দেহঘড়ি পর্ব-০২৯
2023-07-30 19:03:47

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

অনিদ্রার তাড়াতে দুর্দান্ত কাজের টিসিএম

অনিদ্রা এমন এক শারীরিক সমস্যা, যা ঘুমিয়ে পড়া বা ঘুমিয়ে থাকা কঠিন করে তুলতে পারে, ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি জাগিয়ে তুলতে পারে কিংবা একবার ঘুম ভাঙলে আবার ঘুমোতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। অনিদ্রার কারণে দিনভর ক্লান্তি, বিরক্তিভাব, বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ থাকে, এবং কাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা নষ্ট হয়।

ভ্রমণ বা কাজের সময়সূচিতে গড়বড়, দেরি করে রাতের খাবার খাওয়া, শোবার জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে না চলা কিংবা মানসিক চাপের কারণে অনিদ্রা হতে পারে। এর বাইরে বেশি মাত্রায় ক্যাফিন, নিকোটিন বা অ্যালকোহল গ্রহণ, নির্দিষ্ট অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের মতো ওষুধ, কিংবা হাঁপানি বা রক্তচাপের ওষুধের কারণে এ সমস্যা হতে পারে।

উৎকণ্ঠা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি, গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, অতিসক্রিয় থাইরয়েড, পারকিনসন্স ডিজিজ, আলঝেইমার’স ডিজিজ এবং স্লিপ অ্যাপনিয়াও নিদ্রাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।

চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে অনিদ্রাকে অভ্যন্তরীণ ভারমাস্যহীনতার লক্ষণগুলোর একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এ সমস্যাটিকে বিছিন্ন হিসাবে দেখা হয় না। এটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপে ভারসাম্য, জমে থাকা তাপ, প্লীহা ও হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা এবং প্লীহা ও পেটের ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। ক্লিনিকাল তথ্যের উপর ভিত্তি করে, টিসিএম চিকিৎসকরা ব্যাধির ধরন নির্ণয় করতে পারেন এবং রোগীদের জন্য একটি উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন।

একেক কারণে সৃষ্ট অনিদ্রায় একেক ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। জানিয়ে দিচ্ছি সেগুলো সম্পর্কে:

লিভারের স্থবিরতার কারণে অনিদ্রা: এ ধরনের অনিদ্রায় ঘুমাতে অসুবিধা হওয়ার পাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তি বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন দেখে। এর অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকে বিরক্তিভাব, চোখ লাল হওয়া, মাথাব্যথা, মুখে তিক্ততা আসা, তৃষ্ণা, ক্ষুধামন্দা, হলুদ প্রস্রাব ও কোষ্ঠকাঠিন্য।

ইয়িনের অভাবজনিত অনিদ্রা: এ ধরনের অনিদ্রায় ঘুমানো কঠিন হয়ে ওঠে, সারা রাতই ঘুম আসে না কিংবা ঘুম আসলেও বারবার ভেঙ্গে যায়। এর অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে থাকে কাজে মনোযোগ নষ্ট হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, বুক, হাত ও পায়ের তালুতে তীব্র সংবেদনশীলতা, মাথা ঘোরা, কানে শোঁ-শোঁ শব্দ করা, রাতে ঘাম হওয়া, কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা, স্বপ্নদোষ, মাসিকের সমস্যা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া।

কফ-তাপজনিত অনিদ্রা: এ ধরনের অনিদ্রায় ঘুম আসে না, এলেও গভীর হয় না এবং বার বার ঘুম ভাঙে। অনুপযুক্ত খাদ্যের কারণে এমন অনিদ্রা হয়। এ ধরনের অনিদ্রার অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকে মনোযোগে সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, কানে শোঁ-শোঁ শব্দ করা, কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা, মাসিকের সমস্যা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া।

হৃৎপিণ্ড ও প্লীহাতে ঘাটতিজনিত অনিদ্রা: এমন নিদ্রাহীনতায় স্বপ্নের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, সহজে ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং পুনরায় ঘুমে ফিরে যেতে অসুবিধা হয়। এ ধরনের অনিদ্রার প্রধান উপসর্গগুলো হলো বিরক্তির অনুভূতি, মাথায় চাপ বোধ করা, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, বুকে টান, গলায় অত্যধিক নিঃসরণ, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা এবং ঢেকুর ওঠা।

হৃৎপিণ্ড ও পিত্তথলিতে ঘাটতিজনিত অনিদ্রা: এমন অনিদ্রায় স্বপ্ন বিঘ্নিত হয় এবং ভয়ের কারণে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। এ ধরনের অনিদ্রার অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকে ভয়, বুক ধড়ফড়ানি, শ্বাসকষ্ট, প্রফুল্লতার ঘাটতি, ক্লান্তি, সহজে ঘামা এবং পরিষ্কার ও অধিক প্রস্রাব।

টিসিএমে মনে করা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনিদ্রার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে হার্টের ক্রিয়াকলাপের ভারসাম্যহীনতার। বেশ কিছু খাবার এই ভারসাম্যহীনতা দূর করে হৃৎপিণ্ডকে পুষ্ট করতে পারে, যার ফলে মন শান্ত হয় এবং অনিদ্রা দূর হয়। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে চীনা খেজুরের বীজ, তুঁতফল বা মালবেরি, পদ্ম বীজ ও শাপলা।

