‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ২৫
2023-07-04 18:09:58

 

এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে  

১। সাংস্কৃতিক পর্যটন শহর হাংচৌ

২। থিয়েনচিনের প্রাচীন সড়কে ফুটে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ও সংস্কৃতি

৩। ঘুরে আসুন ছিয়ানমেন ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে

বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ 

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"।

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।  

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ২৫তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।  

 

১। সাংস্কৃতিক পর্যটন শহর হাংচৌ

পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশের রাজধানী হাংচৌ। চীনের সাতটি প্রাচীন রাজধানীর অন্যতম হাংচৌ শহরের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। ইতালির ভেনিস থেকে আগত পর্যটক মার্কো পোলো ১৩শ শতকে শহরটি পরিদর্শন করেন। তিনি হাংচৌকে "মর্ত্যের মাঝে স্বর্গ" এবং "বিশ্বের সবচেয়ে সুসজ্জিত শহর" আখ্যা দেন।

 

শহরটি প্রাচীনকালে ছিল প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে শহরটির বর্তমান নামটি প্রদান করা হয়। ৯০৭-৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে শহরটি চীনের ইতিহাসের পাঁচ রাজবংশ পর্বের সময় উইউয়ে রাজ্যের রাজধানী শহরের ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণ সং রাজবংশের শাসনামলে (১১২৭-১২৭৯) শহরটি রাজধানী হবার পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করে।

 

শহরটি, তার সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং ঐতিহাসিক আগ্রহের স্থানগুলোর সাথে, চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর মধ্যে একটি। দক্ষিণ সং রাজবংশের ত্যশৌ প্রাসাদ এখানকার বিখ্যাত স্থান।  হাংচৌর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোতে এখানে গড়ে উঠেছে পার্ক । হাংচৌর সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হল ওয়েস্ট লেক, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে।

চা বাগান পরিদর্শনের জন্য হাংচৌ সবচেয়ে ভালো জায়গা। হাংচৌ শহরে উৎপন্ন শি হু লুংচিং চা চীনের সবচেয়ে উঁচু মানের চা হিসেবে স্বীকৃত। চা বাগান অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত হাংচৌ চা জাদুঘরটি চৈনিক চায়ের ইতিহাসের উপর উৎসর্গীকৃত চীনের একমাত্র জাদুঘর। পাশাপাশি  হাংচৌ শহরকে চীনা রেশম চাষের আঁতুড়ঘর হিসেবে গণ্য করা হয়। হাংচৌয়ে অবস্থিত চীনের জাতীয় রেশম জাদুঘরটি বিশ্বের বৃহত্তম বস্ত্র জাদুঘরগুলোর একটি।  

 

হাংচৌ উচ্চ শিক্ষার একটি জাতীয় কেন্দ্র। ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় চীনের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। যেখানে পড়েন দেশ বিদেশ হাজারো শিক্ষার্থী।

চার দিকে ঘিরে চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য ও শিল্পনগরী সাংহাইসহ বেশ কয়েকটি শহর ঘিরে থাকলেও হাংচৌ শহরটি অবসর কাটানোর জন্য শান্তিপূর্ণ একটি শহর। হাংচৌ শহর জাতিসংঘের শ্রেষ্ঠ বসতির পুরস্কার লাভ করেছে এবং বিশ্বের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক আন্তর্জাতিক 'উদ্যানশহর' হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

হাংচৌ চীনের একটি উঠতি প্রযুক্তিকেন্দ্র। এখানেই চীনের সর্ববৃহৎ ইন্টারনেট ব্যবসা বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রধান কার্যালয়টি অবস্থিত।

হাংচৌ অনেক সাম্প্রতিক নগর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গেছে, এটি এখনও তার ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রেখেছে। মহামারীর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর হাংচৌতে পর্যটকদের আগমন আরও বেড়েছে। সম্প্রতি এখানে পালিত হয়েছে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় হেরিটেজ দিবস। এ উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- শান্তা মারিয়া

 

২। থিয়েনচিনের প্রাচীন সড়কে ফুটে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ও সংস্কৃতি

থিয়েনচিনের নানখাই জেলা। এখানেই অবস্থিত ৬৮৭ মিটার দীর্ঘ প্রাচীন সাংস্কৃতিক সড়ক। এটি সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হয় ১৯৮৬ সালে।

ছিং রাজবংশের সময়কার স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি প্রায় ১০০ দোকান আছে এই সড়কে। এটি শহরের অন্যতম একটি বড় বাজারও বটে।

দর্শনার্থীরা এই সড়কে এলে শুধু চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সম্পর্কেই জানতে পারে এমনটি নয়, এই সড়কে আরো রয়েছে নানা পদের খাবার। স্টিমড গোবুলি বনরুটি, প্যানকেক রোল, মিষ্টি ডেজার্ট ও অন্যান্য স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের জন্য এই সড়ক বেশ প্রসিদ্ধ।

শুধু খাবারই নয়, দর্শনার্থীরা এখান থেকে রঙ-বেরঙয়ের ক্লে, পুরনো জিনিসপত্র, প্রাচীন বই, ক্যালিগ্রাফির উপকরণ, ঘুড়ি ও অন্যান্য অনেককিছু কিনতে পারে।

