দেহঘড়ি পর্ব-০২৮
2023-07-23 20:32:57

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

হাইপারটেনশনের টেনশন কমাবে টিসিএম

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি ব্যাপক বিস্তৃত রোগ। সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর জন্য এক নম্বর ঝুঁকির কারণ উচ্চ রক্তচাপ। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, সারা বিশ্বে ১৩০ কোটি মানুষ কোনও না কোনও পর্যায়ের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ৷ এ রোগের গুরুতর কোনও উপসর্গ থাকে না, যেকারণে এটিকে ‘নীরব ঘাতক’ হিসাবে অভিহিত করা হয়৷ উচ্চ রক্তচাপ হলে ধমনীর দেয়ালের ওপর রক্তের চাপ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তারপর হৃদপিণ্ড ও রক্তনালীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা না করা হলে উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি বিকল হওয়ার মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

 চিরাচরিত চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে মনে করা হয়, মূল প্রাণশক্তি বা ‘ছি’ এবং রক্তপ্রবাহের ভারসাম্যহীনতার কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়, যা চিকিৎসা না করা হলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে। টিসিএম উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসায় একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা দেয়, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, আকুপাংচার, ভেষজ ওষুধ এবং জীবনযাত্রা পদ্ধতির পরিবর্তন। এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য থাকে রোগটিকে একেবারে মূল থেকে বিনাশ করা।

সিটিএমে উচ্চ রক্তচাপের ক্লিনিকাল চিকিৎসায় সর্বাধিক ব্যবহৃত ফর্মুলেশনগুলো হলো থিয়ানমা কউথাং ডিককশন বা ক্বাথ এবং চেনকান সিফেং ডিককশন। আর উচ্চ রক্তচাপের ক্লিনিকাল চিকিৎসার জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত টিসিএম উপাদানগুলো হলো আনকারিয়া, অ্যাকিরান্থেস ও টাকাহোই। টিসিএম ওষুধগুলো সাধারণত যকৃতের মেরিডিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে উচ্চ রক্তচাপের চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত টিসিএম ওষুধগুলো বেশিরভাগই লিভার, হার্ট ও কিডনি মেরিডিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারে টিসিএম। চলুন দেখে নিই কী কী উপকারিতা আছে টিসিএমে।

সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিকিৎসা: টিসিএম কোনও রোগের চিকিৎসার জন্য কেবল আক্রান্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা শরীরের অংশকে বিবেচনা করে না; বিবেচনা করে পুরো শরীরকে। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও শুধু উপসর্গের চিকিৎসা না করে এ রোগের মূল কারণগুলোকে খুঁজে বের করে এবং তা মোকাবেলার চেষ্টা করে। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

স্বতন্ত্র চিকিৎসা: টিসিএম চিকিৎসায় একজন রোগীর অনন্য শারীরিক গঠন, জীবনধারা ও চিকিৎসার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তার জন্য চিকিৎসা প্রটোকল ঠিক করা হয়। এ ধরনের চিকিৎসা প্রটোকল চিকিৎসার ফলাফল উন্নত করতে এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। 

স্বল্প পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: টিসিএম চিকিৎসা সাধারণত কোমল প্রকৃতির, যার জন্য প্রচলিত ওষুধের তুলনায় এ ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম দেখা দেয়৷ যেমন ভেষজ ফর্মুলা ও আকুপাংচার সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে, তা একেবারে নিরাপদ এবং শরীর সেটা ভালভাবে গ্রহণ করে৷

দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা: টিসিএম চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে৷ শরীরের ভারসাম্যহীনতাকে দূর করে টিসিএম চিকিৎসা উচ্চ রক্তচাপের অবনতি রোধ করতে এবং স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে৷

প্রচলিত চিকিৎসার পরিপূরক: উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় প্রচলিত ওষুধ ও চিকিৎসার পাশাপাশি টিসিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা প্রচলিত ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। একটি সমন্বিত চিকিৎসা পরিকল্পনার সঙ্গে টিসিএমকে একীভূত করা হলে, তা উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে আরও ভাল ফল দেয়।

তবে উচ্চ রক্তচাপের জন্য টিসিএম চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব সময় একজন বিশেষজ্ঞ টিসিএম অনুশীলনকারীর শরণাপন্ন হতে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এ রোগের টিসিএম চিকিৎসা প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য একটি পরিপূরক পদ্ধতি। 


#চিকিৎসার_খোঁজ

৪ প্রদেশের মানুষ সেবা পায় সুচৌ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে

সুচৌ কেন্দ্রীয় হাসপাতাল ১৯৫৩ সালে চীনের চিয়াংসু প্রদেশের সুচৌ শহরে প্রতিষ্ঠিত একটি জেনারেল হাসপাতাল। এটি বর্তমানে হুয়াইহাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি তৃতীয়-স্তরের হাসপাতাল। সর্বাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সুবৃহৎ অবকাঠামো, বিস্তৃত পরিসরের সেবা, ইত্যাদি নিয়ে এ হাসপাতালটি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। এর চিকিৎসাসেবা চিয়াংসু প্রদেরর গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী শানতুং, হেনান ও আনহুইয়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং এই চারটি প্রদেশের প্রায় ২০টি শহর ও ১৪৭ কাউন্টির মানুষকে সেবা দিচ্ছি হাসপাতালটি।

