শানসি প্রদেশের ভিনেগার শিল্প
2023-07-26 09:40:25

               

চীনের শানসি প্রদেশের প্রসঙ্গ যখন আসে, সবার মনে পড়ে ভিনেগারের কথা। সোর্গাম বা জোয়ার নামের এক ধরনের খাদ্যশষ্য ভিনেগার তৈরির মূল উপাদান। ভিনেগার তৈরির জন্য একজন অভিজ্ঞ কর্মীকে বাষ্পায়ন, গাঁজন ও ধূমায়নসহ ৫টি পর্যায়ে ৮২টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় এবং এর জন্য ১ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। এভাবে শানসি প্রদেশের পুরানো ভিনেগার তৈরি করা হয়। টক, মিষ্টি ও সুগন্ধ সব পাওয়া যায় এ ভিনেগারে।

শানসি প্রদেশের ভিনেগার তৈরির ইতিহাস ৩ হাজার বছরের প্রাচীন। ভিনেগারের ইতিহাস থেকে উপলব্ধি করা যায় হুয়াং থু মালভূমির রীতিনীতি ও বৈশিষ্ট্য। ভিনেগার শানসি প্রদেশের একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং স্থানীয় প্রধান শিল্প।

আমরা ভিনেগার দিয়ে সাধারণত খাবারের স্বাদ বাড়াই। তবে আপনারা কি জানেন, শানসি প্রদেশের মানুষেরা পানীয় হিসেবে ভিনেগার পান করে। শানসি প্রদেশের মেংফেং উপজেলায় অবস্থিত চিন ইয়ান নামের একটি ভিনেগার কোম্পানি। কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক কুও সিয়াও তুং পানীয় ভিনেগার সাংবাদিকের সামনে তুলে ধরেন। এ ভিনেগারে রয়েছে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী চীনা ভেষজ, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

সাধারণ ভিনেগারের তুলনায় পানীয় ভিনেগার তৈরির প্রক্রিয়া জটিল। এ ভিনেগারের উপাদান, গাঁজন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ার সময়ের ব্যাপারে বিশেষ নিয়ম আছে। পাঁচ বছর ধরে শীতকালে বরফ বাদ দেওয়া এবং গ্রীষ্মকালে রোদে তাপ দেওয়াসহ নানা প্রক্রিয়ার পর ভিনেগারের পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়। বাকি এক-তৃতীয়াংশ পানীয় ভিনেগার হয়।

শানসি প্রদেশে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে, বাসায় কিছু ভিনেগার থাকলে ওষুধের দোকানে যাবার দরকার হয় না। শানসির অধিবাসীদের মতে, ভিনেগার স্বাস্থ্যকর এক ধরনের খাবার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শানসির ভিনেগার কোম্পানিগুলো ভিনেগার তৈরির বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগ করেছে। তাদের ভিনেগার স্বাস্থ্যপণ্য বা ওষুধের মতো কাজ করে।

শানসি প্রদেশে ভিনেগার গাঁজন বিজ্ঞান ও কৌশল বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা ভিনেগার গাঁজন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি, প্রযুক্তি ও কৌশল, ভিনেগারের পুষ্টি এবং স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম নিয়ে গবেষণা করছেন। পরীক্ষাগারের প্রধান জেং ইউয়ু জানান, তারা ভিনেগারের পুষ্টিগুণ নিয়ে গবেষণা করছেন। ভিনেগারের কেবল লিভারের জন্য উপকারী এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ একটি খাবার নয়; বরং এটি এক ধরনের পুষ্টিকর ও স্বাস্থসম্মত খাবারে পরিণত হচ্ছে। ভিনেগার কোম্পানিগুলো এখন নানা ধরনের চীনা ভেষজ ও ভিনেগারের সমন্বয়ে নতুন পণ্য আবিস্কারের গবেষণা করছেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে একদিকে ভিনগারের কার্যকারিতা বাড়ছে, অন্যদিকে এর উত্পাদন প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং মানে আরও উন্নত হচ্ছে।

