যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চীন সফরের তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ৬ জুলাই চারদিনের সফরে বেইজিং আসেন দেশটির অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন। তাইওয়ান ও বাণিজ্য ইস্যুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান বিরোধের প্রেক্ষাপটে ব্লিঙ্কেনের সফর ছিল কয়েকমাসের মধ্যে দু’দেশের প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। তার পরপরই অর্থমন্ত্রী জ্যানেটে ইয়েলেনের চীন সফর উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
সফরকালে মার্কিন অর্থমন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং, উপপ্রধানমন্ত্রী হ্য লিফেং, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ হ্য এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর ই কাংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই সব বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মার্কিন অর্থমন্ত্রী তার দেশের পক্ষ থেকে নানাভাবে চীনা কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন।
৭ জুলাই জ্যানেট ইয়েলেন বেইজিংয়ে মহাগণভবনে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লি বলেন, বিশ্বের একটি সাধারণভাবে স্থিতিশীল চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন। দু’দেশের একসঙ্গে থাকার সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া মানবতার ভবিষ্যতের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
লি বলেন, গত বছর দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বালিতে সাক্ষাৎ করেন এবং চীন- যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পথ নির্ধারণ করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জয়-জয় সহযোগিতা দ’দশের সম্পর্ক এবং একসঙ্গে চলার মূলভিত্তি বলে তারা মতৈক্যে পৌঁছান।
চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত উল্লেখ করে লি বলেন যে, পারস্পরিক সুবিধা চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মূলকথা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক, এবং সহযোগিতা জোরদার করা উভয় পক্ষের বাস্তবসম্মত চাহিদা এবং সঠিক পছন্দ। চীনের উন্নয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জের পরিবর্তে একটি সুযোগ এবং ঝুঁকির পরিবর্তে লাভ বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী লি।
তিনি সতর্ক করে বলেন, অর্থনৈতিক সহযোগিতার রাজনীতিকরণ করা বা এ ধরনের সহযোগিতার ওপর নিরাপত্তা ইস্যুকে চাপিয়ে দেওয়া দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য ভালো কিছু নয়।
লি উভয়পক্ষকে যোগাযোগ জোরদার করার এবং অকপট, গভীর ও বাস্তবসম্মত বিনিময়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক বিষয়ে ঐকমত্য খোঁজার এবং সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আনার আহ্বান জানান।
ইয়েলেন চীনা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সরবরাহ চেইনকে বিঘ্নিত করার কোনো চেষ্টা করছে না এবং চীনের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই ওয়াশিংটনের।
বালিতে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে সমঝোতা বাস্তবায়নে, যোগাযোগ জোরদার করতে, মতপার্থক্যের কারণে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা জোরদার করতে এবং দুই অর্থনীতির মধ্যে পারস্পরিক সুবিধা খোঁজার ইচ্ছা প্রকাশ করেন মার্কিন অর্থমন্ত্রী।
মার্কিন অর্থমন্ত্রীর এ সফরকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন সুচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ার অধ্যাপক ভিক্টর কাও। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের মধ্যে জ্যানেট ইয়েলেন চীন-মার্কিন সহযোগিতার মূল্যায়নে সবচেয়ে ‘গঠনমূলক’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, যা তার চীন সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
অধ্যাপক কাওয়ের বিশ্লেষণ, অর্থমন্ত্রী জ্যানেটে তার সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে নিয়ে এসেছেন তা এ ইঙ্গিত দেয় যে দেশটির সরকার চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের মধ্যে বিনিময়কে আর বিঘ্নিত করতে চায় না।
ওয়াশিংটনের বাণিজ্য-বিরোধী নীতিগুলো কেবল চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও ক্ষতি করে। সাপ্লাই চেইনের উপর প্রভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন মার্কিন ভোক্তারাও।
অধ্যাপক কাও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনও প্রলম্বিত মুদ্রাস্ফীতির পরিণতি ভোগ করছে, এবং এর একটি কারণ হল চীনা রপ্তানির উপর মার্কিন সরকারের শুল্ক আরোপ। এটা মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত মার্কিন ভোক্তাদের আর জর্জরিত করছে।
অধ্যাপক কাও বলেন, এখন সময় এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঠিক কাজটি করার, এবং চীনের জন্য সময় এসেছে চীনে মার্কিন রপ্তানির উপর আরোপিত শুল্ক অপসারণের মাধ্যমে প্রতিদান দেওয়ার।
অধ্যাপক কাও বলেন, চীনকে নিন্দা-মন্দ করে আনন্দ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনও লাভ নেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন আজ একটি বড় ফ্যাক্টর। মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতির মন্দাদশা কাটাতে চাইলে চীনের সহযোগিতা লাগবে যুক্তরাষ্ট্রের । দেশটির সরকার সম্ভবতো বিষয়টি বুঝতে পেরেছে- অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনের সফরে এর খানিকটা আভাস মিলেছে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।