সড়কটির ঠিক মাঝখানে অবস্থিত থিয়ানহৌ টেম্পল। এটি একটি দেখার মতো জায়গা। স্থানীয় লোকজন এখানে এক প্রাচীন দেবীর পূজা করে। অনেক বছর আগে নাবিকরা সমুদ্রে যাওয়ার আগে এই মন্দিরে এসে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করতো। থিয়ানহৌ টেম্পলটি নির্মাণ করা হয় ১২২৬ সালে এবং এটি থিয়েনচিনের একটি অন্যতম পুরনো স্থাপনা। 

থিয়েনচিনের বেশ কিছু উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ হওয়ার পর  থিয়ানহৌ টেম্পল এর ইতিহাসগত ও সাংস্কৃতিক মুল্য আবারো ফিরে পেয়েছে। বর্তমানে টেম্পলের চারপাশে প্রাচীন জিনিসপত্র, হস্তশিল্প এবং লোকজ পণ্য বিক্রি হয়। বার্ষিক নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং উৎসবও প্রায়ই অনুষ্ঠিত হয় থিয়ানহৌ টেম্পলে। উৎসবের সময় লোক শিল্পীরা ড্রাগন ও সিংহ নাচ এবং ড্রাম শোর মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে।

থিয়েনচিন প্রাচীন সাংস্কৃতিক সড়ককে থিয়েনচিনের দোলনা বলে বিবেচনা করা হয়। থিয়েনচিনে বেরাতে গেলে এই সড়কটিতে একবার ঢুঁ না দিলে অনেককিছুই মিস করে ফেলতে পারেন আপনি।

প্রতিবেদন- আব্দুল্লাহ আল মামুন

সম্পাদনা-আফরিন মিম

 

৩। ঘুরে আসুন ছিয়ানমেন ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে

ছিয়ানমেন ওয়াকিং স্ট্রিট। বেইজিংয়ের একটি অন্যতম জনপ্রিয় টুরিস্ট এলাকা। থিয়ান আন মেন স্কোয়ার থেকে খুব কাছেই এইঅবস্থিত এই পর্‍্যটন গন্তব্য। 

পর্যটকদের চীনের ঐতিহ্যবাহী জনজীবনের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে এই স্থান। হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখা যায় পুরো জায়গাটা। এই এলাকার উল্টোদিকেই রয়েছে এক বিশাল দুর্গ। চীনের রাজপ্রাসাদকে রক্ষা করার জন্য স্থাপিত হয়েছিল এই দুর্গ।

 

এলাকায় প্রবেশের মুখেই রয়েছে বিশাল  তোরণ। ঐতিহ্যবাহী চীনারীতিতে নির্মিত এই তোরণের কারুকার্য দারুণ সুন্দর। তোরণের এক পাশে পুরনো দিনের এক ট্রামডিপো। আরেক পাশে অসংখ্য চীনা লন্ঠন সাজানো । এখানে প্রতিটি ভবনের নকশা করা হয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য রীতিতে।

 

এলাকায় ঢুকলে মনে হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর বেইজিংয়ে ঢুকে পড়েছি। মূল সড়কের মধ্য দিয়ে চলে গেছে একটি ট্রাম লাইন। ট্রাম গাড়িটিও দেখতে সেই ঊনবিংশ শতকের মতো। এটা টুরিস্টদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। রাস্তার দুপাশে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো এমনভাবে লাগানো হয়েছে যে মনে হয় গ্যাসের আলো জ্বলছে।

রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর ব্যালকনিতে টাঙানো রয়েছে চীনা লণ্ঠন, পাখির খাঁচা। এর সবগুলোই গড়া হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর নকশায়। এই রাস্তায় রয়েছে প্রচুর দোকান। বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড শপ। এখানে চীনের ঐতিহ্যবাহী চায়ের দোকান রয়েছে। দোকানের সামনে চা পরিবেশনকারীদের পাথরের ভাস্কর্য। এমন জীবন্ত যে মনে হয় চা পরিবেশন করতে করতে কোন জাদুর কাঠির স্পর্শে এরা থমকে থেমে গেছে।  সিল্কের দোকানও রয়েছে। এই এলাকার গলিপথগুলোতে প্রচুর রেস্টুরেন্ট। মুসলিম রেস্টুরেন্টও রয়েছে।

এই এলাকায় চীনের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সামগ্রীও বিক্রি হয় দেদার। রাস্তায় জাদু দেখানো হয় আর সেই জাদু কিভাবে দেখানো যায় তার কৌশলটিও শিখিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিক্রিও হয় জাদু দেখানোর উপকরণ। এই সব স্ট্রিট-ম্যাজিশিয়ানরা দারুণ দক্ষ।

ছিয়ানমেন স্ট্রিটে রাস্তার পাশে বসার জন্য রয়েছে চমৎকার সব বেদী। এগুলো পাথরের তৈরি। ছিয়ানমেন ওয়াকিং স্ট্রিটে প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে ও সন্ধ্যায় নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।পুরো এলাকাটিতে ঢুকতে কোন টিকেট লাগে না।

প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা- আফরিন মিম

 

ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী