বিল গেটস ও চীনের সম্পর্ক
2023-07-20 16:24:59

চৌদ্দ জুন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস আবার চীন সফর করেন। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম চীন সফরের পর ৩০ বছর পার হয়েছে। এই ৩ দশকে তিনি ১০ বারেরও বেশি চীন সফর করেন।

ওই সময় তিনি চীনে মাইক্রোসফটের ব্যবসা প্রসারের জন্য কাজ করেছেন, মাইক্রোসফট এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট খুলেছেন এবং তারপর বিভিন্ন দাতব্য প্রকল্পে সহায়তা করার জন্য বেইজিংয়ে গেটস ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিনিধি অফিস প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলা যায়, বিল গেটস যতবার চীন সফর করেন, তিনি স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আসেন এবং নতুন সুযোগও নিয়ে আসেন। তিনি চীনের ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং ইন্টারনেট অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের সাক্ষী।

টেবিল টেনিসের ভক্ত বিল গেটস ২০০৮ সালে তার পুরো পরিবারকে নিয়ে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা দেখতে আসেন। একই বছর চীনে গেটস ফাউন্ডেশনের প্রথম প্রকল্প শুরু করার জন্য তিনি মাইক্রোসফটে তার পূর্ণকালীন পদ ত্যাগ করেন।

১৯৯৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সী বিল গেটস তার অসাধারণ প্রতিভার গুণে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সেই বছর তিনি নতুন স্ত্রীকে নিয়ে চীন সফর করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল চীনে উইন্ডোজ ৯৫য়ের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলা।

২০০৩ সালে মাইক্রোসফটের ১০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিল গেটস আবার চীন সফর করেন। ওই বছর ছিলো চীন সরকারের সঙ্গে মাইক্রোসফটের সহযোগিতা পরীক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং পরবর্তী ১০ বছর মাইক্রোসফটের উন্নয়নের ধারা নির্ধারণ করার সময়ও বটে।

যদিও বিল গেটসের চীন সফরের লক্ষ্য ছিল অর্থোপার্জনের জন্য চীনা বাজারে প্রবেশ, তবে তিনি কখনোই চীনে ‘অর্থ ব্যয়’ও বন্ধ করেননি।

তার চীন সফরের প্রথম দশ বছরে তিনি কেবল মাইক্রোসফটের জন্য কাজ করেননি। ১৯৯৭ সালে চীন সফরকালে যখন তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন, তখন শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মুগ্ধ হন। তারপর তিনি হঠাৎ করেই আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে বেইজিংয়ে মাইক্রোসফটের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে ভারতে এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা ছিলো। এটিই বিদেশে মাইক্রোসফটের প্রথম গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

 ‘মাইক্রোসফটের ড্রিম ওয়ার্কস’ নামক বইয়ের ভূমিকায় বিল গেটস লিখেন, “১৯৯৭ সালে আমার চীন সফরের সময় চীনা শিক্ষার্থীদের মেধা, আবেগ ও সৃজনশীলতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাই ১৯৯৮ সালে বেইজিংয়ে একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিই আমরা।”

২০০২ সালে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাইক্রোসফটের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী মাইক্রোসফট চীনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা এগিয়ে নেওয়ার জন্য ২০ কোটি ইউয়ান রেনমিনপি অনুদান দেয়। ২০০৩ সালে মাইক্রোসফটের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট আবারও চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ কোটি ইউয়ান মূল্যের সফটওয়্যার অনুদান হিসাবে দেয়। ২০০৬ সালে মাইক্রোসফট এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাইক্রোসফট ইয়ং প্রফেসর অ্যাওয়ার্ড’ শিরোনামে কম্পিউটার-সম্পর্কিত প্রকল্প চালু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল তরুণ পণ্ডিতদের গবেষণাকে স্পনসর করা।

২০১৯ সালে চীন সফরকালে বিল গেটস যক্ষ্মা প্রতিরোধ ও চিকিত্সা বিষয়ক গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের সহযোগিতার দশম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সে সময় তিনি স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে চীনের বিশাল সাফল্য এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়া এবং বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন বেগবান করার ক্ষেত্রে চীনের অবদানের প্রশংসা করেন।

চলতি বছর বিল গেটস আবার চীন সফর করেন এবং আগের মতো চিকিত্সা, ওষুধ ও স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেন।

১৫ জুন তিনি বেইজিংয়ে গ্লোবাল হেলথ ড্রাগ ডিস্কাভরি ইন্সটিটিউট বা জিএইচডিডিআইতে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, গত চার বছরে নোভেল করোনাভাইরাস মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্ভিক্ষ বিশ্বের জন্য নজিরবিহীন স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন-চ্যালেঞ্জ নিয়ে এলেও তিনি এখনও আশাবাদী।

গেটস ফাউন্ডেশন আগামী পাঁচ বছরে জিএইচডিডিআইকে ৫ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বেইজিং মিউনিসিপ্যাল সরকারও একই পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও জিএইচডিডিআইয়ে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখবে। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়াসহ নানা সংক্রামক রোগের চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর এসব রোগের প্রভাব কমাতে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ওষুধ গবেষণা করতে এই তিন পক্ষ যৌথভাবে জিএইচডিডিআইকে সহায়তা দিয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, গেটস ফাউন্ডেশন বিল গেটস ও তার সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের যৌথ উদ্যোগে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক শ’ প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দেয় এই ফাউন্ডেশন। ২০২১ সালে বিল গেটস ও মেলিন্ডার মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হলেও তারা এই ফাউন্ডেশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ থেকে বোঝা যায়, এই ফাউন্ডেশন তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

আসলে ২০০৮ সালে গেটস ফাউন্ডেশন চীনে প্রথম প্রকল্প শুরু করার পর থেকে এই দাতব্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে চীনের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। এর পরের দশ বছরেরও বেশি সময়ে ফাউন্ডেশনটি চীনের সঙ্গে সহযোগিতার আওতা সম্প্রসারণ করেছে। এখন এ সহযোগিতার ক্ষেত্র দারিদ্র বিমোচন, যক্ষ্মা ও এইডস প্রতিরোধ ও চিকিত্সা, তামাক নিয়ন্ত্রণ, আফ্রিকার কৃষির উন্নয়ন এবং ম্যালেরিয়া নির্মূল পর্যন্ত বিস্তৃত।

চীনে বিল গেটস খুব জনপ্রিয় হচ্ছেন। ২০১৮ সালে তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বিল গেটসকে ‘চীনা জনগণের পুরানো বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বিল গেটস মনে করেন, এটা ছিল তার জন্য দুর্দান্ত প্রশংসা এবং তিনি এতে খুব খুশি হয়েছিলেন।