অটিস্টিক ছেলের জন্য রেলগাড়ি তৈরি করলেন চীনা বাবা
2023-06-29 15:11:22

‘বাবার ভালোবাসা পাহাড়ের মতো শক্তিশালী’ বলে চীনে একটি প্রবচন রয়েছে। সন্তানের জন্য বাবার ভালোবাসা কতটা গভীর এবং স্নেহপূর্ণ হতে পারে? আজকের ‘আলোছায়া’ অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে আমরা তা জানার চেষ্টা করবো। সেসঙ্গে চীনের একজন মহান বাবার সঙ্গে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবো।

 

এই বাবার নাম হলো লি চিয়া ওয়েই। তিনি ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের শেষ দিক পর্যন্ত ৮ বছর সাধনা করে ছেলে হাং হংয়ের জন্য একটি সত্যিকারের মাইক্রো রেলগাড়ি তৈরি করেছেন।

 

বর্তমানে ১৫ বছর বয়সী হাং হাংয়ের বয়স যখন তিন ছিল, তখন সে কথা বলতে পারতো না। হাসপাতালের ডায়াগনোসিসে তার মানসিক প্রতিবন্ধকতা তথা অটিজম ধরা পড়ে।

 

খুব কষ্ট করে প্রাথমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার পর স্বাভাবিকভাবে সহপাঠীদের সঙ্গে বিনিময় করতে না পারার কারণে হাং হাং স্কুল ছেড়ে বাসায় থাকতে বাধ্য হয়। বিরক্তিকর জীবনে রেলগাড়ির প্রতি তার গভীর আগ্রহ তৈরি হয়। সে দেয়ালে রেলগাড়ি আঁকে এবং ঘুমানোর সময় হাতে রেলগাড়ি ধরে রাখে।

 

রেলগাড়ির প্রতি তার গভীর আবেগ দেখে বাবা তাকে একটি সত্যিকারের রেলগাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। শুরুতে বাবা মনে করতেন, ছোট একটি রেলগাড়ি তৈরি করা কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু পরে তিনি অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন। বাবা আট বছরে ২ লাখ ইউয়ান ব্যয় করে ছেলের জন্য রেলগাড়ি তৈরি করেন।

 

বাবা লি চিয়া ওয়েই চীনের ছোংছিং শহরের ছিচিয়াং জেলার একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান। রেলগাড়ি তৈরি তিনি একেবারে শূন্য থেকে শিখছেন। রেলগাড়ির প্রতি ছেলের গভীর আগ্রহ দেখে অবসর সময়ে তিনি ছেলেকে নিয়ে সত্যিকারের রেলগাড়ি দেখতে যান। আস্তে আস্তে ছেলের জন্য সত্যিকারের রেলগাড়ি তৈরি’র ইচ্ছা তার মাথায় আসে। তিনি ছেলের জন্য একটি বাষ্প-চালিত রেলগাড়ি তৈরি করতে চান।

 

তাই যখনই লি চিয়া ওয়েই সময় পেতেন, তখনই তিনি বাষ্প-চালিত ট্রেনের চেহারা, গঠন এবং অভ্যন্তরীণ অংশগুলো পর্যবেক্ষণ এবং রেল স্টেশনের প্রকৌশলীদের কাছ থেকে স্টিম ট্রেন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করতেন।

 

যেহেতু লি চিয়া ওয়েই একটি মাইক্রো রেলগাড়ি তৈরি করতে চান, সেহেতু তিনি শুরুতে প্রয়োজনীয় অংশ ছোট করার প্রক্রিয়া জেনে নেন। অনেক প্রক্রিয়া এবং কম চাহিদার কারণে অধিকাংশ হার্ডওয়্যার কারখানা যন্ত্রাংশের ক্ষুদ্র সংস্করণ বানাতে ইচ্ছুক ছিলো না। তাই লি চিয়া ওয়েই নিজেই যন্ত্রাংশ তৈরি করার চেষ্টা শুরু করেন। তাছাড়া, তিনি যান্ত্রিক ট্রান্সমিশন এবং গতিবিদ্যার নীতিগুলোও অধ্যয়ন করেন।