চি লিন নামের একটি ভিনেগার কোম্পানির কারখানায় ঢুকলে কোন টক গন্ধ পাওয়া যায় না। ত্রিশটি স্টেইনলেস স্টিলের মেশিন ২৪ ঘন্টা কাজ করে। উপাত্ত ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য কয়েকজন কর্মী সেখানে আসা-যাওয়া করেন। এ মেশিন হচ্ছে কোম্পানির নতুন আবিষ্কার। এ মেশিন ভিনেগার তৈরির ৫টি পর্যায়ের মধ্যে তিনটি সম্পন্ন করতে পারে। অভিজ্ঞ কর্মীর কৌশল ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এ মেশিন দিয়ে উত্পাদনের পরিমাণ ১০ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানো যায়।

প্রথাগত পদ্ধতিতে তৈরি ভিনেগারও এখন আছে। হাতে ও যান্ত্রিকভাবে – এই দুই পদ্ধতিতে এখন শানসি ভিনেগার উত্পাদিত হচ্ছে। শানসি ভিনেগারের উত্স হিসেবে ছিংসু জেলা ভিনেগার শিল্প উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গড়ে তুলেছে। ভিনেগার কোম্পানিগুলো নিয়ে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং প্রতি বছর এখানে ৮ লাখ টন ভিনেগার উত্পাদিত হয়। এক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এ শিল্পে।

বেইজিংয়ের একটি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র চাং থিয়ান হ্য বলছিল, অনেক অপেক্ষার পর সে শানসির ভিনেগার শিল্প দেখতে আসতে পেরেছে। যে ভিনেগার দিয়ে সে ডাম্পলিং খেতে পছন্দ করে, সেটা কীভাবে তৈরি করা হয় আগে সেটা জানতো না সে। তাই এবার সে শানসি প্রদেশে এসেছে উত্তর খুঁজতে। গাইডের সঙ্গে পর্যটকরা একের পর এক কারখানায় পরিদর্শন করে। ভিনেগার তৈরির প্রক্রিয়া দেখে অবাক হয় চাং থিয়ান হ্য। সে কখনও ভাবেনি, ভিনেগার তৈরির প্রক্রিয়া এত জটিল। এ প্রক্রিয়া থেকে সে বুঝতে পারে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কতটা বুদ্ধিমান ছিল।

শানসি ভিনেগার তৈরির কৌশল ও সংস্কৃতি মানুষের সামনে তুলে ধরতে এবং জনপ্রিয় করতে শানসি ভিনেগার কোম্পানি একটি পর্যটন প্রকল্প চালু করেছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ১ লাখ মানুষ তুং হু ভিনেগার পার্ক দেখতে এসেছেন। অনেক পর্যটক এখানে আসার পর ভিনেগারের অনুরাগী হয়েছেন এবং কেউ কেউ নিজের শহরে ভিনেগার বিক্রি শুরু করেছেন।

অন্য ভিনেগার কোম্পানিগুলোও নিজেদের যাদুঘর বা পার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে এবং পিয়াং ইয়াও প্রাচীন নগর এবং থাই ইউয়ান ইং জেলাসহ জনপ্রিয় দর্শনী স্থানে ভিনেগার তৈরির কারখানা খুলেছে। সেখানে পর্যটকরা নিজেরাও ভিনেগার তৈরির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।

পর্যটকরা ভিনেগার স্বাদের আইসক্রিমও খেতে পারেন। ভিনেগার ও ক্রিমের সমন্বয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক ধরনের স্বাদ পাওয়া যায়। তারা ভিনেগার ডিনারও উপভোগ করতে পারেন, যেখানে সব খাবার ভিনেগার দিয়ে তৈরি। উত্সবের সময় ভিনেগার দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী খাবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যেমন মধ্য শরৎ উত্সব, তুয়ান উ উত্সব এবং লণ্ঠন উত্সবের ঐতিহ্যবাহী খাবার মুনকেক, জুংচি ও থাং ইউয়ানও বানানো হয় ভিনেগার স্বাদে। শানসি প্রদেশে সব খাবার ভিনেগার দিয়ে তৈরি করা হয়। মিষ্টি খাবারের প্রভাব কমাতে পারে ভিনেগার।

