বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা পদক্ষেপের পরও এ অবস্থা। দেশে ঝুঁকিমুক্ত সড়কের দাবিতে সবাই একমত হলেও পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়নি। সারা দেশে প্রতিদিনই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার অনেক খবর পাওয়া যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (SCRF) পর্যবেক্ষণে এসব দুর্ঘটনার জন্য ১৬টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। গত সপ্তাহে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে আজ।
এসসিআরএফের (SCRF) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৭৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৮৯৮জন নিহত ও চার হাজার ৭২০জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার ৭৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১০৮৮। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল আন্তরিক। তবে, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্বশীলতার ঘাটতিও রয়েছে।
গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য প্রকাশিত হয়, প্রকৃত দুর্ঘটনা তার চেয়ে চার বা পাঁচ গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নানা রকম কমিটি গঠন এবং সুপারিশ করার চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন করা। নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলো গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে প্রধান শহরকেন্দ্রীক মানুষের চাপ না-বাড়ে। এতে করে সড়কে যান চলাচলে সাধারণ নিয়মকানুন প্রয়োগ করা সুবিধাজনক হয়ে উঠবে।
এসসিআরএফের (SCRF) প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার ১৬টি প্রধান কারণ হচ্ছে ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন। ২. অদক্ষ, অসচেতন ও অসুস্থ চালক। ৩. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। ৪. প্রচলিত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে ওভারটেকিং। ৫. নিয়োগপত্র, সাপ্তাহিক ছুটি ও নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকায় চালক ও সহকারীদের মানসিক অবসন্নতা। ৬. বিভিন্ন স্থানে সড়কের বেহাল দশা। ৭. জাতীয় মহাসড়ক ও আন্তঃজেলা সড়কে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। ৮. দূরপাল্লার সড়কে বাণিজ্যিকভাবে বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল চলাচল। ৯. মহাসড়কে স্বল্পগতির তিন চাকার যানবাহন চলাচল। ১০. তরুণ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মোটরসাইকেল চালানো। ১১. বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি। ১২. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং হাইওয়ে পুলিশের জনবল ও অন্যান্য সুবিধার ঘাটতি। ১৩. সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণার অভাব। ১৪. চালক ও পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। ১৫. প্রচলিত আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর শিথিলতা। ১৬. বিভিন্ন টার্মিনাল ও সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি।
সংস্থার উল্লেখিত সবগুলো বিষয়ই সমাধানযোগ্য। প্রতিটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কমানো যায় এবং দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতও করা সম্ভব।
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ দেশের জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে বিশ্বের মোট সড়ক যানের ৬০ শতাংশ থাকা স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়োরিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যায় ১০২ জন।
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। ৬১ দশমিক ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ রাস্তার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার ২ দশমিক ৩১ শতাংশ হার নিয়ে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষে আছে সুইডেন।