‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।
#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা
পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় টিসিএম
পাশ্চাত্য চিকিৎসা ব্যবস্থামতে, পেপটিক আলসার হলো পাকস্থলীর ভিতরের আস্তরণে এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের উপরের অংশে বিকশিত ঘা বা ক্ষত। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা বা টিসিএমে আলসারের উপসর্গের প্রকৃতি অনুসারে ‘পেট ব্যথা’ বা ‘এপিগ্যাস্ট্রিক ব্যথা’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। পেপটিক আলসার যে কোন বয়সে হতে পারে, তবে এ রোগ বেশি দেখা যায় অল্প বয়স্কদের মধ্যে। চিকিত্সা না করা হলে এটি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তপাত এবং ক্যান্সারের মতো জটিলতার কারণ হতে পারে।
টিসিএমে মনে করা হয়, পেপটিক আলসার বহিরাগত প্যাথোজেন, খাওয়ার অনিয়ম, মেজাজ বিগড়ানো এবং প্লীহা ও পাকস্থলীর দুর্বলতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এসবের কারণে পাকস্থলির মূল শক্তি বা ‘ছি’ প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে প্রবাহিত হতে পারে না কিংবা ভুল দিকে প্রবাহিত হয়, কিংবা পেটের রক্ত চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে হার্টে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, হেঁচকি বা ঢেকুর হয়। টিসিএমে রোগ নির্ণয় করা হয় চারটি পরীক্ষার মাধ্যমে -- দেখা, শোনা ও গন্ধ নেওয়া, অনুসন্ধান ও নাড়ির গতি।
পেপটিক আলসারের সাধারণ লক্ষণ হলো পেট ব্যথা। ব্যথা সাধারণত এপিগ্যাস্ট্রিক অঞ্চলে বা উপরের পেটে হয় এবং এটা হয় খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে বা পেট খালি হলে। এ ব্যথা সাধারণত এক বা দুই ঘন্টা স্থায়ী হয়, তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটি বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। খাবার বিশেষ করে উষ্ণ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে ব্যথা উপশম করা যায়। ব্যথার পাশাপাশি অন্য উপসর্গগুলো হলো ঢেকুর ওঠা, অতিরিক্ত লালা আসা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া। পেপটিক আলসার বেশিরভাগই অল্পবয়স্কদের মধ্যে হয়। খাদ্য, ঋতু, বা প্লীহা ও পাকস্থলীর ক্ষতি করে এমন ওষুধ গ্রহণের সাথে এটি সম্পর্কিত।
টিসিএমে পেপটিক আলসারের চিকিত্সা সবার জন্য এক নয়; আলসারের কারণ ও লক্ষণের ভিন্নতা অনুসারে চিকিৎসাও ভিন্ন হয়। জানিয়ে দিচ্ছি সে সম্পর্কে।
ঘাটতি ও ঠান্ডাজনিত কারণে আলসার হলে রোগী একটি ধীর এপিগ্যাস্ট্রিক ব্যথা অনুভব করেন, যা উষ্ণতা ও ম্যাসাজে উপশম হয়। এ ধরনের আলসারে পেট খালি থাকলে ব্যথা হয়, কিন্তু খাওয়ার মাধ্যমে ব্যথা উপশম করা যায়। এ আলসারের অন্য উপসর্গগুলো হলো ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা, ওজন হ্রাস, বাহু ও পায়ে ব্যথা, মুখ ও গলায় শুষ্কতা, ফ্যাকাশে জিহ্বা এবং দুর্বল নাড়ি। এ ধরনের আলসারে টিসিএম চিকিৎসকরা সাধারণত সিয়াও চিয়ানচুং থাং, হুয়াংছি চিয়ানচুং থাং কিংবা লিচুং থাং প্রেসক্রাইব করেন।
ঠান্ডা ও তাপজনিত আলসার হলে রোগী পেটের উপরের অংশে ভার অনুভব করেন। পাশাপাশি থাকে ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং পেটে আওয়াজ। ঠাণ্ডা বা গরম খাবার এ ধরনের আলসারকে আরও খারাপ করে। এর অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকে পা ঠাণ্ডা হওয়া, আলগা মল, শরীরের উপরের অংশে গরম অনুভূতি, জিহ্বা লাল হওয়া এবং সেখানে হলুদ ও সাদা চর্বির প্রলেপ থাকা। এ ধরনের আলসার হলে সিটিএম চিকিৎসকরা প্রেসক্রাইব করেন ব্যানসিয়া সিয়েসিন থাং কিংবা ফুজি সিয়েসিন থাং।
‘ছি’ ও রক্তে স্থবিরতার কারণে পেপটিক আলসার হলে এপিগ্যাস্ট্রিক অঞ্চলে স্থির ও ছুরিকাঘাতের মতো ব্যথা অনুভূত হয়। সঙ্গে থাকে ক্ষুধামন্দা, বুকে চাপ, টক ঢেকুর ও দীর্ঘশ্বাস। মানসিক অস্থিরতায় এ লক্ষণগুলো আরও তীব্র হয়। এর অন্য উপসর্গগুলো হলো শরীরে ঘা, শুষ্ক পা, চোখে গাঢ় বেগুনি চক্র এবং ঠোঁটে গাঢ় বেগুনি রঙ। এ ধরনের আলসারে টিসিএম চিকিৎসকরা প্রেসক্রাইব করেন তা ছাইহু থাং ও কুইচি ফুলিং ওয়ান কিংবা সুয়েফু চুইয়ু থাং।
কতগুলো জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে পেপটিক আলসার প্রতিরোধ করা যায়। মেনে চলতে পারেন এগুলো:
• নিয়মিত খাবার খান, এক বেলায় বেশি খাবেন না আবার কোনও বেলার খাবার বাদ দিবেন না।
