বিজ্ঞানবিশ্ব ২৯তম পর্ব
2023-07-31 18:28:24

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

২৯তম পর্বে যা থাকছে:

* চীনে রোবট পরিষেবা শিল্পের হাত ধরে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রূপ নিচ্ছে বাস্তবে

* চীনের বিশাল টেলিস্কোপ ফাস্ট 

* রান্নার কাজেও সাহায্য করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা!

 

 

চীনে রোবট পরিষেবা শিল্পের হাত ধরে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রূপ নিচ্ছে বাস্তবে

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ওতপ্রোতভাবে রোবটের ব্যবহার একটা সময় শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতেই শোনা যেতো। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে চীনের রোবট পরিষেবা শিল্পের অগ্রগতি দেখে মনে হতেই পারে, এক সময়কার কল্পকাহিনীই বুঝি এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে।

সম্প্রতি চীনের সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে মূল আকর্ষণ ছিলো নানা প্রকারের রোবট। হাজারো দর্শনার্থী এই সম্মেলনে ভিড় করেন আধুনিক রোবটের সক্ষমতা দেখতে। 

আমেরিকার টেক জায়ান্ট ‘টেসলা’ সম্মেলন চলাকালে তাদের তৈরি মানবসদৃশ্য রোবট ‘অপ্টিমাস’ প্রদর্শন করে। ১ দশমিক ৮ মিটার উচ্চতার রোবটটির ওজন ৫৭ কেজি। রোবটটি নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরিচালিত হয় এবং চারপাশের পরিস্থিতি বুঝতে এটি কম্পিউটার ভিশন ব্যবহার করে। দেখতে ছিমছাম গোছের হলেও রোবটটি একটি আধা টনের কনসার্ট গ্র্যান্ড পিয়ানো উত্তলনে সক্ষম।  

প্রদর্শনীতে কিছু রোবট কুকুরেরও দেখা পাওয়া যায়। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখে দর্শক উচ্ছসিত হয়। ছোট আকৃতির বোবট কুকুরগুলো হামাগুড়ি দিতে পারে, নাচতে পারে, এমনকি সেকেন্ডে ৪ দশমিক ৭ মিটার গতিতে দৌড়াতেও পারে। বড় আকারের রোবট কুকুরগুলোকে দিয়ে কাজও করিয়ে নেওয়া যায়। কেননা তারা ১০০ কেজি ওজন বহন করতে সক্ষম। পাশাপাশি উচু-নিচু ভূমিতেও

কাজ করতে সক্ষম বড় আকারের রোবট কুকুর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্বলিত এসব রোবট কুকুরগুলোকে কৃষিসহ নানা খাতে কাজে লাগানো সম্ভব। রোবট কুকুরগুলোর দাম শুরু হয় ১০ হাজার ইউয়ান থেকে। আরো আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন রোবট কুকুরগুলোর দাম কয়েক লাখ ইউয়ানও ছাড়িয়ে যায়। 

এই রোবটগুলোর নির্মাতারা জানান, জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় এসব রোবটের জুড়ি নেই। হাংচৌ-ভিত্তিক এক প্রযুক্তি কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক চিয়াং ইয়াংফেং বলেন, “যদি কোনো উঁচু ভবনে বা জঙ্গলে আগুন লাগে তাহলে সেখানে কেউ আটকে আছে কিনা, কোনো বিস্ফোরক অথবা বিষাক্ত গ্যাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে আমরা প্রথমে এই চার পা-বিশিষ্ট রোবটগুলোকে পাঠাতে পারি।” 

কৃত্রিম বুদ্ধিমতা ও ক্লাউড কম্পিউটিং-সমন্বিত উন্নয়নের ছোঁয়ায় রোবট এখন আগের থেকেও বেশি বুদ্ধিমান এবং তাদের শারীরিক সামর্থও আগের চেয়ে বেশি। সাংহাই-ভিত্তিক একটি প্রযুক্তি কোম্পানি এমন একটি রোবট তৈরি করেছে, যেটি বেইজিং অপেরায় পারফর্ম করবার মতো দক্ষ। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রোবটটির জয়েন্টগুলো আগের থেকে বেশ নমনীয়, তাই এই রোবটটি অন্য যেকোনো রোবট থেকে বেশি স্বতস্ফূর্তভাবে হাত-পা সঞ্চালন করতে পারে।

