চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-২৪
2023-07-08 15:52:42

এক নজরে চীনের সংস্কৃতি-সপ্তাহ

পয়লা জুলাই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসি’র ১০২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর প্রাক্কালে বেইজিংয়ে সিপিসি জাদুঘরে একটি সিম্ফনি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়।

কনসার্টে সিপিসি সদস্য, জাতীয় পদক এবং সম্মানসূচক খেতাব বিজয়ী, ছাত্র এবং বেইজিংবাসীসহ প্রায় ৮০০ জন অংশ নেন।

চারটি অংশ নিয়ে গঠিত, কনসার্টে ২৩টি বাদ্যযন্ত্রের বাজনা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং চীনের জাতীয় সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা, চায়না ন্যাশনাল অপেরা হাউস এবং চীনের ন্যাশনাল ব্যালের মতো একাধিক অর্কেস্ট্রা এবং থিয়েটার কোম্পানি এতে পরিবেশনা করে।

এদিকে, চায়না মিডিয়া গ্রুপ সিএমজির উদ্যোগে ‘তৃতীয় চীন-ইউরোপ মিউজিক ফেস্টিভাল’ অর্থাৎ চীন-স্পেন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকীর কনসার্ট’ আয়োজন করা হয়। স্পেনের বৃহত্তম রেডিও ও টেলিভিশন সংস্থা-স্পেনের জাতীয় টেলিভিশনের চ্যানেল দুই-এ তা প্রচারিত হয়েছে। স্পেনের বেশ কিছু প্রধান গণমাধ্যম এ খবর প্রচার করেছে।

চায়না মিডিয়া গ্রুপ টানা তৃতীয় বছরের মত চীন-ইউরোপ মিউজিক ফেস্টিভাল আয়োজন করে। কনসার্টে স্পেন ও চীনের শিল্পীরা দু’দেশের ক্ল্যাসিকাল মিউজিক পরিবেশন করেন।

দুই. জাতিসংঘে সিএমজির সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী

চায়না মিডিয়া গ্রুপ-সিএমজি এবং জাতিসংঘের যৌথ আয়োজনে বিশ্বসংস্থার নিউইয়র্ক সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘জার্নি থ্রু সিভিলাইজেশান’ নামে একটি নতুন সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী। এতে চীনের ৫ হাজার বছরের সভ্যতার সাংস্কৃতিক নিদর্শন প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনীটি ব্যাপক সাড়া ফেলে দর্শনার্থীদের মাঝে।

২৯ জুন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় চীনা সভ্যতার ৫ হাজার বছরের নির্বাচিত কিছু সাংস্কৃতিক নিদর্শনের ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনীটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে চীনের অমূল্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তুলে ধরাই এ প্রদর্শনীর লক্ষ্য।

জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি চাং চুন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিশিষ্টজন এবং আগ্রহী দর্শনার্থীদের নিয়ে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে চাং চুন বলেন:

 ‘সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে, চীনা সভ্যতা ক্রমাগত নতুন প্রাণশক্তি অর্জন করছে এবং একই সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছে’।

প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময়, সিএমজির প্রেসিডেন্ট শেন হাইশিওং ভিডিওতে যুক্ত হয়ে প্রদর্শনীর গুরুত্ব তুলে ধরেন।

 ‘সভ্যতার উচিত বিশ্বের সাধারণ মঙ্গল সাধন করা। বিশ্বের একমাত্র নিরবচ্ছিন্ন সভ্যতা হিসাবে, চীনা সভ্যতা ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সভ্যতা’।

প্রদর্শনীটি কেবল প্রাচীন চীনা দক্ষতা যেমন ক্যালিগ্রাফি, আকুপাংচার এবং চা তৈরির মতো বিষয়কে প্রদর্শন করে না, বরং বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বোঝাপড়ার বার্তাও প্রচার করে। একে অপরের সম্পর্কে আরও জানার মাধ্যমে, বিবদমানপক্ষ দ্বন্দ্ব কমাতে পারে এবং সমঝোতার জন্য আরও সুযোগ তৈরি করতে পারে।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগের বহিঃসংযোগ শাখার পরিচালক মাহের নাসের মনে করেন বিভেদের বিশ্বে সংস্কৃতিই কেবল আমাদের পথ দেখাতে পারে।

 ‘আমি প্রদর্শনীর ভার্চুয়াল সংস্করণটি দেখেছি। আমি একই সময়ে সংস্কৃতি, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক মিলের বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। আমি মনে করি বিশ্ববাসীকে মিলিত করতেই জাতিসংঘ তৈরি করা হয়েছিল। আমরা আলাদা হতে পারি, কিন্তু আমরা সমস্যার সমাধানও করতে পারি। যদি আমরা একত্রিত হই তবে, সংস্কৃতিই আমাদের পথ দেখায়’।

চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন-সিসিটিভির জাতিসংঘ ব্যুরো পরিচালিত এবং জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী মিশন, চীন-আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউএনএসআরসি চাইনিজ বুক ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় ৯দিনব্যাপী  প্রদর্শনীটি শেষ হয় ৭ জুলাই।

তিন. চিরায়ত চিনা সাহিত্য

চীনের পল্লী-জীবনের রূপকার কবি থাও ইয়ুয়ানমিং

চিরায়ত চীনা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি থাও ইয়ুয়ানমিং। তাকে বলা হয় শান্ত গ্রাম-জীবনের রূপকার। থাও ইয়ুয়ানমিং থাও ছিয়ান নামেও পরিচিত।

থাও ইয়ুয়ানমিংয়ের জন্ম ৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান চিয়াংসি প্রদেশের চিউচিয়াং সিটির কাছে ছাইসাং নামের পার্বত্য জনপদে। তখন পূর্ব চিন রাজবংশের(৩১৭-৪২০) শাসনকাল চলছে। জন্মসাল ৩৬৫ বলা হলেও সেটি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। তার জীবনীকার উল্লেখ করেছেন তখন সম্রাট আই এর শাসন চলছে। চীনা পন্ডিত ইয়ুয়ান সিংপাই অবশ্য মনে করেন থাও এর জন্মসাল ৩৫২ খ্রিস্টাব্দ।

এক অভিজাত পরিবারে থাও এর জন্ম। তাদের পরিবারের বাসস্থান ছিল ছাইসাং গ্রামে। এখানে রয়েছে লু পর্বত এবং ফোইয়াং লেক। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। থাও এর কবিতায় তার ছায়া পড়েছে ।

শৈশবে বাবাকে হারান থাও। এতে তাদের পরিবার কিছুটা অর্থকষ্টে পড়ে। তবে এই দারিদ্র্য তার লেখাপড়া চালিয়ে যাবার দৃঢ় সংকল্পে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। কনফুসিয়াসের চিরায়ত দর্শন থেকে শুরু করে অনেক রকম বই তিনি পড়েন। চীনা দার্শনিক লাওসি এবং চুয়াংসির দর্শন তাকে প্রভাবিত করে।

২৯ বছর বয়সে তিনি সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রশাসক ধরনের চাকরি করতেন। পরবর্তি ১৩ বছর তার চাকরি জীবনে অনেক উত্থান পতন ঘটে। ৪১ বছর বয়সে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন কয়েক মুঠো ভাতের জন্য আর মাথা নোয়াতে ভালো লাগছে না। প্রকৃতপক্ষে ক্ষোভ, হতাশা ছিল- কিছুটা কর্তৃপক্ষ কিছুটা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতি।  শাসকদের চাটুকারিতা করতে পারতেন না তিনি।

তার জীবদ্দশায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও টালমাটাল ছিল। দুটি বিদ্রোহ ঘটে। আর জীবনের শেষ দিকে তিনি পূর্ব চিন রাজবংশের পতন দেখেন।

তিনি চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন পারিবারিক বাসস্থান ছাইসাং গ্রামে। এখানে শান্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেন বাকি জীবন। বেছে নেন সন্ন্যাসীর জীবন। ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির মৃত্যু হয়।

থাও তার কবিতায় প্রকৃতি, গ্রামীণ জীবন, কৃষকের পরিশ্রম, ফসল ফলানোর আনন্দ, শান্ত জীবনের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। সন্ন্যাসী জীবনের শান্তিও তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তার কবিতার চিত্রকল্প অসাধারণ।

‘কৃষকের জীবনে ফিরে আসা’  শিরোনামে তিনি পাঁচটি সিরিজ কবিতা লেখেন। এর একটি শোনাচ্ছি-

দক্ষিণ পাহাড়ের নিচে আমি মটর ও শিম চাষে রত

আগাছায় কোমল অঙ্কুরগুলো বিক্ষিপ্ত ও শীর্ণ মাথানত

ঊষালগ্নে উঠে আমি দ্রুত হাতে জমির আগাছা নিড়াই

সান্ধ্য চাঁদের আলোয় কোদাল কাঁধে বাড়ি ফিরে যাই।

দীর্ঘ ঘাসে ভরা সরু পথ ধরে আমি ধীরপায়ে হাঁটি

সন্ধ্যার শিশির ভিজিয়ে এলোমেলো করে পোশাক পরিপাটি

আমার বেশবাস নিয়ে আর আমি চিন্তা করি না আগের মতো

লালিত উচ্চাকাংক্ষা সব হয়েছে বিগত।

থাও ইয়ুয়ানমিং তার কবিতায় চীনা গ্রামের ও প্রকৃতির যে চিরন্তন ছবি এঁকেছেন তার চিরায়ত চীনা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন অধিকার করে রয়েছে।

---------------------------------------------------------------------------

প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: শান্তা মারিয়া, মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।