চীনের সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াং পাহাড়ের ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল প্রসঙ্গ
2023-07-10 15:05:24

চীনের সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াং পাহাড়ের চাওচুয়ে জেলার লেয়ার গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের আরেকটি ডাক নাম ‘ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল’। কারণ এ স্কুল তালিয়াং পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। আর এই পাহাড়ি গ্রামটি চাওচুয়ে, লেইপো ও মেইকু—এই তিনটি জেলার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক কঠোর। ক্লিফ গ্রামের লোহাসিড়ির নিচে নির্মিত এ স্কুলটি।

 

চলতি বছরের মে মাসে এ স্কুল অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। স্কুলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক কাও চুয়ান স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কার্যকলাপের মোট ২৫৭টি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। এসব ভিডিও ক্লিপ নেটিজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। টানা ৫ বছর ধরে ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে কাজ করার পর শিক্ষক কাও ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কাও এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীদের গল্প তুলে ধরবো।

২০১৮ সালে শিক্ষক কাও চুয়ান চাওচুয়ে জেলার অদূরে ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে যোগ দেন। গত ৫ বছরে তিনি ২৫৭টি ভিডিও শুট করেন। এসব ভিডিওতে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের চমত্কার জীবন রেকর্ড করেন তিনি। চলতি বছরের মে মাসে এ স্কুল নতুন জায়গায় স্থানান্তর করা হয় এবং স্কুলের পুরনো ঠিকানাও ইতিহাসে পরিণত হয়। শিক্ষক কাও ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নেন। তিনি গত ৫ বছরের শিক্ষকতার জীবনের অভিজ্ঞতা সাংবাদিকদের সাথে শেয়ার করেন।

 

শিক্ষক কাওয়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায় অনেক ছাত্রছাত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছে। আসলে, তারা শুধু শিক্ষক কাওয়ের সঙ্গ চায়। তাই তাঁর হাত ধরে তারা অনর্থক সব প্রশ্ন করে চলে। কয়েকটি মেয়ে খেলার মাঠে বসে কাওয়ের চুলে বিনুনি বানায়। ভিডিও পোস্টের সময় শিক্ষক কাও লেখেন, ‘যদিও সারাদিন ধরে ছাত্রছাত্রীদের সাথে সময় কাটানো একটু ক্লান্তিকর, তবে তাদের হাঁসিমুখ দেখে ভালো লাগে।’

 

২০১৮ সালে যখন লেয়ার প্রাথমিক স্কুলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন শিক্ষক কাও। যদিও চাওচুয়ে জেলা তাঁর জন্মস্থান, তবে ক্লিফ গ্রামের এ প্রাথমিক স্কুল দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এটা তাঁর জন্যও বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তবে এ প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চেহারা দেখে তাঁর উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।

 

স্কুলের প্রথম দিন শিক্ষক কাও সাদা স্কার্ট পরে আসেন। তখন ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে দেখে ‘পরী’ বলে ডাকে। তারা মনে করে, শিক্ষক কাও পরীর মতো সুন্দর। সেই কথা স্মরণ করে শিক্ষক কাওয়ের মুখে হাসি ফোটে।

 

ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল চাওচুয়েসহ তিনটি জেলার সংযোগস্থলে অবস্থিত। তাই আশেপাশের বাচ্চারা সবাই এ স্কুলে ভর্তি হয়। তবে তালিয়াং পাহাড় দ্বারা ঘেরা এই স্কুল। তাই আশেপাশের বাচ্চাদের জন্য স্কুল থেকে বাসায় আসা-যাওয়ার রাস্তা সবই পাহাড়ি। সেই জন্যে এ প্রাথমিক স্কুল বোর্ডিং স্কুলের মতো চালু হয়েছে। বাচ্চারা স্কুলে দিনরাত শিক্ষকদের সাথেই জীবনযাপন করে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষক আত্মীয়স্বজনের মতো ঘনিষ্ঠ। কেবল স্কুলে লেখাপড়া করতে নয়, বরং শিক্ষকদের কাছ থেকে জীবনযাপনের তত্ত্ব ও বিভিন্ন দক্ষতাও তারা শিখতে পারে।

 

২০১৬ সালে শিক্ষক কাও চুয়ান চাওচুয়ে জেলার একটি কিন্ডারগার্ডেনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পর তিনি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পরীক্ষা পাস করে ক্লিফ গ্রামের এ স্কুলে চাকরি পান। শিক্ষকের কাজ বেছে নেওয়ার মূল কারণ তিনি বাচ্চাদের পছন্দ করেন। তা ছাড়া, দূরবর্তী এলাকার স্কুলে ভালো শিক্ষকের ব্যাপক অভাব। তিনি সেই অবস্থারও পরিবর্তন চান।  পাশাপাশি, নিজের জন্মস্থানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করা তাঁর কাছে আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