কোম্পানিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট চাং লেই বলেন, “সাংহাইয়ে আমাদের স্বয়ংক্রিয় ও মানববিহীন কারখানায় প্রতি বছর ১০ লাখ নমনীয় একচুয়েটর তৈরি করা সম্ভব। ১০টি আলাদা ক্যাটাগরি, সাইজ ও মডেলের একচুয়েটর তৈরি হয় আমাদের কারখানায়।”

সাংহাই-ভিত্তিক আরেকটি হাই-টেক কোম্পানি নতুন একটি মানবসদৃশ্য রোবট নিয়ে সম্মেলনের প্রদর্শনীতে আসে। নতুন এই রোবটের উচ্চতা ১ দশমিক ৬৫ মিটার এবং ওজন ৫৫ কেজি। রোবটটি ৫০ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে। রোবটটি দ্রুতবেগে হাঁটতে পারে এবং উপরে ও নীচে চলাচল করতে পারে।  

হাই-টেক কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট কু চিয়ে বলেন, চিকিৎসাখাত, পুনর্বাসন ও বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এই রোবটটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। 

“আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে এটিকে অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতেও কাজে লাগানো যাবে। এগুলোই ভবিষ্যতে মানবসদৃশ্য রোবটের জন্য কাজের দৃশ্যকল্প,” বলেন কু চিয়ে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রোবটগুলোর দক্ষতাকে আরো নিখুঁত করতে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে।

 

|| প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল মামুন

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

চীনের বিশাল টেলিস্কোপ ফাস্ট 

 

চীনের বিশাল একটি টেলিস্কোপ। নাম তার ফাস্ট। ফাইভ হান্ড্রেড মিটার অ্যাপারচার স্ফেরিকাল রেডিও টেলিস্কোপকে সংক্ষেপে ফাস্ট নামে ডাকা হচ্ছে।

চীনের বিশালাকৃতির এই  টেলিস্কোপ ২০১৬ সালে কাজ শুরুর পর থেকে আটশর বেশি নতুন পালসার শনাক্ত করেছে। মঙ্গলবার এই টেলিস্কোপের অপারেটর কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে। এটি পাঁচশ মিটার অ্যাপারচার স্ফেরিকাল রেডিও টেলিস্কোপ যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিংগেল ডিশ রেডিও টেলিস্কোপ। 

টেলিস্কোপের প্রধান প্রকৌশলী চিয়াং ফং জানান, আবিষ্কৃত নতুন পালসারের সংখ্যা একই সময়ে বিদেশী টেলিস্কোপ দ্বারা আবিষ্কৃত পালসারের মোট সংখ্যার তিনগুণ বেশি।

সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বড় আকারের মৃতপ্রায় নক্ষত্রের ইমপ্লোডেড কোর থেকে পালসার বা দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন নক্ষত্র জন্ম নেয়। পালসার পর্যবেক্ষণ টেলিস্কোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা মহাকর্ষীয় বিকিরণ এবং ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে এবং পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য অনেক বড় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ফাস্ট দ্রুত রেডিও বিস্ফোরণ, নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন এবং পালসারের গবেষণায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, যা মহাবিশ্বের মানুষের অন্বেষণের সুযোগকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছে। এই বছর, টেলিস্কোপটি ৫৩ মিনিটের অরবিটাল সময়কালের  একটি বাইনারি পালসার সনাক্ত করেছে। এটি হলো পালসার বাইনারি সিস্টেমের পক্ষে এখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে কম সময়। ন্যানোহার্টজ গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এর অস্তিত্বের প্রমাণও পাওয়া গেছে এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

চায়না স্কাই আই নামে পরিচিত টেলিস্কোপটি কুইচোও প্রদেশের একটি প্রাকৃতিকভাবে গোলাকার ও গভীর নিম্নভূমিতে অবস্থিত। এর রিসেপশন এলাকা ৩০টি স্ট্যান্ডার্ড সাইজের ফুটবল মাঠের সমান। চীনের এই টেলিস্কোপটি মহাকাশ সম্পর্কিত প্রযুক্তি জগতে বড় অবদান রাখছে।

 

|| প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

 

 রান্নার কাজেও সাহায্য করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা!

