চীনের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন, নতুন মেজর, নতুন পদ্ধতি
2023-07-03 15:00:09

বন্ধুরা, জুলাই মাস এসেছে। চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় এটা। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ভর্তি-পরীক্ষা তথা কাওখাও-এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছর চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষার্থী ভর্তিসংক্রান্ত প্রেস ব্রিফিংও আয়োজিত হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে ভর্তির নীতিমালা ও ব্যবস্থাদি তুলে ধরে।  এই প্রেস ব্রিফিং বেইজিংয়ের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন,  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির নতুন নীতিমালা, এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্যময় মেজর নিয়ে আলোচনা করবো।

চলতি বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট মেজরের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিগ ডেটা, এআই প্রযুক্তি, গ্রহবিজ্ঞান, ইত্যাদি মেজর বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। বেইজিং চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যালয়ের পরিচালক ওয়াং হাও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ৬টি মেজর যুক্ত করা হয়েছে। এসব মেজর অর্থবিজ্ঞান, ডিজিটাল অর্থনীতি, সরবরাহ চেইন, ইত্যাদি সম্পর্কিত। ওয়াং হাও বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ৬টি মেজরের সবগুলোই আকর্ষণীয়। সংশ্লিষ্ট শিল্পে আমাদের প্রাধান্যও সুস্পষ্ট। এসব মেজরে শুধু অনার্স নয়, বরং ডবল ডিগ্রি অর্জন করা যাবে। এর মানে, সংশ্লিষ্ট মেজরের অনার্স শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে ডবল ডিগ্রি পেতে পারেন।”

নানচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রহবিজ্ঞান’ শীর্ষক মেজরও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। গ্রহবিজ্ঞানের মূল বিষয় মহাকাশ অনুসন্ধান করা। এর সাথে জ্যোতির্বিদ্যা, মহাকাশ বিজ্ঞান, ও ভূ-বিজ্ঞান যুক্ত হয়েছে। এ মেজরের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি নয়। তাই শিক্ষকরা প্রতিজন শিক্ষার্থীকে আলাদা করে বেশি সময় দিতে পারবেন। বেইজিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এআই প্রক্রিয়াকরণ’ এবং ‘ইন্টেলিজেন্ট মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং’—এই দুটি নতুন মেজরও যুগের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হয়েছে।

সি’আন চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও ‘আন্তর্জাতিক আর্থ-বাণিজ্য বিধি’ শীর্ষক মেজর চালু করা হয়েছে। এ সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যালয়ের পরিচালক ছাও লিয়াং চি বলেন, ‘মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং’ মেজর মানবজাতির স্বাস্থ্যচাহিদা ও চিকিত্সাসরঞ্জামের গবেষণার চাহিদা বিবেচনা করে চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রাধান্যের ওপর নির্ভর করে, নতুন চিকিত্সা সরঞ্জাম ও নতুন চিকিত্সাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করবে এ মেজরের শিক্ষার্থীরা।

একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেক বিষয়ের ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যেমন, বেইজিং রসায়ন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হংত্য একাডেমিতে প্রকৌশল, রসায়ন ও আইন বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। চীনের বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে মোট ১৮০ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই একাডেমিতে। তাঁরা এখানে সেরা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা ও গবেষণা করার সুযোগ পাবে।

নানচিং বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আদান-প্রদানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। ২০২২ সালে নানচিং বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে, বায়ুমন্ডলীয় ও ভূ-ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান একাডেমি স্থাপন করে। এই একাডেমি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়নের মতো বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে গবেষণা করে থাকে।

 

বেইজিং ফরেন স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ

চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিডিউটে বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ আছে। সেখানে বিভিন্ন বিদেশি ভাষাকে মেজর হিসেবে নিয়ে অনার্স কোর্সও সম্পন্ন করা যায়। বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি সেগুলোর মধ্যে একটি। এখানে অনার্স বিভাগ মোট ১২১টি। এর মধ্যে প্রচলিত বিদেশি ভাষার বিভাগ আছে ১০১টি এবং অপ্রচলিত বিদেশি ভাষার বিভাগ ২০টি। বিদেশি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, এমন সব দেশের ভাষাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

১০১টি বিদেশি ভাষার মেজরের মধ্যে ৩৪টি ভাষা চীনের শ্রেষ্ঠ অনার্স মেজরে পরিণত হয়েছে। বাংলা ভাষাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া, আরও রয়েছে পতুর্গাল, কম্বোডিয়া, লাওস, মালিয়েশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশের ভাষা। আরও ১৪টি ভাষার মেজর চীনের প্রাদেশিক পর্যায়ের মেজর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিনল্যান্ড, গ্রিস, ভারত (হিন্দি) ও পাকিস্তানের (উর্দু) ভাষা।

বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি তথা বিএফএসইউতে বিদেশি ভাষায় পড়াশোনার মানের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভাষার শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট ভাষার জ্ঞান ও ব্যাকরণ জানার সাথে সাথে, সে ভাষায় কথা বলা ও সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও দক্ষতা অর্জন করে।

বিএফএসইউ-এর শিক্ষক স্যু লি লি বলেন, বিএফএসইউ চীনের উন্নয়নের চাহিদা বিবেচনা করে, বিভিন্ন ধরনের দোভাষী সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নজর রাখা এবং দক্ষ দোভাষী সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কেবল ভাষা-ই শেখে না, বরং সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করে।

চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা বিভাগের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বিএফএসইউ শীর্ষস্থানে রয়েছে। ১০১টি বিদেশি ভাষার মধ্যে ৪৭টি ভাষায় মেজর কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের সাহিত্য, আইন, অর্থনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ও পড়তে হয়।

বিএফএসইউ’র বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণপদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষক স্যু বলেন, সকল বিভাগের অনার্স ছাত্রছাত্রীদের অন্তত দুটি ভাষা শিখতে হয়। যাদের শেখার দক্ষতা ভালো, তারা তৃতীয় আরেকটি ভাষাও শিখতে পারে। আর যারা বিদেশি ভাষার মেজরের অনার্স শিক্ষার্থী নয়, তারা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দোভাষী-প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারে এবং ইংরেজি, ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষা শিখতে পারে। বিভিন্ন অপ্রচলিত ভাষার ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। সাধারণত এক ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৪ জনের চেয়ে কম এবং শিক্ষকের সংখ্যা ৩ জন। এভাবে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের আরও ভালোভাবে শেখাতে পারেন।

নতুন যুগে বিদেশি ভাষা জানা দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা বিবেচনা করে, ২০১০ সাল থেকে অনার্স শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সাথে যুক্ত প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৮ সাল থেকে অপ্রচলিত ভাষার শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে দেশের কৌশলগত উন্নয়নের চাহিদা আরও বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করা হয়। এভাবে বহু ভাষা জানা দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যারা পরে আন্তর্জাতিক বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এমন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারে।

বহুমুখী দোভাষী সৃষ্টির লক্ষ্যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ অনার্স ডিগ্রি প্রকল্পও চালু করা হয়েছে। যেমন, চীনের রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান ও আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ‘ইংরেজি প্লাস আইন’ অনার্স মেজর চালু করা, চীনের পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ‘স্প্যানিশ প্লাস আন্তর্জাতিক তথ্য ও সম্প্রচার’ অনার্স মেজর চালু করা হয়েছে।

২০২১ সালে অনার্স শিক্ষার্থীদের জন্য ৩ থেকে ৮ সেমিস্টারের মাইনর কোর্স চালু করা হয়। এভাবে অন্যান্য মেজরের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, কূটনীতি, আইন,  সাংবাদিকতা, যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক ব্যবসা, চীনা ভাষার সাহিত্যসহ যে-কোনো মাইনর কোর্সে যথেষ্ঠ ক্রেডিট অর্জন করে সংশ্লিষ্ট মেজরের মাইনর কোর্সের সনদপত্র পেতে পারে।

বিএফএসইউ বিশ্বের ৮৪টি দেশ ও অঞ্চলের ২৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাগত প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ কাঠামোতে বিএফএসইউ’র শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশে ইন্টারশিপ করার বা উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতে পারে। তা ছাড়া, বিশ্বের ৬২টি দেশের শতাধিক বিদেশি বিশেষজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে থাকেন।

বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্তদের কর্মসংস্থানের সুযোগও অনেক বেশি। যেমন, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চীনের বৈদেশিক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন প্রদেশের বৈদেশিক যোগাযোগ কার্যালয়, বিভিন্ন ব্যাংকের বিদেশি শাখা অফিস, এবং রেড ক্রস সোসাইটিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় তাঁরা কাজ পেতে পারেন এবং পাচ্ছেন।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। চীনের বিভিন্ন প্রদেশের কাওখাওয়ের পদ্ধতি ও পরীক্ষাপত্র আলাদা। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। যেমন, বেইজিং চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য ‘৩টি প্রিয় মেজরের মধ্যে একটি বেছে নেওয়া’-র ব্যবস্থা চালু করেছে। পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ের একটিতে ভর্তি হতে পারে।

মোদ্দাকথা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের এই যুগে, অনেক সনাতন মেজর যেমন প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, তেমনি অনেক নতুন মেজর সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন মেজর মানে নতুন চ্যালেঞ্জও বটে। চীনের শিক্ষা অনলাইন ওয়েবসাইটের সাধারণ সম্পাদক ছেন জি ওয়েন এ মন্তব্য করেন। আশার কথা, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সামর্থ্য চীনের শিক্ষা-ব্যবস্থার রয়েছে।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)