লাওসে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ
2023-07-14 14:51:01

জুলাই ১৪: এই গ্রীষ্মে, যখন লাওসের শিক্ষার্থীরা চীন-লাওস রেলপথের ‘লানছাং’ ট্রেনে চড়ছিলেন এবং ‘ট্রেনে বিশ্বকে দেখার’ আনন্দ উপভোগ করেছিলেন, তখন তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি যে, যারা চীন-লাওস রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের দুই বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া ক্লাস্টার বোমা পরিষ্কার কর্রতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লাওসে মার্কিন সামরিক বাহিনী এই বোমাগুলো ফেলেছিল।

মার্কিন সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, তারা ইউক্রেনকে ৮শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা দেবে। এই সহায়তার মধ্যে রয়েছে গণবিধ্বংসী ক্লাস্টার বোমা, যা মার্কিন আইনে নিষিদ্ধ হিসাবে তালিকাভুক্ত। ক্লাস্টার বোমার জন্য মার্কিন সহায়তা ভিয়েতনামের সেই সময়ের মানুষের স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলোকে যুদ্ধে প্ররোচিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো ইউক্রেনে বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, ‘ক্লাস্টার বোমার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কনভেনশন’-এ স্বাক্ষরকারী একটি দেশ হিসাবে ব্রিটেন এই ধরনের অস্ত্রের ‘ব্যবহারকে উত্সাহিত করে না’। স্পেন, কানাডাসহ অন্যান্য দেশও এই অস্ত্রের ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।

১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত চলমান ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও পূর্ব কম্বোডিয়াতে বিপুল পরিমাণ ক্লাস্টার বোমা ফেলেছিল। এসব বোমায় সবচেয়ে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল লাওস।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপাত্তে দেখা যায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র লাওসে ৫ লাখ ৮০ হাজার বার বোমা হামলা চালিয়েছিল। ওইসব হামলায় ক্লাস্টার বোমাসহ ২০ লাখ টনেরও বেশি বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। লাওসে প্রায় ৮ কোটি মার্কিন ক্লাস্টার বোমা অবিস্ফোরিত থেকে যায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অবিস্ফোরিত বোমার ১ শতাংশেরও কম পরিষ্কার করা হয়েছে। এসব অবিস্ফোরিত বোমার কারণে প্রায় ২০ হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোক আহত হয়েছে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লাওসের অবিস্ফোরিত বোমা পরিষ্কার করতে একশ’ বছর সময় লাগতে পারে।

অবস্থাকে আরও খারাপ করার বিষয় হলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্লাস্টার বোমা ছিল উজ্জ্বল কমলা রঙের। তারা বলেছিল যে, ভবিষ্যতে সেগুলো খুঁজে পাওয়া সহজ হবে এবং এটিকে ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ বলা হয়। কিন্তু উজ্জ্বল কমলা রঙের ‘বলগুলো’ স্থানীয় কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের আকৃষ্ট করেছিল খেলনা হিসাবে সেগুলোকে গ্রহণ করতে, যা আরও ট্র্যাজেডি ঘটায়।

শুধু লাওসে নয়। গত প্রায় ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র কসোভো যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে। এমনকি কসোভোতে ন্যাটো সৈন্যরা এই ধরনের ‘অবিস্ফোরিত বোমা’ পরিষ্কার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ক্লাস্টার বোমাগুলো তাদের আবিস্কারের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার থেকে ৮৬ হাজার বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছে। নিহতদের ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক, যাদের মধ্যে অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ১৯৮৭ সালে তৈরি এম৮৬৪ ক্লাস্টার বোমা সরবরাহ করেছিল। পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র দাবি করেন, এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভুল ফায়ারের হার ২ দশমিক ৩৫ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, ২০ বছর আগে পাবলিক মূল্যায়নে পেন্টাগনও বলেছিল যে, এই ধরনের অস্ত্রের ভুল ফায়ারের হার ৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিটি বোমার ৭২টি অংশের মধ্যে অন্তত ৪টি অবিস্ফোরিত থাকবে।

২০০৮ সালে মার্কিন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, দেশটির সামরিক বাহিনী আর ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করবে না এবং সকল ক্লাস্টার বোমা বন্ধ করে রাখা হবে। কিন্তু আজ ইউক্রেনে পাঠানো বোমা ঠিক ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে উত্পাদিত এবং ১৫ বছর আগে বন্ধ করে রাখা ক্লাস্টার বোমা।

এক বছর আগে হোয়াইট হাউসের তত্কালীন প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছিলেন যে, ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করা হলে যুদ্ধাপরাধ হতে পারে। মাত্র এক বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের নিন্দার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সামনে নৈতিকতার মূল্য কত?

(জিনিয়া/শিহাব/শুয়েই)