সুচৌয়ের সরকারি হাসপাতালগুলোর বার্ষিক কর্মক্ষমতা মূল্যায়নে ২০১৭ সাল থেকে টানা ৫ বছর এই হাসপাতালটি শহরের একমাত্র সর্বোচ্চ স্তরের জেনারেল হাসপাতাল হিসাবে ‘এক্সিলেন্ট’ পুরস্কার অর্জন করেছে। ২০২১ সালে সর্বোচ্চ স্তরের হাসপাতালগুলোর জাতীয় মূল্যায়নে হাসপাতালটি ‘এ’ গ্রেড অর্জন করে। 

 সাড়ে ৪ হাজার শয্যার সুচৌ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে রয়েছে ৮৬টি ওয়ার্ড, ৩৭টি ক্লিনিকাল বিভাগ এবং ১৫টি চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রদেশ-পর্যায়ের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগ এবং ২২টি ক্লিনিক্যাল স্পেশালিটি। এই হাসপাতালে মোট কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার, যাদের মধ্যে ১ হাজারে বেশি জ্যেষ্ঠ পেশাদার উপাধিপ্রাপ্ত এবং ১ হাজার ৫০ জন ডক্টরেট ও মাস্টার্স ডিগ্রীধারী। তাদের মধ্যে আবার ৯জন রাষ্ট্রীয় পরিষদের বিশেষ ভাতাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ।

সুচৌ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে গড়ে উঠেছে এন্ডোস্কোপি ও স্বল্প আক্রমণাত্মক ওষুধ-সম্পর্কিত ৮টি জাতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি। এগুলো হলো ইউরোলজি বিভাগ, জেনারেল সার্জারি বিভাগ, অর্থোপেডিক বিভাগ, প্রসূতি ও গাইনোকোলজি বিভাগ, থোরাসিক সার্জারি বিভাগ, হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগ, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, এবং ইন্টারভেনটেরোলজি বিভাগ। এ হাসপাতালে রয়েছে ৪টি জাতীয় প্রদর্শন কেন্দ্র – ন্যাশনাল চেস্টপেইন সেন্টার, ন্যাশনাল হার্ট ফেইলিউর সেন্টার, ন্যাশনাল অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন সেন্টার এবং ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড স্ট্রোক সেন্টার। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসপাতালটি জিয়াংসু প্রদেশের ৩৫টি নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন-সংক্রান্ত পুরস্কার জিতেছে, যার মধ্যে ৯টি ছিল প্রথম পুরস্কার এবং ২৬টি দ্বিতীয় পুরস্কার। 

সুচৌ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে রয়েছে রাষ্ট্রীয় খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন-স্বীকৃত একটি জাতীয় পর্যায়ের ওষুধ পরীক্ষা কেন্দ্র। যেসব ক্ষেত্রের ওষুধের পরীক্ষা এখানে হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন, রেসপিরেটরি মেডিসিন, গাইনোকোলজি, নিউরোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি ও অনকোলজি মেডিসিন।


#ভেষজের গুণ

এত গুণ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুটের

 চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুট বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি ভেষজ, যা বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যবহার করা হয়। চীনা ভাষায় এ ভেষজকে বলা হয় হ্য শোউ উ। চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, যা চীন, মালয়েশিয়া ও জাপানে জন্মায়। 

লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা বাড়াতে এবং রক্ত পরিষ্কার করতে বিভিন্ন ট্রেডিশনাল ওষুধে ব্যবহৃত হয় চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুট। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর এই ভেষজ। এতে থাকা লেকটিন নামক রাসায়নিক উপাদান লিভারের জন্য খুব উপকারী।

চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুটে বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি শরীর থেকে বিষাক্ত ফ্রি র্যাডিকেল দূর করে শরীরকে বিষমুক্ত করে। ধমনীতে চর্বি ও কোলেস্টরল জমা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এ ভেষজ। চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুট রেসভেরাট্রলের একটি ভাল উৎস, যা প্রদাহ উপশম করে, হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে, রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়, অস্থিসন্ধির রোগ প্রতিরোধ করে, এবং কয়েক ধরনের ক্যান্সার ও কিডনি রোগ নির্মূল করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, চাইনিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার আলঝেইমার রোগের ঝুঁকিও কমায়। চুল পড়া রোধ, নতুন চুল গজানো এবং চুল বড় করার টিসিএম ওষুধে চায়নিজ ফ্লিস ফ্লাওয়ার রুটের নির্যাস ব্যবহার করা হয় শত শত বছর ধরে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।