 

ট্রেনটি চালানোর জন্য তিনি সঠিক আকার না পাওয়া পর্যন্ত বার বার একে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন। ট্রেনটি মুভ করতে পারার পর এর চালিকাশক্তিতে সমস্যা দেখা দেয়। এর উপাদানগুলো উচ্চ চাপ প্রতিরোধ করতে না পারায় ট্রেনটি দুই মিটার দূরে গিয়ে থেমে যায়।

 

ট্রেন তৈরির জটিল প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত নানা কঠিন সমস্যা ছাড়াও তাকে অন্যদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। গ্রামবাসীরা ‘তোমার মাথা কি ঠিক আছে? নিজেই ট্রেন তৈরি করা সত্যিই একটি কল্পনাবিলাস নয় কি? এ ধরণের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতো তাকে। লি চিয়া ওয়েই স্বীকার করেন, এসবের মুখে একাধিক বার তিনি হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ-অবধি তা তিনি করেননি।

 

যথেষ্ট খোলা জায়গায় ট্রেনটি চালানোর জন্য লি চিয়াং ওয়েই তার বাসা শহরাঞ্চল থেকে উপকণ্ঠ এলাকায় স্থানান্তরিত করেন। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের শেষ দিক পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে লি চিয়া ওয়েই রেলগাড়ি তৈরি করেন। এবং এটি ঝামেলামুক্ত ড্রাইভিং অর্জন করেছে। প্রতিবার যখন তিনি হাল  ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করেছেন, তখনই তিনি তার ছেলের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে করেছেন।

 

তিনি তার জীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ জিনিস হিসেবে তার পরিবারের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটানোকে বেছে নিয়েছেন। ট্রেনটি তৈরি করা হলো এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের এটি উপায় মাত্র।

ট্রেনটি তৈরি করার প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া হলো ছেলে হাং হাংকে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা করার পদ্ধতি।

 

যখন লি চিয়া ওয়েই ট্রেন তৈরি করা শুরু করেন, তখন থেকে বাবা কী করছেন - তাতে মনোযোগ দিতে শুরু করে হাং হাং।

 

ট্রেন তৈরি আস্তে আস্তে সম্পন্ন হলে ছেলের অসুস্থতাও দিন দিন কমতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় হাং হাং অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করতে আর ভয় পায় না। ট্রেনের গঠন প্রসঙ্গে তার জানাশোনাও বেড়েছে।

 

এই ট্রেন প্রসঙ্গে লি চিয়া ওয়েই বলেন, ‘খুব ছোট এবং সুন্দর না হলেও আমার মনে এর সুন্দর একটি অবস্থান আছে।’

 

এটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট্ট ট্রেন হতে পারে, তবে এটি অবশ্যই পিতামাতার সবচেয়ে বেশি ভালবাসা বহন করা ট্রেন।

 

ট্রেন তৈরি’র এ আট বছর তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব আনন্দময় ও অর্থপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছেন।

 

ট্রেন তৈরি শেষ করার পর হাং হাং এর প্রথম যাত্রী এবং চালক হয়। গ্রামবাসীরা আকৃষ্ট হয়ে ট্রেন দেখতে আসেন। এই ট্রেন স্থানীয় একটি পর্যটন প্রকল্পে রাখা হয়। হাং হাংয়ের চালানো এই ট্রেনটি ২০ ও ৩০ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম এবং এ থেকে উপার্জিত টাকায় হাং হাংয়ের বেতন হয়। প্রতিদিন ছোট চালক হিসেবে পার্কে সে অনেকের সঙ্গে কথা বলে, মত বিনিময় করে এবং গোটা সমাজের সঙ্গেও যোগাযোগ করে হাং হাং। তা দেখে লি চিয়া ওয়েই মনে করেন, ট্রেন তৈরিতে ব্যয় করা তার আট বছর সময় সার্থক হয়েছে।

 

লিলি/এনাম