মিয়াও জাতি সুন্দর জীবন বুনছে
2023-07-05 09:42:28

চীনের সংখ্যালঘু জাতি- মিয়াও জাতির সূচিকর্ম, তাদের অভিবাসনের সময় জন্ম নেয়। হাজার বছরের মিয়াও জাতির মানুষ সুই ও সূতা দিয়ে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি তাদের পোশাকে রচনা করে আসছে। তাই মিয়াও জাতির সূচিকর্মকে জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়।

 

কুই চৌ প্রদেশ, মিয়াও জাতির অধ্যুষিত এলাকা। কুই চৌ তে প্রচলিত আছে মিয়াও সূচিকর্মের ২০টিরও বেশি পদ্ধতি। ২০০৬ সালে মিয়াও জাতির সূচিকর্মকে প্রথম জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ জাতির ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে উন্নত করছে মিয়াও জাতির মানুষরা। নারীরা সুই দিয়ে সেলাই করে টাকা উপার্জন করছে এবং সুন্দর জীবন তৈরি করেছে।

 

কুই চৌ প্রদেশের পি চিয়ে শহরে একটি মিয়াও জাতির গ্রামে রয়েছে একটি লাইভ অনুষ্ঠানের স্টুডিও। মিয়াও জাতির এক যুবতী মেয়ে জাতীয় পোশাক পরে স্টুডিওতে লাইভ অনুষ্ঠান করছে। সে ম্যান্ডারিন, কুই চৌর আঞ্চলিক ভাষা ও মিয়াও জাতির ভাষায় পণ্যের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ইয়াং ওয়েন লি নামের এই মেয়ে ২০১৭ সালে গ্রামে ফিরে সূচিকর্মের ব্যবসা শুরু করে। ২০২২ সালে তার কোম্পানির উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ইউয়ান। তার উদ্যোগে গ্রামের ২০টি মেয়ে এখন সূচিকর্ম করছে। গেল বছর লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ৬ লাখ ইউয়ান মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে, সর্বোচ্চ এক দিনে ৮০ হাজার ইউয়ানের পণ্য বিক্রি হয়েছে। ইয়াং ওয়েন লি জানান, সম্প্রতি তিনি লাইভ করার জন্য কিছু নতুন সরঞ্জাম কিনেন এবং যুবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে গ্রামে আরও বেশি মানুষ তার মতো অনলাইনে পণ্য বিক্রি করতে পারবে।

 

১০ বছর আগে থেকে কুই চৌ সরকার মিয়াও জাতির সূচিকর্মের মাধ্যমে নারীদের আয় বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে। ২০১৩ সালে কুই চৌ প্রদেশের নারী ফেডারেশন ‘চিন সিউ’নামে একটি উদ্যোগের মাধ্যমে ১ লাখের বেশি মানুষকে সূচিকর্ম ও টাই-ডাই (tie-dye)সহ নানা প্রশিক্ষণ দেয় এবং হাজারেরও বেশি সমৃদ্ধ বেস, নবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে। ৫ লাখের বেশি মানুষ তখন চাকরি পায় এবং তিন বছরের মধ্যে ৬০ কোটিরও বেশি উত্পাদন মূল্য সৃষ্টি হয়। আঙ্গুলের শিল্প এখন আঙ্গুলের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

 

৪৩ বছর বয়সী ওয়ে চু ইং মাত্র প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তবে তার মিয়াও সূচিকর্মের কোম্পানির বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ১-২ কোটি ইউয়ান হতে পারে। ৯০০জন স্থানীয় মানুষ তার কোম্পানিতে কাজ করে। আগে নারীরা নিজের বা পরিবারের জন্য পোশাক তৈরি করত। আর এখন তারা বুঝতে পেরেছে যে সুই দিয়েও টাকা উপার্জন করা যায়। অনেক নারী গ্রামে ফিরে ব্যবসা করছে এবং কেউ কেউ সফল নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন।

 

তাইচিয়াং জেলা মিয়াও জাতির বৃহত্তম জেলা এবং নারীরা খুব ভাল সূচিকর্ম করতে পারে। মিয়াও জাতির সূচিকর্মের উত্তরাধিকারী সি ছুয়ান ইং এ জেলায় বাস করেন। তার তৈরি করা পণ্য শুধু চীন নয় ইতালি ও ফ্রান্সে বিক্রি হচ্ছে।

 

নোটবুকের কভারে কিছু সূচিকর্ম করলে তার দাম হতে পারে ১৫০ ইউয়ান এবং প্রতি বছর এমন নোটবুক সি ছুয়ান ইং ১০ হাজারটির বেশি বিক্রি করতে পারেন।

