০২২ সালে চীনে এনইভি উত্পাদিত হয়েছিল ৭০ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ ইয়াংসি নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে তৈরি হয়।

 

চিয়াং সু প্রদেশের চাং চৌ শহর থাই হ্রদের পাশে অবস্থিত। গেল বছরে চীনে বিক্রি হওয়া পাওয়ার ব্যাটারির এক-পঞ্চমাংশ এখানে তৈরি। চাং চৌ শহরের শিল্প ও তথ্যায়ন বিভাগের প্রধান ইয়ান ত্য ছুন জানান, যদি একটি এনইভিতে ৫০ কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ লাগে, তাহলে চাং চৌ শহর উত্পাদিত ব্যাটারি ১০ লাখেরও বেশি এনইভিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০টি গাড়িতে একটির ব্যাটারি চাং চৌ শহরে উত্পাদিত।

 

পাওয়ার ব্যাটারি তৈরিতে ৩২টি পর্যায় রয়েছে এবং ৩১টিই সম্পন্ন হতে পারে চাং চৌয়ে। এর অর্থ হলো পাওয়ার ব্যাটারি তৈরির ৯৭ শতাংশ শিল্প চেইন আছে এ শহরে। চীনের প্রায় সব বৃহৎ পাওয়ার ব্যাটারি কোম্পানির উপস্থিতি আছে চাং চৌয়ে এবং তাদের উদ্যোগে এ সংক্রান্ত সহায়ক শিল্পের ১৩০টি কোম্পানিও দ্রুত উন্নয়ন অর্জন করছে।

 

চাং চৌ শহরের স্থানীয় মানুষ গর্বভরে সবসময় ড্রিম টিমের কথা বলে। শহরের উত্তরে বিওয়াইডি এবং দক্ষিণে লি সিয়াং – এ দুটি গাড়ি কোম্পানি আছে। দুটো কারখানার মধ্যে দূরত্ব ৪০ কিলোমিটারের চেয়ে কম। ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে এ দুটি কোম্পানি ২ লাখ ৭০ হাজার গাড়ি উত্পাদন করে।

 

বৈদ্যুতিক যন্ত্র, গাড়ির বাতি, গাড়ির সাজসজ্জাসহ ১০টিরও বেশি উপখাতে ৩ সহস্রাধিক কোম্পানি এখানে মিলে ৩০ হাজার কোটি ইউয়ানের একটি শিল্প গুচ্ছ গড়ে তুলেছে।

 

জার্মান গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগেন গত শতাব্দীর ৮০’র দশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করে এবং শাংহাইতে অফিস খোলে। ওই সময় ভক্সওয়াগেনের ‘সান্তানা’ ব্র্যান্ডের গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ চীনে উত্পাদিত হতো আর কয়েক বছর পর এই হার ৯০ শতাংশ অতিক্রম করে। এই উন্নয়ন-পরিক্রমায় খুচরা যন্ত্রাংশের কোম্পানির জন্ম হতে থাকে।

 

বর্তমানে ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’র আওতায় খুচরা যন্ত্রাংশের পরিবহন ব্যয় কমেছে এবং খুচরা যন্ত্রাংশের কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের উত্পাদন পরিকল্পনা সমন্বয় করতে পারছে। এমন শিল্প চেইনের কারণে টেসলা শাংহাইয়ে সুপার কারখানা চালু করার পর ওই বছরই গাড়ি তৈরি করতে পারে। শাংহাইয়ে টেসলা গাড়ির ৯৫ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ চীনে উত্পাদিত হয়। ৩৬০টি সরবরাহকারী কোম্পানি এ কারখানার সঙ্গে যুক্ত আছে এবং এর মধ্য দিয়ে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ৭০ হাজার কোটি ইউয়ানের খুচরা যন্ত্রাংশের অর্ডার দেয় এ কারখানা। ষাটটি চীনা কোম্পানি টেসলার আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী কোম্পানির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

 

শাংহাইয়ে এনইভি শিল্প গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’। এখন ইয়াংসি নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে রয়েছে ১০টিরও বেশি এনইভি নির্মাতা কোম্পানি। পাশের চিয়াং সু প্রদেশে পাওয়ার ব্যাটারি খাতের ১৪০টি কোম্পানি আছে। চ্য চিয়াং প্রদেশে হাং চৌ বেইকে কেন্দ্র করে দ্রুত এনইভি শিল্প ক্লাস্টার গড়ে উঠছে। থাই চৌ ও ওয়েন চৌসহ উপকূলীয় শহরে গাড়ি শিল্পের রূপান্তর ও উন্নয়ন চলছে।

 

আন হুই প্রদেশে গাড়ি, ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক নিয়ন্ত্রণ শিল্প চেইন এবং গাড়ি ও খুচরা যন্ত্রাংশ বাজার নিয়ে সম্পূর্ণ একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। উত্পাদনের দক্ষতা, বিশাল চাহিদা, রপ্তানির সুযোগ এ অন্যান্য সুবিধা এ অঞ্চলের এনইভি শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।

 