মানসিক চাপে রয়েছে এবং লিভারের ক্রিয়াকলাপে স্থবিরতা এসেছে এমন ব্যক্তিদের সমস্যা উপশম করতে পারে কমলালেবু, জেসমিন, চন্দ্রমল্লিকা ও গোলাপের কুঁড়ি। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ শরীরের অত্যাবশ্যক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে পারে এবং বিভিন্ন অঙ্গে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে, যা নিদ্রাহীনতাকে আরও প্রকট করে দেয়। অ্যাঞ্জেলিকা রুট, উল্ফবেরি, গাজর, পালং শাক, লাল খেজুর, জিনসেং ও লংগান আরিলের মতো খাবারগুলো এমন ঘাটতি দূর করতে পারে।

খাবারের পাশাপাশি খাওয়ার অভ্যাসও ঘুমের মানকে প্রভাবিত করে। যেমন, খুব বেশি বা খুব দেরি করে রাতের খাবার খেলে পেট খালি হতে দেরি হয়, যার ফলে ঘুমের সময় শারীরিক অস্বস্তি হয়। ঘুমানোর অন্তত ৩ ঘন্টা আগে রাতের খাবার শেষ করা উচিত এবং রাতের খাবার হওয়া উচিত হালকা। হজমের সমস্যা যাদের আছে, তাদের ভারী, তৈলাক্ত ও মশলাদার খাবারের পরিমাণ সীমিত করা উচিত। পাশাপাশি কফি, কোলা, চা, সোডা ও চকলেট খাওয়া কমানো উচিত, বিশেষ করে শেষ বিকেলে ও সন্ধ্যায়। রাতের খাবারের পর তরল খাবার গ্রহণ কমাতে হবে। কারণ এ সময় বেশি তরল খেলে প্রস্রাবের কারণে বারবার ঘুম ভাঙতে পারে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

শত বছরের পুরনো হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল

হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল চীনের উত্তরাঞ্চলীয় হ্যপেই প্রদেশের রাজধানী শিচিয়াচুয়াংয়ে অবস্থিত একটি তৃতীয় গ্রেডের জেনারেল হাসপাতাল। চিকিৎসা, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন একই ছাদের নিচে আনা হয়েছে এখানে। একটি জাতীয় শিশু-বান্ধব হাসপাতাল হিসাবে স্বীকৃত এই হাসপাতাল। এক শতাব্দিরও বেশি সময় আগে ১৯০৯ সালে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি মহামারীপ্রতিরোধী হাসপাতাল হিসাবে। এর জন্য অর্থ যোগান দিয়েছেল ‘মহামারি প্রতিরোধ ব্যুরো’। মাত্র ১০জন কর্মী নিয়ে শুরু হওয়া হাসপাতালটিতে এখন কর্মরত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মী। দীর্ঘ সময়ের পথ চলায় অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েছে এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৫ সালে হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল হিসাবে নামকরণের আগে ২৩ বার এর নাম বদল করা হয়েছে এবং চার বার স্থান বদল করা হয়েছে।

হাসপাতালটি দুটি ভাগে বিভক্ত -- সদর দপ্তর ও উত্তর হাসপাতাল। সদর দপ্তরে রয়েছে সমন্বিত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুবিধা, অন্যদিকে উত্তর হাসপাতালের বৈশিষ্ট হলো টিউমার ও যক্ষ্মা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা এবং সমন্বিত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা। প্রায় ৩ হাজার শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১ লাখ ৬৭ বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে। এখানে কর্মরত ৩ হাজার ৪৪০ জন কর্মীর মধ্যে রয়েছেন ৬৩৬ জন জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ, ৯৫৫ জন মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রীধারী, ২ জন রাষ্ট্রীয় পরিষদের বিশেষ ভাতাভোগী বিশেষজ্ঞ এবং ১ জন হ্যপেই প্রাদেশিক সরকারের বিশেষ ভাতাভোগী বিশেষজ্ঞ।

একটি জেনারেল হাসপাতাল হিসাবে প্রায় সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় এই হাসপাতালে। এখানকার বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে নবজাতক ও শিশুরোগ বিভাগ, জরুরি ওষুধ বিভাগ, শ্বাসতন্ত্র বিভাগ, ক্যান্সারবিজ্ঞান বিভাগ, পরিপাকতন্ত্র বিভাগ, রক্তরোগ বিভাগ, চর্মরোগ বিভাগ, স্ত্রীরোগ বিভাগ, পরীক্ষাগার ও থোরাসিক সার্জারি বিভাগ।

কর্তৃপক্ষ বলছে, হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল নতুন ধারণা, নতুন প্রকল্প, দেশ-বিদেশের নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে সব সময়। উচ্চ ও নতুন প্রযুক্তির পাশাপাশি হাসপাতালটি ল্যাপারোস্কোপ, থোরাকোস্কোপ, ভেন্ট্রিকুলোস্কোপ ও হিস্টেরোস্কোপের মতো স্বল্প-আক্রমণাত্মক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডক্টরাল ও পোস্ট-ডক্টরাল পর্যায়ের চিকিৎসাশিক্ষা প্রদানের ভিত্তি এই হাসপাতাল।

চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষায় অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে অনেক পুরস্কারে পেয়েছে হ্যপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।