সমতা, সম্মান, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শিক্ষা প্রসঙ্গ
2023-06-30 19:38:07

সব জিনিসের মধ্যে পার্থক্য থাকে। পার্থক্যের প্রতি মনোভাব সরাসরি একটি দেশের কূটনৈতিক দর্শন নির্ধারণ করে। প্রাচীনকাল থেকেই চীন বিশাল দেশ এবং এখানে বাস করছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের মধ্যে, আমরা সমতা, সম্মান, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শিক্ষার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছি এবং আমরা একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার, ও জয়-জয় সহযোগিতার নতুন ধরনের আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আসুন চীনের "শি চি" বইয়ে লিপিবদ্ধ একটি গল্পের কথা বলি। বসন্ত ও শরত সময়কাল (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৭৭০ থেকে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪৭৬) চীনের ইতিহাসে রাজ্যগুলির মধ্যে একটি বড় বিরোধের যুগ ছিল। "শি চি" অনুসারে, সেই সময়ে চীনে ১০০টিরও বেশি ছোট-বড় রাজ্য ছিল। চৌ রাজপরিবারের পতনের কারণে, এসব রাজ্য মোটামুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন রাজ্যগুলির মধ্যে বহুপাক্ষিক কূটনীতি হয়ে ওঠে মূলধারা।

প্রাচীন চীনারা "শিষ্টাচার”-এর ওপর অনেক গুরুত্ব দিতো। শিষ্টাচার ছিল ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর সাথে গোষ্ঠীর সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কনফুসিয়াস একবার বলেছিলেন: "আপনি যদি শিষ্টাচার না শেখেন, তবে আপনি সমাজে দাঁড়াতে পারবেন না।" বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিনিময়ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার অনুসারে পরিচালিত হয়। তত্কালে "আন্তর্জাতিক আইন" মানে ছিল “চৌ রাজবংশের শিষ্টাচার”। তখন রাজাকে সম্মান করার জন্য বিশেষ পদ্ধতি ছিল। যুদ্ধের সময়ও সামরিক শিষ্টাচার মেনে চলা হতো। এটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, যা বহু রাষ্ট্রের যুগে অনুসরণ করা আবশ্যক।

এ ছাড়া, কিছু অলিখিত আইন ও প্রবিধান ছিল, যা সাধারণত অনুসরণ করা হতো। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নিতো, তখন আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিত। এরপর  অন্য পক্ষের কাছে যুদ্ধের জন্য দূত পাঠাতো। অবশেষে সম্মত তারিখে যুদ্ধ হতো। নিয়ম ছিল, অঘোষিত যুদ্ধে যাওয়া যাবে না। আরও নিয়ম ছিল: যুদ্ধের সময় "ড্রাম বাজালে সৈন্যরা অগ্রসর হবে", "সৈন্যদের ব্যূহ গঠিত না-হওয়া পর্যন্ত হামলা করা যাবে না", "বিশৃঙ্খল বাহিনীকে আঘাত করা যাবে না", "আগত দূতদের হত্যা করা যাবে না" এবং "বন্দীদের হত্যা করা যাবে না" ইত্যাদি। যুদ্ধের এসব নীতি মেনে চলতে হতো।

৬৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, উত্তরের শানরং গোষ্ঠী ইয়ান রাজ্য আক্রমণ করে। ইয়ান রাজ্যে তারা ব্যাপক লুঠতরাজ চালায়। দুর্বল জাতীয় শক্তির কারণে, ইয়ান রাজ্য তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেও, রেহাই পায়নি। একসময় ইয়ানের রাজা মহান দেশ ছি-এর কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠালেন। ছি-এর রাজা ছি হুয়ান কুং "চৌ সম্রাটকে সম্মান করা এবং বর্বরদের সাথে লড়াই করা"-র পতাকা হাতে ইয়ান দেশকে উদ্ধার করতে নিজে একদল সৈন্যকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তখন শানরং পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। ছি হুয়ান কুং মন্ত্রী গুয়ান জোং-এর "শানরং-এর সমস্যা পুরোপুরি দূর করার" মতামত গ্রহণ করেছিলেন এবং ইয়ান রাজ্যের সাথে একত্রে শানরংকে অনেক দূর পর্যন্ত অনুসরণ করে হ্যপেই প্রদেশ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিলেন। বিজয়ের পর দুই দেশের সেনাবাহিনী দেশে ফেরার পথে, ইয়ানের রাজা কৃতজ্ঞতার সাথে ব্যক্তিগতভাবে ছি হুয়ান কুংকে বিদায় দেওয়ার জন্য তাকে ইয়ান রাজ্যের সীমানার বাইরে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তিনি এতোই কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, ছি রাজ্যের সীমান্তের ভিতরে ৫০ মাইল পর্যন্ত প্রবেশ করেও তিনি থামতে চাননি। ছি হুয়ান কুং ছিলেন আচারকে খুব সম্মান করা একজন রাজা। তিনি বলেছিলেন: "কেবল সম্রাটকে বিদায় দেওয়ার জন্য নিজের দেশের সীমান্ত অতিক্রম করা যায়। রাজার উচিত নয় একে অপরের দেশের সীমান্ত অতিক্রম করা।" ছি হুয়ান কুং তখন একটি নতুন সীমানা দাগ আঁকেন এবং রাজা ইয়ানকে ছি রাজ্যের যেখান পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছিলেন, সে পর্যন্ত জমি ইয়ান রাজাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। এ ছাড়া, ছি হুয়ান কুং পরামর্শ দিয়েছেন যে, ইয়ান রাজ্যের উচিত সম্মান দেখানোর জন্য চৌ রাজপরিবারের প্রতি অব্যাহতভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া।

ছি হুয়ান কুং বসন্ত ও শরত্কালে প্রথম শক্তিশালী অধিপতি ছিলেন। এর প্রথম কারণ, তাঁর শাসনামলে ছি রাজ্যের শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং দ্বিতীয় কারণ, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নৈতিক কূটনীতির পক্ষে ছিলেন। ছি হুয়ান কুং গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, বলপ্রয়োগ এবং ষড়যন্ত্র করে আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জন করা যায় না। সেই সময়ে ছি রাজ্য ছোট ও দুর্বল ইয়ান রাজ্যের প্রতি যথাযথ সৌজন্য দেখিয়েছিল, যা ছিল ইয়ান রাজ্যের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদার প্রতি দেখানো সম্মান। কনফুসিয়াস ছি রাজ্যের নৈতিক কূটনীতির প্রশংসা করে বলেছিলেন: ছি রাজ্য কূটনৈতিক দরকষাকষির চিপ হিসাবে "সৈন্য ও যুদ্ধযান" ব্যবহার করেননি বলেই বিভিন্ন রাজা বা অধিপতিকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। এটি কি “রেন” কূটনীতির শক্তি নয়? পরোপকারীরা পৃথিবীতে অপরাজেয়।

জনগণের আনুগত্যের জন্য বল প্রয়োগ করলে, জনগণ প্রকৃতপক্ষে মন থেকে তা মেনে নেয় না। প্রতিরোধ করার জন্য শক্তি যথেষ্ট না থাকায় তারা তা মেনে নেয়। জনগণের আনুগত্য পেতে হলে তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। এতে জনগণ খুশিমনে রাজার আনুগত্য করবে। কনফুসিয়াসের শিষ্যরা তাদের গুরুর প্রতি আন্তরিকভাবেই অনুগত ছিলেন। একটি দেশ যদি অন্য দেশের সম্মান অর্জন করতে চায়, তবে তা জোর করে করতে পারে না; কারণ, যুদ্ধ দুই দেশের জনগণের জন্যই মৃত্যু ও অকল্যাণ বয়ে আনে।

সমতা ও সম্মান হল একটি আদর্শ সমাজ গঠনের অপরিহার্য। এটি মর্যাদা, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রাচীন গ্রিসে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের সমতা, মধ্যযুগে ঈশ্বরের সামনে জীবনের সমতা, আধুনিক যুগে সকল মানুষের সমতা, বা প্রাচীন চীনা কনফুসিয়াসবাদের "নিজে যেটা চায় না, তা অন্য মানুষের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না”—ইত্যাদি সবই একই চিন্তাধারার ফল।

সমতা ও সম্মানের ধারণাটি প্রাচীন চীনা রাজনৈতিক অনুশীলন দ্বারা পরীক্ষিত একটি ধারণা। বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সুসম্পর্কের জন্য এটি একটি চমত্কার ধারণা। "চৌ লি" বইয়ে লেখা আছে: "একটি বড় দেশের উচিত একটি ছোট দেশের সাথে সমতার ভিত্তিতে নম্র আচরণ করা।” তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা লাও জি বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে বলেছিলেন, একটি বড় রাষ্ট্র যদি একটি ছোট রাষ্ট্রের সামনে বিনয়ী হয় তাহলে সে সম্মান অর্জন করতে পারে; একটি ছোট দেশ যদি একটি বড় দেশের সামনে নম্র হয় তবে বড় দেশ তাকে সহ্য করতে পারে। আর মোজি-র পরামর্শ: "বড় দেশের উচিত নয় ছোট দেশকে দমন করা; শক্তিশালী দেশের উচিত নয় দুর্বল দেশকে ধমক দেওয়া।” (ইয়াং/আলিম/ছাই)