 

শুরুর দিকে এ স্কুলে মাত্র ৭ জন শিক্ষক ছিলেন। প্রত্যেক শিক্ষককে একটি ক্লাসের চীনা ভাষা ও গণিত ক্লাস নিতে হতো। শিক্ষক কাওকে প্রিস্কুল পর্যায় থেকে পড়াতে হতো। ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা কাওকে অনেক সুন্দর সুন্দর নামে ডাকে। কেউ  তাঁকে ডাকে ‘সুন্দরী কাও’, কেউ ‘বাঘিনি কাও’, কেউ কেউ আবার তাকে ‘মা’ বলেও ডাকে।

 

একজন তরুণীর কাছে ‘মা’ ডাক একটু অস্বাভাবিক। কাও-ও শুরুতে অবাক হয়েছিলেন। একদিন ছাত্র চিখ্যউচিয়া’র বাবা হঠাত মারা গেলেন। ছেলে এ খবর শুনে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে ফিরে যায়। শিক্ষক কাও এ খবর জেনে শুক্রবার স্কুলের পর ছেলের সাথে বাড়িতে যান। তার বাড়িতে ছোট ভাই-বোন আছে। তাই ছেলে কান্নাকাটি করেনি। তবে সে শিক্ষক কাওকে ‘মা’ বলে ডাকে। সেই সময় ছেলের চোখে পানি দেখেন কাও। তাঁর চোখ জল আসে।

 

ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বয়স কম। তাই মজা করে ভিন্ন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেন তারা। স্কুলে বাচ্চাদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। তাদের পড়াশোনার আগ্রহও বেশি। ২০২১ সালের শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষায় শিক্ষক কাওয়ের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের গড় স্কোর এ জেলার বিভিন্ন স্কুলের মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিল। শিক্ষক কাও এ সাফল্য উদযাপন করতে সবার জন্য দুধ-চা তৈরি করেন। সবাই আনন্দের সাথে চা পান করে এবং তারা আগামী পরীক্ষায় আরও ভালো করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

 

জন্মদিনের কেক খাওয়ার দৃশ্যও শিক্ষক কাওয়ের ভিডিওতে নিয়মিত দেখা যায়। তিনি নিয়মিত ক্লাসের বাচ্চাদের জন্মদিন উদযাপন করেন। প্রথমবারের জন্মদিনের পার্টি ছিল প্রিস্কুলের ক্লাসে। সেই সময় শিক্ষক কাও কালো বোর্ডে একটি জন্মদিনের কেক আঁকেন। তালিয়াং পাহাড়ের বাচ্চাদের জন্য জন্মদিন উদযাপন করা একটি নতুন বিষয়। সংখ্যালঘু জাতির বাচ্চারা কখনও এমন রীতিনীতির সাথে পরিচিত নয়। তারা আগে কখনও জন্মদিনের কেক খায়নি। স্থানীয় গ্রামের বাচ্চারা সবাই ঝাল খাবার খেতে পছন্দ করে। তাই তাদের কল্পনায় জন্মদিনের কেকের স্বাদও ঝাল। সেই বছর শিক্ষক কাও তিনটি বড় জন্মদিনের কেক কেনেন। এভাবে ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী কেকের মিষ্টি স্বাদ অনুভব করতে পারে।

 

বাচ্চারা কেক খাওয়ার পর তাঁকে বলে যে, এর স্বাদ বেশ মিষ্টি এবং বাচ্চাদের কথা শুনে শিক্ষক কাওয়ের মুখেও মিষ্টি হাসি দেখা যায়। প্রতিবছর বাচ্চাদের সাথে জন্মদিন কাটানোর প্রতিশ্রুতি দেন শিক্ষক কাও। পরে শিক্ষক কাওয়ের জন্মদিনে বাচ্চারাও আনন্দ করে। বাচ্চাদের কাছে জন্মদিনের কেক কেনার টাকা নেই। তারা নিজেদের খাওয়া স্টিমড বানের অর্ধেক অর্ধেকটা নিয়ে একটি জন্মদিনের কেক তৈরি করে। সেটি ছিল শিক্ষক কাওয়ের জন্য সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্মদিনের কেক।

 

ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক কাওয়ের ক্লাসে মোট ৭০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে আসার পথে হাঁটাহাঁটি করে তিনি বাচ্চাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারেন। ক্লিফ গ্রামের স্কুলের প্রথম কর্মদিবসের কথা স্মরণ করে শিক্ষক কাও বলেন, এ স্কুলে পৌঁছাতে উঁচু সিড়ি অতিক্রম করতে হয়। তিনি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে বেশ ভয় পান। তবে ইস্পাতের তৈরি সিঁড়ি ছিড়বে না—এই বলে তিনি নিজেকে প্রবোদ দেন। সিঁড়িতে ওঠার কিছুক্ষণ পর তিনি খেয়াল করেন, চারিদিকে কেবল ক্লিফ ও পাহাড়। পাহাড়ের অপর দিকেও পাহাড়। সেখানে কিছু গ্রাম দেখা যায়। অনেক বাচ্চা দূরের সেসব গ্রাম থেকে হেঁটে স্কুলে পড়াশোনা করতে আসে। তিনি অবাক হন।