শুধু খাবার নয়, ভিনেগার সংস্কৃতি প্রচার করতেও নৃত্য, গান এমনকি চলচ্চিত্রও তৈরি করা হচ্ছে। গেল কয়েক বছরে ভিনেগার বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চীনের হটপট, গ্রিল মাছসহ বিভিন্ন খাবার বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এসব খাবার তৈরি করতে বা খেতে ভিনেগার প্রয়োজন। চীন-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ব্যবসা করেন ছুয়ান থিয়ান হাই। তিনি জানান, দক্ষিণ কোরিয়ায় বছরে তিনি ১ লাখ বাক্স ভিনেগার বিক্রি করতে পারেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপনাসহ ৩০টি দেশ ও অঞ্চলে তারা ভিনেগার রপ্তানি করেন। যদিও বিভিন্ন দেশের মানুষের খাওয়ার সংস্কৃতি ভিন্ন, তবে শানসি ভিনেগার তৈরির কৌশলকে স্বীকৃতি দেয় বিদেশিরা এবং তারা ভিনেগারের মাধ্যমে চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও জানতে পারেন।

যদিও শানসির ভিনেগার সুবিখ্যাত, তবে এখানে কোনও বিখ্যাত ভিনেগার ব্র্যান্ড নেই। যুবক ভোক্তাদের মন জয় করতে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করতে ঐতিহ্যবাহী শানসি ভিনেগার কোম্পানিও সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

হাই লিন খাবার কোম্পানির কারখানায় দেখা যায় ছোট প্যাকের ভিনেগার উত্পাদিত হচ্ছে। ছোট প্যাকের ভিনেগার তাত্ক্ষণিক নুডলস, হটপটসহনানা খাবারের সঙ্গে বিক্রি হয়। ২০১৭ সালে তারা ছোট প্যাকের ভিনেগার তৈরি শুরু করে এবং গত বছরে তাদের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ইউয়ান।

অন্যদিকে শানসি মেই চিন ভিনেগার কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক পেং সি চ্য জানান, তারা উচ্চ পর্যায়ের বাজার লক্ষ্য করে পানীয় ভিনেগার তৈরি করছেন।

মসলা হিসেবে ভিনেগারে ফ্যাশন উপাদানও থাকতে হয়। কিছু কোম্পানি ভিনেগার প্যাকেজিংয়ের ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়। ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়াতে তারা পিংকিং অপেরার উপাদান ভিনেগার প্যাকেজের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, যেটা তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

কোন ব্র্যান্ডের বাজার পণ্যের মানের ওপর নির্ভর করে। কিছু দিন আগে ছিং সু জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের একটি ভিনেগার পণ্য পরীক্ষা কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের নির্মাণে ১৫ কোটি ইউয়ান ব্যয় করা হয়। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় ভিনেগার পণ্যের মান পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করে এই কেন্দ্র।

সম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইন কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ভিনেগারও অনলাইনে বিক্রি হয়। ছিং সু জেলায় তরুণ অ্যাংকররা নিজেদের কোম্পনির ভিনেগার লাভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করছেন। ছিং সু জেলায় রয়েছে ৮১টি ভিনেগার কোম্পানি, তবে মাত্র ১০টি পেশাদার ই-কমার্স অপারেশন দল আছে। বাকি কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করতে জেলা সরকারের উদ্যোগে একটি অনলাইন বিক্রির চ্যানেল খোলা হয়েছে আর এ চ্যানেলের মাধ্যমে স্থানীয় ভিনেগার কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে।

(শিশির/রহমান/রুবি)