চ্য চিয়াং প্রদেশের নিং পো শহরের পেই লুন এলাকায় গত বছর ১১০টি গাড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ খুচরা যন্ত্রাংশের কোম্পানির উত্পাদনের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। গাড়ি শিল্পে গাড়ি তৈরির ৪টি সবচেয়ে কঠিন ও জটিল ধাপের একটি হলো খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবস্থা করা। ২০২০ সালে একটি কোম্পানি ঢালাই এর পরিবর্তে ডাই কাস্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। সত্তরটি খুচরা যন্ত্রাংশের বদলে এখন একটি খুচরা যন্ত্রাংশ দিয়ে কাজ হয়ে যায়। এতে ওজন কমে ১৩ শতাংশের মতো। টেসলাও এ কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কোম্পানির দায়িত্বশীল একজন জানান, টেসলারের কর্মকর্তারা একবার তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন তাদের প্রয়োজনীয় ‘এক ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশ তারা উত্পাদন করতে পারেন কিনা’। তারা টেসলার চাহিদা অনুযায়ী নিজের মেশিনকে রূপান্তর করে নেন।

বর্তমানে ওয়ে লাই, সিয়ান পেংসহ বিখ্যাত চীনা গাড়ি কোম্পানি ডাই কাস্টিং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞের মতে, এ প্রযুক্তি গাড়ি শিল্পকে বদলে দিতে পারে।

 

চিয়াং সু প্রদেশে নিং ত্য সি তাইর অধীন একটি নতুন-জ্বালানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোম্পানির কারখানায় ঢুকতে চাইলে সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাইরে রেখে যেতে হয়। এ কারখানায় প্রতি ঘন্টায় ২৫ বারের মতো বায়ু ফিল্টার করা হয় এবং এখানকার বায়ু হার্টের বাইপাস সার্জারি রুমের মতো বিশুদ্ধ। কারখানার উৎপাদন লাইন স্বয়ংক্রিয় এবং ৯০০ মিটার লম্বা উৎপাদন লাইনে মাত্র ৫০জন কর্মী কাজ করেন।

 

প্রতিটি পাওয়ার ব্যাটারিতে থাকে শতাধিক সেল। সব সেল একই রকম হলে বেশি নিরাপদ হয় ব্যাটারি। তাই মান যাচাই কাজে এআই ও বিগ ডেটা কাজ করে। মেশিন পরিষ্কার করতে অবিমিশ্র ইথানল ব্যবহার করে কোম্পানিটি। কারণ অ্যালকোহলে পানি মিশ্রিত থাকলেও অবিমিশ্র ইথানলে একদম পানি থাকে না। পানি না থাকলে লেজার ঢালাই সরঞ্জামের নির্ভুলতা বাড়ে। নির্মাণ শিল্পের স্ট্যান্ডার্ড হলো, ১০ লাখ পণ্যের মধ্যে মাত্র একটি ত্রুটিপূর্ণ পণ্য বের হলে, সে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত নির্মাণ-দক্ষতাসম্পন্ন বলে গণ্য করা হয়। তবে নিং ত্য সি তাই কোম্পানিতে ১শ কোটি পণ্যের মধ্যে কেবল একটি পণ্য ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। এর অর্থ হলো ১ কোটি গাড়ির মধ্যে মাত্র একটি ব্যাটারি সেল ত্রুটিযুক্ত হতে পারে।

 

চীনে পাওয়ার ব্যাটারির সম্পূর্ণ শিল্প চেইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্মার্ট কারখানা ও শূন্য-কার্বন কারখানা এ শিল্পের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পাওয়ার ব্যাটারির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, শিল্প চেইনের স্থিতিশীলতা এবং সবুজ উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবে চীন।

 

চিয়াং সু প্রদেশের লি ইয়াং জেলায় চীনের বিজ্ঞান একাডেমির পদার্থবিদ্যা বিভাগের একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাঁচ বছর আগে এ সংস্থা এ জেলায় কার্যক্রম শুরু করার পর এখানে এসেছেন বেশ কয়েকজন একাডেমিশিয়ান ও গবেষক। শিল্পের কাছাকাছি গবেষণা করায়, গবেষণার ফল দ্রুত শিল্পে কাজে লাগনো যায়।

 

ডক্টর লুও ফেই তাদের মধ্যে একজন। তিনি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা করেন এবং স্থানীয় কোম্পানি এখন তাঁর আবিস্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। গতানুগতিক গাড়ির তুলনায় এনইভির প্রতিস্থাপন চক্র ছোট। একটি গাড়ির নকশা ২ বছরে একবার সংস্কার করতে হয়। এতে যন্ত্রাংশ সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাড়ির নকশা পরিবর্তিত হলে, তার উপযোগী খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হয়। ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’র আওতায় গাড়ি ও খুচরা যন্ত্রাংশ কোম্পানির মধ্যে যোগাযোগ, নকশা সমন্বয়, পরীক্ষা আরও সহজ হবে এবং ব্যয়ও কমবে।

 

২০২৩ সালের গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত হয় ইয়াংসি নদীর বদ্বীপ অঞ্চলের যৌথ উন্নয়ন ফোরাম। এতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় যে, এখানে বিশ্ব মানের এনইভি শিল্প ক্লাস্টার গড়ে তোলা হবে। বিশ্বাস করা যায়, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ‘৪-ঘন্টা শিল্প বৃত্ত’।