বিশ্বে লাখ লাখ বাবুর্চী রাত-দিন পরিশ্রম করে নতুন নতুন রেসিপি তৈরি করেন। তবে আমেরিকাভিত্তিক খাদ্য প্রযুক্তি স্টার্টআপ ‘ক্লাউডশেফ’ রেসিপি তৈরিতে যুক্ত করেছে নতুন প্রযুক্তি, তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। 

নামকরা সেলেব্রিটি বাবুর্চীরা সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত এই স্টার্টআপের অফিসে গিয়ে নিজেদের দক্ষতা শেয়ার করে। যারা ঘরে বসে তাদের রেসিপি তৈরি করতে চায় তাদের সুবিধার জন্য এই পুরো প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হয়।

ফার্মটির শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রাম নানা সেন্সর ও থারমাল ক্যামেরার সাথে সংযুক্ত থাকায় ছোট থেকে ছোট ডিটেইলও ডিজিটাল রেসিপিতে উঠে আসে। যা দেখে একজন আনাড়ি রাধুনীও রান্না করতে পারবে।   

ক্লাউডশেফ কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও নিখিল আব্রাহাম বলছিলেন তাদের অভিনব এ কার্যক্রম সম্পর্কে।

তিনি বলেন, “আপনি যদি শীর্ষস্থানীয় ভোজনশালাগুলোর দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন সেখানকার বাবুর্চীরা লম্বা একটি সময় প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যায় যেনো শুধুমাত্র প্রতিবারের রান্নার স্বাদ একইরকম হয়। রেসিপি

র স্বাদ বজায় রাখা আসলেই একটি কঠিন কাজ। তাই আমাদের উদ্দেশ্য হলো কম্পিউটারকে প্রথমে রান্না শেখানো এরপর সেই কম্পিউটারের সাহায্যেই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে স্বনামধন্য বাবুর্চীদের রেসিপি পুনরায় তৈরি করা।” 

ফার্মটি তাদের লভ্যাংশ থেকে একটি অংশ সেলিব্রিটি বাবুর্চীদের পরিশোধ করে। ফার্মটি চায়, ভবিষ্যতে ডিজিটাল রেসিপি বানিয়ে তাদের সিস্টেমে যে কেউ আপলোড দিতে পারবে এবং বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকেও রেসিপির আইডিয়া দেওয়া শুরু করেছে। রেসিপিগুলো তৈরির শেষ ধাপে শুধু মানুষের স্পর্শের প্রয়োজন পড়ে। 

আব্রাহাম আরো বলেন, এযাবতকালে যত প্রকারের রেসিপি তৈরি করেছে মানুষ এর সবগুলো দেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রেসিপি তৈরির একটি প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে পারে এবং এমন রেসিপি বের করে ফেলতে পারে যেটি মানুষের বের করতে হয়তো ১০০ থেকে ২০০ বছর সময় লাগতো। 

ভবিষ্যতের রন্ধনশিল্পে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি অতীতের রেসিপিগুলোও বাচিয়ে রাখতে কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আব্রাহাম ক্লাউডশেফ শুরু করেন কারণ তিনি তার মাতৃভূমি ভারতের দেশীয় খাবার খুব মিস করতেন। 

মজার ব্যাপার হলো তিনি এখন তার নিজের মায়ের হাতের রান্নাকে ডিজিটাইজড

করেছেন। পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকা সত্যেও তার ঠিক যেমনটি পছন্দ ঠিক তেমন স্বাদের রান্নাই এখন খেতে পারছেন তিনি।

 

|| প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল মামুন

|| সম্পাদনা: মাহমুদ হাশিম

 

অনুষ্ঠান কেমন লাগছে আপনাদের তা আমাদের জানাতে পারেন facebook.com/CMGbangla পেজে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভিডিও প্রতিবেদন দেখতে ভিজিট করতে পারেন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল CMG Bangla।

 

পরিকল্পনা ও প্রযোজনা- আব্দুল্লাহ আল মামুন

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান, মাহমুদ হাশিম

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী