হাইব্রিড মিলেট বা বাজরা’র জনক: চাও চি হাই
2023-06-28 14:46:51

চাও চি হাই হলেন হ্য পেই প্রদেশের হাইব্রিড মিলেট বা বাজরা নবায়ন কেন্দ্রের পরিচালক, চাং চিয়া খৌ শহরের কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রধান বিশেষজ্ঞ। তিনি হাইব্রিড মিলেটের জনক হিসেবে পরিচিত।  বলে রাখা ভালো, বাজরা হলো ভুট্টা জাতীয় শস্য।

 

২০০৯ সাল থেকে চাও চি হাই ও তার দলের হাইব্রিড মিলেট আফ্রিকায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পরিণত হয়; যা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতামূলক প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম। ২০১০ সালে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব পশুখাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা সম্মেলনে চাও চি হাই চীনের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ‘বিশ্ব বাজারে হাইব্রিড মিলেট’ শিরোনামে একটি ভাষণ দেন।

 

আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চাও চি হাইয়ের গল্প বলব।

 

ইয়ান শান পাহাড় ও থাই হাং শান পাহাড়ের পাশে অবস্থিত মহাপ্রাচীর। মহাপ্রাচীরের পাদদেশে চাং চিয়া খৌ নামে ছোট একটি  শহর আছে।  এখানে একজন কৃষকের ছেলে একটি দল নিয়ে হাইব্রিড মিলেট উদ্ভাবন করেন। এখন এ খাদ্যশস্যের উত্পাদনের পরিমাণ প্রতি হেক্টরে ১২ টনে উন্নীত হয়েছে। ওই কৃষকের ছেলের নাম চাও চি হাই।

তার কাজের অবদানের কারণে তিনি এবং ইউয়ান লং পিং চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

 

যুবক বয়স থেকে চাও চি হাইয়ের অর্ধেক জীবন মিলেটের সঙ্গেই কেটেছে। তিনি বলেন, আমার নাম চি হাই, তা মানে সাগর শাসন করা। আমি কীভাবে সাগর শাসন করতে পারি? সাগর অনেক বড়, তাই আমার জীবন সহজ হবে না। একটি কাজে অবিচল থাকতে হবে। চাও চি হাই মজার পদ্ধতিতে নিজের সাধনার কথা ব্যাখ্যা করেন।

 

চাং চিয়া খৌ শহরের হুয়াই লেই নামে একটি জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন চাও চি হাই। তিনি মিলেট দিয়ে তৈরি ভাত খেয়ে বড় হয়েছেন। কত বড় জমিতে কত মিলেট চাষ করলে সবার খাওয়ার সমস্যা সমাধান হবে, সে সময় সবাই এমন হিসাব করত। তার বাবাও এমন হিসাব করতেন। তখন চাও চি হাই ভাবলেন, যদি জমিতে বেশি মিলেট ফলন হয় তাহলে সবাই ধনী হয়ে যাবে। এমন ধারণা নিয়ে তিনি গেল ৪১ বছর ধরে হাইব্রিড মিলেট নিয়ে গবেষণা করছেন।

 

প্রাচীনকালে মিলেটকে কু বলা হতো। এক সময় উত্তর চীনের প্রধান খাদ্য ছিল মিলেট। যেখানে শুকনো ও বৃষ্টি কম সেখানে বেশি মিলেট চাষ হত। মিলেট উত্পাদনের পরিমাণ কম হওয়া দীর্ঘসময় ধরে একটি সমস্যা ছিল। আগে পাহাড়ি অঞ্চলে মিলেটের উত্পাদন পরিমাণ ছিল এক হেক্টর জমিতে ১ হাজার কেজি।

 

গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ২০টি প্রদেশের ৩০টি সংস্থা নিয়ে হাইব্রিড মিলেট গবেষণা দল গঠিত হয়। তবে আশির দশকে অধিকাংশ সংস্থা এ বিষয়টি ত্যাগ করে। কারণ তখন কোন অগ্রগতি হয়নি।

 

১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর চাও চি হাই সক্রিয়ভাবে চাং চিয়া খৌ শহরে ফিরে কাজ শুরু করেন। তিনি কৃষিবিজ্ঞান গবেষণালয়ে যোগ দেন। সেখানে সবাই গম বা ভুট্টা এমন ‘বড়’ খাদ্য নিয়ে গবেষণা করতে চান তবে চাও চি হাই মনে করেন, ছোট খাদ্যশস্য নিয়েও গবেষণা করা দরকার। তাই তিনি মিলেট বা বাজরা বাছাই করেন। তার মতে হাইব্রিড মিলেট ও মিলেট উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানো কঠিন, তবে গর্বের কাজ। একজন কৃষকের ছেলে ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হিসেবে তাঁকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

 

কৃষি গবেষণা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ভাল একটি প্রজাতি আবিষ্কার করতে হাজার হাজার উপাদান দিয়ে সংমিশ্রণ করতে হয়। কয়েকবার বাছাই, পরীক্ষা ও লালনপালন করতে হয়। অনেক কাজ গ্রিণহাউসে করতে হয়, উত্তর চীনে শীতকালে বাইরের তাপমাত্রা হতে পারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি এবং গ্রিনহাউসে তাপমাত্রা থাকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাও চি হাই প্রতিদিন শীত ও গরম- এই দুই

ধরনের আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করেন। তখন ঠান্ডা লেগে যাওয়া তার কাছে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। তা ছাড়া, এমন বিপরীত ও বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে করতে তাঁর শরীরে একজিমা ও আর্থ্রাইটিস রোগও বাসা বাঁধে।

 

১৯৮৪ সাল থেকে বীজ প্রজননের কাজ দ্রুত করতে তারা হাই নান দ্বীপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। অক্টোবর মাসে চাং চিয়া খৌতে মিলেট বা বাজরা ফলনের পর তারা হাই নান গিয়ে বীজ বপন করেন। আর পরবর্তী বছরের মে মাসে আবারও চাং চিয়া খৌতে ফিরে যান। এক বছরে তারা কয়েকবার উত্তর ও দক্ষিণ চীনে যাতায়াত করেন।

 

কাজের কারণে তিনি ঠিকমতো পরিবারের যত্ন নিতে পারতেন না। ছোট বেলায় তার মা মারা যান। তার বাবা, দাদি ও নানী তাকে লালনপালন করেছেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালে তিন বছরের মধ্যে একে একে তিনজনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তখন চাও চি হাই হাই নান প্রদেশে ছিলেন। তাই তাঁদেরকে শেষ দেখা কিংবা বিদায় জানানোর কোনো সুযোগ হয়নি তার। এটাও তার জীবনের একটি বড় আক্ষেপ।

 

অনেক বছর কঠোর কাজের কারণে চাও চি হাই হৃদরোগ এবং আর্টেরিও-স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। তবে তিনি অস্ত্রোপচার করতে চান না। তিনি বলেন, হাইব্রিড মিলেট গবেষণা খুব জরুরি একটি কাজ। যদি আমার জীবন এবং এই গবেষণা কাজ বাছাই করতে হয়, তাহলে আমি এ কাজটিই বাছাই করব। কারণ আমার জীবনের অর্থ এই গবেষণা করা।

 

পরীক্ষামূলক ক্ষেতে গিয়ে চাও চি হাই লাখ লাখ মিলেট থেকে একটি করে নিয়ে দেখেন ও তুলনা করেন। আর ৮ বছর পর চাও ও তার দল প্রথম হাইব্রিড মিলেটের জন্য উপযোগী মিলেট আবিষ্কার করেন।

 

এরপর ২০০০ সালে বিশ্বে প্রথম হাইব্রিড মিলেটের জন্ম হয়। সাধারণ মিলেটের তুলনায় এর উত্পাদনের পরিমাণ ৩০ শতাংশ বেশি। মিলেট বা বাজরা এখন কম মাত্রায় উত্পাদন করা খাবার নয়! অবশেষে কৃষি খাতে ৩০ বছরের একটি সমস্যা সমাধান করা হয়েছে।

 

তবে প্রথম প্রজন্মের হাইব্রিড মিলেট ব্যাপকভাবে চীনে চাষ করা হয়নি। কারণ তার উত্পাদন ব্যয় বেশি ছিল। এক কেজি হাইব্রিড মিলেটের বীজের দাম ৬০-৮০ ইউয়ান আর সাধারণ বীজের দাম প্রতি কেজি মাত্র ৪ ইউয়ান। তাই কৃষকরা হাইব্রিড মিলেট চাষ করতে চাইত না। চাও চি হাই কৃষকের পছন্দ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের হাইব্রিড মিলেট উদ্ভাবন করার সিদ্ধান্ত নেন।

 