 

২০২৩ সালের মে মাসে ক্লিফ গ্রাম পাহাড়াঞ্চল থেকে স্থানান্তর করা হয়। গ্রামবাসীরা সবই জেলায় নতুন বাড়িঘর পেয়েছে। সেই সময় প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রীকেও ক্লিফ গ্রামের স্কুল থেকে স্থানান্তর করা হয়। তখন থেকে ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল ঐতিহ্যিক চিহ্নে পরিণত হয়েছে।

 

অতীতে ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চারা তৃতীয় শ্রেণী পাস করার পর জেলার প্রাথমিক স্কুলের পরীক্ষা দিয়ে সেখানে যেতে চাইত। তবে, শিক্ষক কাও আসার পর তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা কেউ জেলার স্কুলে যেতে চাইত না। তারা মনে করে, শিক্ষক কাও প্রিস্কুল পর্যায় থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সবসময় মায়ের মতো তাদের পাশে আছেন। তাই তারা জেলার প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা করতে চায় না। মেয়ে ছিরিলুও খুবই অন্তর্মুখী। সে শিক্ষক কাওকে বলল, “আপনি আমার আপন মায়ের মতো। আপনাকে ছেড়ে আমি যেতে চাই না।” শিক্ষক কাও তাকে বলেন যে, স্নাতক হওয়ার পর সবাইকেই নতুন স্কুলে যেতে হবে। ভালো করে পড়াশোনা করে একদিন চাওচুয়ে জেলার স্কুলে ভর্তি হতে তাদের উত্সাহ দেন কাও।

 

তাঁর ক্লাসের দু’জন ছেলে চীনা ভাষা পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সময় প্রবন্ধের জায়গায় কিছু লিখেনি। এ কারণে জেলার স্কুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ স্কোর করতে তারা ব্যর্থ হয়। শিক্ষক কাও তাদের জিজ্ঞেস করেন, কেন তোমাদের পরীক্ষার ফল এতো খারাপ হলো? তারা জবাব দেয়, আমাদের স্কোর যথেষ্ঠ ভালো না হলে জেলার স্কুলে যাওয়া যাবে না। আমরা আপনার ক্লাসে থাকতে পারব। বাচ্চাদের কথা শুনে তাঁর চোখে পানি আসে।

 এবার ক্লিফ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল জেলায় স্থানান্তর করা হয়েছে। সবার কাছে থেকে শিক্ষক কাওকে বিদায় নিতে হবে। সেটি সবার জন্য দুঃখের ব্যাপার। তবে নতুন ক্লাসে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা আরও ভালো, সেটি বাচ্চাদের জন্য কল্যাণকর, এই ভেবে শিক্ষক কাও আনন্দিত হন।

 

বিদায় নেওয়ার আগে শিক্ষক কাও আরেকটি ভিডিও তৈরি করেন। তিনি বাচ্চাদের বলেন, “আমরা সাময়িকভাবে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। তোমাদের কাছে আমার ফোন নম্বর আছে। ভবিষ্যতে আমাদের আবার মিলনের সুযোগ হবে। তোমরা ভালো করে লেখাপড়া করো।” এরপর সবাই একসাথে কেক খেয়ে, গান গেয়ে সুন্দর শেষ ক্লাসটি শেষ করে।

 

চলতি বছরের ১৪ মে স্কুলে বিদায়ী অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। শিক্ষকরা মোট ১৮০টি কেক কিনে একটি বড় পার্টির আয়োজন করেন। সবাই খেলার মাঠে বসে পার্টিতে যোগ দেয় এবং পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাচ্চারা কেঁদেকেটে কাওকে বিদায় জানায়। তিনি প্রত্যেক বাচ্চাকে সান্ত্বনা দেন, আদর করেন। তাঁর জন্য ৫ বছরের ক্লিফ গ্রামের স্কুলের জীবন বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ।

 

শেষ ভিডিওতে তিনি বাচ্চাদের সাথে ফোনালাপের ওডিও যুক্ত করেন। এখন প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে বাচ্চারা নতুন স্কুল থেকে চাওচুয়ে জেলার শিক্ষক কাওয়ের বাড়িতে যায়। এভাবে তারা আগের মতো একসাথে সুন্দর ও আনন্দময় সময় কাটায়। সেটি শিক্ষক কাওয়ের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার, বাচ্চাদের জন্যও।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)