• মশলাদার খাবার, ঠান্ডা খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার এবং হজম করা কঠিন এমন খাবার এড়িয়ে চলুন।
• অ্যালকোহল, ধূমপান পরিহার করুন
• মানসিকভাবে শান্ত থাকুন
• শরীর উষ্ণ রাখুন
• কিছু ওষুধের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন, বিশেষ করে অ্যাসপিরিন ও ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
#চিকিৎসার_খোঁজ
সর্বোচ্চ স্তরের চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান সাংহাই সিক্সথ পিপলস হাসপাতাল
সাংহাই ষষ্ঠ গণহাসপাতাল চীনের বাণিজ্যিক নগরী সাংহাইয়ের একটি চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাদানকারী হাসপাতাল, যেটি সাংহাই চিয়াও থুং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি একটি বৃহৎ আকারের সর্বোচ্চ স্তরের হাসপাতাল, যেটি প্রায় ১২০ বছর ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
২০০২ সালে সাংহাই ষষ্ঠ গণহাসপাতাল সাংহাই চিয়াও থুং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। এ হাসপাতালের রয়েছে দুটি ক্যাম্পাস – সু হুই এবং লিন গাং। দুই ক্যাম্পাস মিলে এ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৩৬৬টি –১,৭৬৬টি জুহুই ক্যাম্পাসে এবং ৬শটি লিন গাং। গত পাঁচ বছরে এ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছে বছরে ৫০ লাখের মতো রোগী আর এখানে ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছে প্রায় দেড় লাখ রোগী, যাদের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার রোগীর ওপর অস্ত্রপচার করা হয়।
স্কিমাগোর হাসপাতাল র্যাঙ্কিয়ে গোটা চীনের মধ্যে ২৮তম অবস্থানে থাকা এ হাসপাতালটি সাংহাই চিয়াও থুং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকেন্দ্র। এছাড়া এটি অ্যাকাডেমিক সহায়তা দেয় সাংহাই লিম্বস মাইক্রোসার্জারি ইনস্টিটিউট, সাংহাই ডায়াবেটিস ইনস্টিটিউট, সাংহাই ল্যাবরেটরি অব ডায়াবেটিস, সাংহাই ল্যাবরেটরি অব স্লিপ-ডিসর্ডারড ব্রিথিং ডিজিজ, সাংহাই বোন ডিজিজ ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, চায়না সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল লিম্ব মাইক্রোসার্জারি ট্রেনিং সেন্টার, সাংহাই মেডিকেল আল্ট্রাসাউন্ড ট্রেনিং সেন্টার, সাংহাই ইনস্টিটিউট অব আল্ট্রাসাউন্ড মেডিসিন, সাংহাই চিয়াও থুং বিশ্ববিদ্যালয় ইমেজিং মেডিসিন ইনস্টিটিউটসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে। পাশাপাশি এটি সাংহাই ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন ইউনিভার্সিটি এবং সোচো ইউনিভার্সিটির শিক্ষণ হাসপাতাল।
অর্থোপেডিকস, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম, অটোল্যারিঙ্গোলজি, মেডিকেল ইমেজিং, স্পোর্টস মেডিসিন এবং ইমার্জেন্সি মেডিসিন -- সাংহাই ষষ্ঠ হাসপাতালের এই ৬টি বিভাগ জাতীয়ভাবে বিশেষ ক্লিনিক্যাল বিভাগের মর্যাদা অর্জন করেছে। পাশাপাশি এর অর্থোপেডিক সার্জারি, এন্ডোক্রিনোলজি ও মেটাবলিক ডিজিজ এবং কার্ডিওলজি বিভাগ একটি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
#ভেষজের গুণ
সুপার ফুড গোজি বেরি
নানা স্বাস্থ্যগত গুণের কারণে গোজি বেরিকে সুপার ফুড বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেষজ হিসাবে এ ফলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। হালকা মিষ্টি স্বাদের ফলটি শরীরে মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্তের ঘাটতি পূরণ করা এবং ‘ছি’র ঠান্ডাশক্তি ‘ইয়িন’ ও তাপশক্তি ‘ইয়াং’য়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ফলটি শুকনো কাশি সারতে সাহায্য করে এবং শুষ্ক ফুসফুসকে আর্দ্র করে। এছাড়া এটি দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, প্রস্রাবের সমস্যা সমাধান করে এবং প্রজনন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে গোজি বেরির। পাশাপাশি এ ফলটি অকাল বার্ধক্য, পিঠ ও হাঁটুর ব্যথা, পুরুষত্বহীনতা, ডায়াবেটিস, মাথা ঘোরা, ঝাপসা দৃষ্টি ও শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করতে পারে। এটি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে চিন্তায় ভারসাম্য আনতে এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনে করা হয়, গোজি বেরিতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এবং এটি ডিএনএ, লিপিড ও প্রোটিনের ক্ষতি প্রতিরোধে ভালো কাজ করে। ক্যান্সার প্রতিরোধেও অবদান রাখে এই ফল।
‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।