সি চু ইংর মিয়াও ভাষার নাম হল হাও তেং। হাও মানে থ্রেড এবং তেং মানে রেশম। তাই তিনি নিজের কোম্পানিকে হাও তেং নামকরণ করেন। মিয়াও জাতির টোটেম যেমন প্রজাপতি, ফিনিক্স, ড্রাগন ও মাছসহ টার্ন পোশাক, ব্যাক, হেডব্যান্ডসহ নানা পণ্য সূচিকর্মের মধ্যে যোগ দেন সি ছুয়ান ইং এবং ২০২২ সালে এমন পণ্যের বিক্রির পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ইউয়ান।

 

কুই চৌ প্রদেশের কিছু জায়গায়, মিয়াও জাতির সূচিকর্ম সংশ্লিষ্ট শিল্প সংযুক্ত করে উন্নয়ন করা হচ্ছে। যেমন রং চিয়াং নামে একটি জেলা ২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় মিয়াও ও তুং দুটি সংখ্যালঘু জাতির ঐতিহ্য দিয়ে নতুন একটি শিল্প উদ্ভাবন করে। তারা বানলাঞ্জেন নামে একটি ঐতিহ্যবাহী ভেষজ দিয়ে পোশাকে রং করে তারপর ওই পোশাকে সূচিকর্ম করে। রং জিয়াং জেলায় চাষ করা হয় ২১০০ বেশি হেক্টর বানলাঞ্জেন এবং বার্ষিক উত্পাদনের পরিমাণ হতে পারে ৫২.৫ হাজার টন, যার মূল্য ৬.৮ কোটিরও বেশি ইউয়ান। ৬৩৩৯ পরিবার বানলাঞ্জেন চাষের সঙ্গে জড়িত আছে। তারপর বানলাঞ্জেন দিয়ে তৈরি পণ্যের মূল্য ৪.৪ কোটি ইউয়ানের বেশি।

 

অন্যদিকে, মিয়াও জাতির ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকারে ডিজিটাল প্রযুক্তি ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি তাই চিয়াং জেলার অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উত্তরাধিকার কেন্দ্রের কর্মী ঔসিয়াও নিয়ান একটি দল নিয়ে নানা গ্রামে গিয়ে উত্তরাধিকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ছবি, ভিডিও, অডিও ও লিখিত রেকর্ড সংগ্রহ করেছেন। তারপর তারা এসব তথ্য আপলোড করে তা ডিজিটাইজ করে।

 

৮০ বছর বয়সী পান ইউয়ু চেন সারা জীবনে সূচিকর্ম করেছেন। তিনি অনেকবার মিয়াও জাতির পোশাক পরে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোতে অংশ নেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পান ইউয়ু চেনের সূচিকর্মের স্টাইল ও বৈশিষ্ট্য রেকর্ড করেছেন, এতে তার এ প্রযুক্তি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকশিত হবে।

কর্মকর্তারা সংগ্রহ করা প্রতিটি সূচিকর্মের শিল্পকর্মের কপিরাইট নিবন্ধন করে এবং তাদেরকে একটি ডিজিটাল আইডি দেয়। ভার্চুয়াল পণ্য হিসাবে অনলাইনে তা বিক্রি হতে পারে। এ পর্যন্ত তারা ৯০০০টির বেশি মিয়াও জাতির সূচিকর্মের প্যাটার্ন সংগ্রহ ও নিবন্ধন করেছে।

 

প্রথম চলানের মধ্যে ১৫০০টি প্যাটার্ন অনুযায়ী ১৫০ ধরনের পণ্যে তৈরি করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ব্রাজিলসহ ১৫টি দেশে তা বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি, কুইচৌ প্রদেশের ৪০০০জন সূচিকর্ম নারী ও ১০০টি বেশি স্টুডিওর ডেটা সংগ্রহ করেছে। মিয়াও জাতির সূচিকর্মের তিন ধরনের পদ্ধতি প্রমিতকরণ বাস্তবায়ন করা হয়। পাশাপাশি সূচিকর্মের প্যাটার্নের কপিরাইট সংরক্ষণ নিয়মও প্রণয়ন করা হচ্ছে।

 

মিয়াও জাতির সূচিকর্ম শুধু একটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই নয়, বরং মিয়াও জাতির মানুষ এর মাধ্যমে সুন্দর জীবন গড়ে তুলেছে।

(শিশির/তৌহিদ/রুবি)