চীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন
2023-07-24 15:00:48

সম্প্রতি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ১৮টি সরকারি বিভাগ ‘নতুন যুগে চীনা ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা জোরদারের কর্ম-প্রস্তাব’ প্রকাশ করে। ‘দ্বৈত হ্রাস’ নীতি চালু করার পাশাপাশি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর এতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এর লক্ষ্য, শিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা।

বর্তমানে চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা-কার্যক্রম কেমন চলছে? কিভাবে স্কুলের বাইরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রশিক্ষণকোর্সের সাথে স্কুলের সংশ্লিষ্ট ক্লাসের শিক্ষাকে যুক্ত করা হচ্ছে? দূরবর্তী বা অনুন্নত এলাকার স্কুলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্লাসের মান কিভাবে শহরের মতো উন্নত করা যায়? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।

চীনের শাআনসি প্রদেশের রাজধানী সি’আন শহরের প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চারা বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিজ্ঞান গবেষণা ঘাঁটিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের রাইজোম ও পাতা পর্যবেক্ষণ করতে পারে; আবহাওয়া ব্যুরোতে বাতাসের মাত্রা মাপার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে; মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে তাঁরা রকেট নিক্ষেপ, মহাকাশকেন্দ্রের সাথে মহাকাশযানের সংযুক্তির দৃশ্য দেখতে পারে। এগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরিতে সহায়ক।

বর্তমানে চীনে সহস্রাধিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর রয়েছে।  প্রায় ১০ হাজার কেন্দ্র আছে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। এসব কেন্দ্র থেকে তাঁরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি, চীনের কেন্দ্রীয় লটারি কেন্দ্রের কমিউনিটি চেস্টের সমর্থনে ১৪০টিরও বেশি পরীক্ষামূলক বহুমুখী ঘাঁটি নির্মিত হয়েছে এবং ৬২০টিরও বেশি গবেষণার ঘাঁটি ও ক্যাম্প নির্মিত হয়েছে। এর ফলে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগও বেড়েছে।

চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মান সম্পর্কে সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্লাসের স্কোর মোটামুটি ভালো; প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাঝারি বা উচ্চ মানের স্কোর করে থাকে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পর্যালোচনা প্রকল্পে (পিআইএসএ) চীনের চারটি প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের বই পড়া, গণিত আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্লাসের স্কোর সকল অংশগ্রহণকারী দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে দাঁড়িয়েছে।

গত ১০ বছরে চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা সার্বিকভাবে জোরদার করা হয়েছে। এখন প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক স্কুলের নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্লাস চালু আছে। এতে তথ্যপ্রযুক্তি ও শ্রম প্রশিক্ষণ বিষয় রয়েছে। ২০২২ সালে চীনের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চবিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারগুলোর সাজ-সরঞ্জামের পরিমাণও ২০১২ সালের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা চীনা কিশোর-কিশোরীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। আর দক্ষ ব্যক্তিরা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে অবদান রাখে এবং দেশকে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

তবে, বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষা খাতে চীনের কিছু কিছু এলাকা পিছিয়ে আছে। বিজ্ঞান শিক্ষার সংশ্লিষ্ট সম্পদ বা দক্ষ শিক্ষকের অভাব এসব এলাকায় স্পষ্ট। এসব এলাকার বিজ্ঞান ক্লাস থেকে দেশের জন্য যথেষ্ট দক্ষ ও যোগ্য লোক বের হতে পারছে না।  প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

চীনের হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের ছাংচুন মেইসিহু মাধ্যমিক স্কুলের উদ্ভাবনী কেন্দ্রে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র লিউ জি ছি রুলার দিয়ে বাতির আলোতে সবুজ শিম স্প্রাউটের উচ্চতা মাপে এবং তার সহপাঠী সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার পরিসংখ্যান রেকর্ড করে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞান ক্লাসের সহকারী শিক্ষক লং সিয়াও হুয়া বলেন, বিজ্ঞান ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা রুমের আলোর অভাব কীভাবে উদ্ভিদের বড় হওয়ায় ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তিনি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করেন। শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদের উচ্চতা ও পাতার রঙসহ বিভিন্ন বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে আলো যে উদ্ভিদের জন্য কতো গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে গবেষণা করে।

