অ্যাবার্ডিন মত্স্য গ্রামের স্মৃতি
2023-08-02 16:47:31

অ্যাবার্ডিন হচ্ছে চীনের হংকংয়ের দক্ষিণাঞ্চলের কেন্দ্রীয় এলাকা। অ্যাবার্ডিনের ডসমুদ্রতীরবর্তী পার্কে একটি ফিশারম্যান কালচার মিউজিয়াম আছে। এই জাদুঘরটি খুব বড় না হলেও দেয়ালে ঝুলানো পুরানো ছবিতে দেখা যায়, অ্যাবার্ডিনের মৎস্য বন্দরে সারিবদ্ধ মাছ ধরার নৌকা। এসব নৌকা এবং জলের পরিবারের জীবনের দৃশ্যগুলো অতীতে মৎস্য গ্রামের চিহ্ন রেখে গেছে।

অ্যাবার্ডিনের মৎস্য গ্রাম চতুর্দশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে এবং এটি অতীতে হংকংয়ের চারটি বড় মৎস্য গ্রামের মধ্যে প্রথম ছিল। গত শতাব্দীর ৭০’র দশকে এখানে জেলেদের জনসংখ্যা ৫০ হাজারে পৌঁছেছিল। সে সময় কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকা শুধু জেলেদের জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ারই ছিল না, পুরো পরিবারের আশ্রয়ও ছিল।

ফিশারম্যান কালচার মিউজিয়ামের কিউরেটর পোং চিয়ে লিং বলেন, “বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত হাজার হাজার জেলে সমুদ্রে নৌকায় বাস করতেন। এখন তাদের নৌকাগুলো ইয়ট ও ট্রলারে পরিণত হয়েছে।”

তিনি এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে হংকংয়ের সেই সময়কার মৎস্য শিল্পের সবচেয়ে উজ্জ্বল যুগ এবং সমুদ্রে জেলেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চান।

তেষট্টি বছর বয়সী ছেন চি হাও একই আশা পোষণ করেন। তিনি হংকংয়ের একজন বাসিন্দা। তার ছেলেবেলা কেটেছে মাছ ধরার নৌকায় এবং বড় হওয়ার পর তিনি মাছ ধরা এবং মাছ প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিসহ নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন।

খানিকটা হতাশা ব্যক্ত করে ছেন চি হাও বলেন, “এখন অনেকে হংকংয়ের জেলেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না। তারা বিশেষভাবে জাপানের তুকিজিসিজইউ (Tukijisijyou) মাছের বাজারে ঘুরে বেড়ান। তবে জাপানের তুকিজিসিজইউ মাছের বাজারের মতো এমন জায়গা হংকংয়েই আছে।”

হংকংয়ের মৎস্য সংস্কৃতি যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য ছেন চি হাও ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যটন সাংস্কৃতিক উত্সবে মাছের বাজারের স্বেচ্ছাসেবী গাইড হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি মানুষের কাছে মাছের বাজারের পরিবর্তন ও বিকাশ ব্যাখ্যা করেন এবং অ্যাবার্ডিন মৎস্য বন্দরের রহস্যময় দিকটি তুলে ধরেন।

ছেন চি হাওয়ের দাদার প্রজন্মের মানুষেরা মাছ ধরতে সমুদ্রে যেতেন, বাবার প্রজন্মের মানুষেরা মাছ বিক্রি করতেন এবং ছেন চি হাও দাদা ও বাবার হাত থেকে মাছ ধরার ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। তার পরিবারের তিন প্রজন্মের মানুষ মত্স্য শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ প্রত্যক্ষ করেছেন।

গত শতাব্দীর ৫০ ও ৬০’র দশকে মাছ ধরা হতো মূলত হাতেটানা জালের সাহায্যে। একবিংশ শতাব্দীতে আসে উচ্চ প্রযুক্তির স্মার্ট মাছ ধরার পদ্ধতি। এ ব্যাপারে ছেন চি হাও বলেন, “মাছ ধরার পদ্ধতির পরিবর্তনে প্রথাগত শিল্পগুলোতে প্রযুক্তির পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়।”

ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে সমুদ্রে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, তখন মাছ ধরা ছিল শ্রমঘন শিল্প; জাল ফেলা, জাল সংগ্রহ এবং বাছাই করাসহ নানা কাজ করতে একাধিক লোকের একসঙ্গে সহযোগিতা করার প্রয়োজন হতো।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি মৎস্য শিকারকে আরও স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছে। মনুষ্যবিহীন মাছ ধরার নৌকা, রোবটের মাধ্যমে জাল সংগ্রহ ও মাছ বাছাই এবং মাছের অবস্থানের জায়গা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস করার ব্যবস্থাসহ উন্নত প্রযুক্তি মাছ ধরাকে সহজ ও কম জনবল-ঘন করে তুলেছে।

ছেন চি হাও বলেন, “আমার ছেলেবেলায় আমার পরিবার যখন সমুদ্রে মাছ শিকারে যেত, আমার মা তার কান দিয়ে সমুদ্রে মাছের গতিবিধি উপলব্ধি করার মাধ্যমে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতেন। এখন আমরা মাছ শনাক্ত করার যন্ত্র ব্যবহার করি। অনেক দূর থেকে মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার ধরন এবং সঠিক অবস্থান জানতে পারি এবং তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন উপায়ে তাদের ধরতে পারি। খুব সহজ হয়ে গেছে।”

১৯৯০ সালের কাছাকাছি সময় ছেন চি হাওয়ের বাবা অবসর গ্রহণ করেন এবং তিনি বাবার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করার পাশাপাশি সীফুড ব্যবসাও শুরু করেন।

তিনি বলেন, “হংকং ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সীফুডের ক্রমবর্ধমান আমদানি ও রপ্তানি হংকংয়ের মৎস্য চাষের পতন রোধ করেছে। হংকংয়ে কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব রয়েছে এবং মৎস্য শ্রমিকেরও ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে মূল ভূখণ্ড ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে।”

হংকংয়ের জন্য সরকারের সহায়ক মৎস্যনীতি সম্পর্কে ছেন চি হাও বলেন, “আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। মূল ভূখণ্ডে একটি বিশাল জনসংখ্যা এবং একটি বড় বাজার রয়েছে। হংকং থেকে রপ্তানি করা মাছ সেখানে ভালো দামে বিক্রি হয়।”

যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক জেলে সাগর ছেড়ে তীরে চলে এসেছেন এবং জলজীবনকে বিদায় জানিয়েছেন।

গত শতাব্দীর ৫০’র দশকে জন্মগ্রহণ করেন ছেন ফু মিং। অ্যাবার্ডিনে তার পূর্বপুরুষেরা বংশ পরম্পরায় জেলে ছিলেন। তার মতো এই প্রজন্মের জেলেরা ‘তীরে ফিরে যাওয়া’ এবং তীরে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন জীবনের সূচনা করেছেন।

‘তীরে ফিরে যাওয়ার পরও’ তিনি মত্স্য-সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হয়েছেন।

‘সমুদ্রের উপহার’ জেলেদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে উন্নতি অর্জনে সক্ষম করেছে। সমুদ্রের প্রতি ছেন ফু মিংয়ের গভীর অনুরাগ রয়েছে। তিনি বলেন, “তীরে ফিরে যাওয়ার পরও আমি ও আমার পরিবার সমুদ্রের কাছাকাছি রয়েছি। যতদূর চোখ যায়, আমরা জাহাজ ও সমুদ্র দেখতে পাই।”

ছেন ফু মিংয়ের প্রায়ই সমুদ্র জীবনের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেন, “যদিও এটা কঠোর পরিশ্রমের ছিল, তবে আমি যখন জাল টেনে তুলতাম, নৌকায় মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়া লাফিয়ে উঠতে দেখতাম… তাদের সবই খুব জোরালো ছিল। সেই দৃশ্যটি ছিল বড় আনন্দের, যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না।”

মৎস্য চাষ একসময় হংকংয়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটি হ্রাস পেয়েছে। জলের উপর মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় - এমন একটি প্রশ্ন যা ছেন ফুমিংকে প্রায়ই ভাবায়।

তিনি বলেন, “আমি আশা করি, এই সুন্দর স্মৃতি চিরদিন রক্ষা করা যাবে এবং বাঁচিয়ে রাখা যাবে। বিভিন্ন উপায়ে পুরানো মাছ ধরার গ্রামটির উত্তরাধিকার বজায় রাখা যাবে।”