এক প্রজাতির মিলেট লালন করতে ১০ বছর সময় লাগে এবং এ প্রক্রিয়ায় কোন ভুল করা যাবে না। যদি কোন সমস্যা হয়, তাহলে গোটা কাজে আরও দু-তিন বছর সময় বেশি লাগবে। হাই নান খুব সুন্দর একটি দ্বীপ। তবে চাও চি হাই হাই নান দ্বীপে পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রতিদিন তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে মাঠে যান, ক্লান্ত হলে পাশে একটু ঘুমিয়ে নেন। একবার তিনি মাটিতে পড়ে যান, ডাক্তার তাকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে তিনি অবহ্যাতভাবে কাজ করেন।

 

২০০৪ সালে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাইব্রিড মিলেটের উন্নয়ন সফল হয়। তারপর  ১০ম প্রজন্মের হাইব্রিড মিলেট বাজারে আসে। এখন পর্যন্ত মোট ২৪ ধরনের হাইব্রিড মিলেট পাওয়া যায়।

 

হাইব্রিড বাজরার গবেষণা সফল হয়, আর চাও সি চাই পান স্বীকৃতি, প্রশংসা ও নানা সুযোগ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিখ্যাত গবেষণালয়ে যোগদানের সুযোগও পান। তবে চাও চি হাই চাং চিয়া খৌর ছোট এ গবেষণালয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, হাইব্রিড মিলেট আমার জীবনের সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তামানে যে সংস্থায় তিনি যে গবেষণা করছেন, অন্য  জায়গায় গেলে তার ধারাবাহিকতা হারিয়ে যেতে পারে।

 

ভাল বীজ কৃষকদের স্বীকৃতি পেতে হয়। আরও বেশি কৃষক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বাস করাতে চাও চি হাই অসংখ্য গ্রামে গিয়েছেন। তিনি সেখানে ক্লাস নেন ও প্রশিক্ষণ দেন এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন। তার প্রচেষ্টায় আরও বেশি কৃষক হাইব্রিড মিলেট চাষ শুরু করেছেন।

 

গেল কয়েক বছরে, তিনি মিলেটের সংযোজিত মূল্য বাড়ানোর কাজ করছেন। আধুনিক সময়ে স্বাস্থ্যের বিষয়ে মানুষ বেশ গুরুত্ব দেয়। তাই মিলেট ও গম, চাল পারস্পরিক পুষ্টির সম্পূরক উত্স। ওটমিলে মিলেট ও গ্রিন বিন যোগ করলে হাইপোগ্লাইসেমিক খাবার হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পশুখাদ্যে মিলেট যোগ করলে গরু ও ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার হবে এবং তাদের মাংস আরও সুস্বাদু হয়।

চীনে হাইব্রিড মিলেট চাষে সফলতা অর্জিত হবার পর চাও চি হাই বিদেশে বিশেষ করে খাদ্য সংকটে থাকা দেশে হাইব্রিড মিলেট প্রযুক্তি প্রচার করতে চান।

 

২০০৮ সালের মে মাসে তিনি প্রথমবারের মতো আফ্রিকায় গিয়েছেন এবং ইথিওপিয়ার একটি গবেষণালয়ে তিনি মিলেট বা বাজরার চাষ পরীক্ষা করেছেন।

হাইব্রিড মিলেটের চাষ আফ্রিকায় সফল হয়েছে। স্থানীয় খাদ্যের তুলনায় হাইব্রিড মিলেটের উত্পাদন পরিমাণ তিনগুণ বেশি। চাও চি হাই বলেন, আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খারাপ নয়। প্রতিবছর তারা তিন দফা মিলেট চাষ করতে পারে এবং হাইব্রিড মিলেট আফ্রিকাকে বিশ্বের খাদ্যের ভাণ্ডারে পরিণত করতে পারে। যদি আফ্রিকায় খাওয়ার সমস্যা সমাধান হয়, তাহলে বিশ্বের বড় একটি সমস্যা সমাধান হবে।

 

চাও চি হাই বলেছেন, একজন মানুষ হিসেবে তার জীবনে কিছু না কিছু করার লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সহজ বা কঠিন হলেও একটি নির্দিষ্ট পথে চলতে হয়। মিলেট আমার স্বপ্ন আর এ পথে ১ শতাংশ সম্ভাবনা থাকলেও আমি সম্পূর্ণভাবে চেষ্টা করব।

(শিশির/তৌহিদ/রুবি)