মৌলিক শিক্ষা পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের প্রতি কৌতুহলী করে তোলা এবং তাদের মধ্যে অনুসন্ধানের চেতনা তৈরি করা। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের গুণগত মানের প্রশিক্ষণ অতি জরুরি। ভালো পাঠ্যপুস্তক, ভালো শিক্ষক, নিয়মিত অনুশীলন এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি।

কিভাবে স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞানশিক্ষা আরও কার্যকর করা যায়? চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন স্কুলে ‘গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা’-র জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে এবং যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর এভাবে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্লাস ও সংশ্লিষ্ট অনুশীলনের মান নিশ্চিত করা যাবে। বিশেষ করে, শিক্ষকদল গঠনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয় চীনের সরকার। যথেষ্ঠ উচ্চ গুণগত মানের বিজ্ঞান শিক্ষক বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসের মান নিশ্চিত করতে পারেন।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে চীনের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাসের পেশাদার শিক্ষকের সংখ্যা ২০১২ সালের তুলনায় ৩৫.৩ শতাংশ বেড়েছে। শাআনসি প্রদেশের সি’আন শহরের ৭৯ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের পদার্থবিদ্যার সিনিয়র শিক্ষক লিউ ওয়েন চুয়ান মনে করেন, বিজ্ঞান শিক্ষকদের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান গবেষণার প্রক্রিয়া বুঝতে পারে।

কিভাবে স্কুলের বাইরে বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের বিস্তার ঘটানো যায়? এ সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান, চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষার পরিপূরক হিসেবে, স্কুলের বাইরের প্রশিক্ষণও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে, শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান প্রশিক্ষণসম্পদ বেছে নেওয়া জরুরি। বিভিন্ন স্টেডিয়াম, ঘাঁটি ও উদ্যানসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য কাজে লাগিয়ে, বিজ্ঞান প্রশিক্ষণে আরও বেশি তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করতে হবে। তা ছাড়া, সমাজের বিভিন্ন মহলে বিজ্ঞানসম্পদ ও গবেষণার চেতনা তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়।

বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট সম্পদের দিক দিয়ে অনুন্নত ও দুর্বল এলাকায় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তিব্বতের শিকাচে শহরের তিংরি জেলার চাশিচং উপজেলার একটি প্রাথমিক স্কুলের অদূরে চীনের বিজ্ঞান একাডেমির চুমুলংমা পর্বতের বায়ু ও পরিবেশ পর্যবেক্ষণ স্টেশন নির্মিত হয়েছে। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীনের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের ক্লাসে বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারছে।

চীনের হ্যনান প্রদেশের সিনইয়াং শহরের কুশি জেলার চাংকুয়াংমিয়াও উপজেলার প্রাথমিক স্কুলের খেলার মাঠে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের তৈরি রকেটের নমূনা সফলভাবে নিক্ষেপ করেছে। এ সম্পর্কে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক চাং বলেন, নিয়মিত বাচ্চাদের নিয়ে মজার মজার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা বেশ তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার। এভাবে বাচ্চারা বিজ্ঞানের জগত সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পারছে।

অনুন্নত ও দুর্বল এলাকাগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চীনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল, সংখ্যালঘু জাতিঅধ্যুষিত এলাকা এবং সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাস চালু এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষাসরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

দেশের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ ঘাঁটি প্রকল্পসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে সেখানকার স্কুলগুলোতে উন্নতমানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি পাঠানো যায়। সমাজের বিভিন্ন মহলের সেরা প্রশিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে অনুন্নত এলাকার স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক বিজ্ঞানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করানো, বিশেষ করে উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা করে অনুন্নত এলাকার স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাস স্থাপনে সরঞ্জাম, বই ও সফটওয়ারসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া আর পেশাদার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিজ্ঞান ক্লাসের উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রকল্প। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে জড়িত কোম্পানিগুলো দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিতে ও ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে কাজ করবে। কেবল বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় ভালো স্কোর বা পুরস্কার লাভের জন্য বিজ্ঞান ক্লাসে যোগ দেওয়া মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান গবেষণার চেতনা ধারণ করতে হবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিজ্ঞানচর্চা করতে শিখতে হবে। এভাবে নতুন প্রজন্মের বাচ্চারা দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে ভবিষ্যতে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারবে।

 

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)