চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দেশ দুটির শীর্ষস্থানীয় কমকর্তারা ঘন ঘন যোগাযোগ ও বৈঠক করছেন। গত এক মাসেরও কমসময়ের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন চীন সফর করেন। তাদের ওই সফরে দু’দেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনের চীন সফরে যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর ফলে দু’দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে এমন একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে বেইজিংয়-ওয়াশিংটন সম্পর্ক সঠিক পথে ফেরার একটা ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় চীনের কেন্দ্রীয় বিদেশ বিষয়ক কার্যালয়ের পরিচালক ওয়াং ই ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে জাকার্তায় আসিয়ান সম্মেলনের সাইডলাইনে বৈঠক করেন। এক মাসেরও কম সময়ে এটা দুই কর্মকর্তার দ্বিতীয় বৈঠক। বৈঠকে তারা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পুনরায় একমত হন।
গত বছর বালিতে, দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা একটি ঐকমত্যে পৌঁছান, যাতে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশনা ছিল। কিন্তু, চীনের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের ভুল ধারণা এবং পদক্ষেপের কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালো না হয়ে আরও খারাপ হয়েছে।
শুধু চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভালোর জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের কল্যাণের জন্য বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের আর কোনও অবনতি কাম্য নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীন তার সদিচ্ছার প্রমাণ রেখেছে। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মতৈক্য ও নির্দেশনা মোতাবেক দু’দেশের সম্পর্ককে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে এখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক করণীয় রয়েছে।
বেইজিং বারবার বলে আসছে, দু’দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত চীনের মূল স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে সম্মান করা, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ এবং চীনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করা থেকে বিরত থাকা, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে চীনকে নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা ত্যাগ করা এবং চীনের ওপর আরোপিত অযৌক্তিক শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা
চীন-মার্কিন সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আনতে এবং উন্নয়ন করতে হলে, যুক্তরাষ্ট্রকে আগে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে হবে তাদের কোন কোন আচরণ দু’দেশের সম্পর্ককে নিম্নগামী করেছে। তারপর বালিতে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মতৈক্য এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে ওয়াশিংটনকে।
বাইডেন একাধিকবার অঙ্গীকার করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ চায় না, এটি চীনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যবস্থা পরিবর্তন করার লক্ষ্য রাখে না, ন্যাটো জোটের পুনরুজ্জীবন চীনকে লক্ষ্য করে নয়, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করে না এবং এটি চীনের সাথে কোনো প্রকার সংঘাত চায় না। বাইডেনের এ সব প্রতিশ্রুতি ওয়াশিংটন বাস্তবায়ন করে কিনা সেটাই মূলত এখন দেখার বিষয়।
বিশ্লেষকরাও বেইজিংয়ে এ প্রত্যাশার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। কার্টার সেন্টারের চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়াওয়েই লিউ মনে করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে কিনা- তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইয়েলেনের ট্রিপ দুই পক্ষের কথা বলার ভঙ্গুর প্রচেষ্টাকে সহায়তা করেছে, কিন্তু একইসঙ্গে সতর্ক করেছে যে ‘আরো এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ যদি- ‘টিট-ফর-ট্যাট’ ব্যবস্থা থেকে সরতে না পারে তাহলে- আলোচনা যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে।
বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মানবতার ভবিষ্যত এবং ভাগ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন সবসময়ই পর্যাপ্ত আন্তরিকতা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য, আলোচনার জন্য, যেটি একটি ক্রান্তকিালে এসে দাঁড়িয়েছে।
মার্কিন জলবায়ু দূত জন কেরির আসন্ন সফর এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডোর সম্ভাব্য সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার করতে পারে। কিন্তু ওয়াশিংটন যদি দ্বৈত আচরণের পুরানো কৌশল গ্রহণ করে এবং চীনকে আটকাতে চায় তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অতল গহ্বরে পতিত হবে- এ আশঙ্কা থেকেই যায়।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।