২৫ জুন, ২০২২। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সড়কপথে যুক্ত হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাদবাকি অংশের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে জমকালো আয়োজনে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। দেশের যোগাযোগের ইতিহাসে রচিত হয় একটি বড় মাইলফলক। গোটা বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আসে অবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে। ২৬ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে শুরু হয় যান চলাচল।
এ হিসেবে ২৫ জুন, ২০২৩ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। বিগত এক বছর ধরে পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে। পদ্মা সেতুর অর্জন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। তথ্য-উপাত্তও বলছে, প্রত্যাশার চেয়ে পদ্মা সেতুর অবদান অনেক বেশি।
পদ্মা সেতু চালু হবার আগে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পূর্বাভাস দিয়েছিল প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার ৮৩৫টি গাড়ি পারাপার করবে সেতুটি দিয়ে। আর এ থেকে টোল আদায় হবে এক কোটি টাকার কিছু বেশি।
তবে গত বছরের ২৬ জুন থেকে এ বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার ৫৭০টি অর্থাৎ পূর্বাভাসের চেয়ে দ্বিগুণ যানবাহন পারাপার করেছে পদ্মাসেতু দিয়ে। আর এক কোটি টাকা টোলের স্থলে প্রতিদিন গড়ে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকার মতো। অর্থাৎ পূর্বাভাসের দ্বিগুণের বেশি টোল আদায় হয়েছে প্রতিদিন।
এ হিসেবে গত এক বছরে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার করেছে ৫৬ লাখ, ৫১ হাজার ৯৮৭টি। আর এ সময়ে মোট টোল আদায় হয়েছে ৭৯৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
শুধু যানবাহন পারাপার আর টোল আদায়ে আশাতীত সাফল্যই নয়, পদ্মা সেতু গত এক বছরেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক চালচিত্র বদলে দিয়েছে অনেকখানি। কম খরচে এবং অল্প সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বাসিন্দারা। যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর এবং নওয়াপাড়া নৌবন্দর থেকে ব্যবসায়ীরা মালামাল দ্রুততম সময়ে এবং কম খরচে পাঠাতে পারছেন রাজধানীসহ দেশের অন্যত্র। এর ফলে বেশ কর্মমুখর হয়ে উঠেছে বন্দর দুটি।
পদ্মা সেতুর দু’পাশে এবং মংলা বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন কলকারখানা। এক কথায় পদ্মা সেতুর প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে।
পদ্মা সেতুর কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি উন্নত হওয়ায় প্রতিবছর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি ২.৫ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে জিডিপি ১.২৬ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। রেললাইন চালুর ফলে জিডিপিতে আরও ১ শতাংশ যুক্ত হবে। যানচলাচল ও টোল আদায়ের ক্ষেত্রে যেমন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অর্জিত হয়েছে, তেমনি জিডিপির হিসেবে এর ইতিবাচক সুফল পাওয়া যাবে আশা করা যায়।
আর্থ-সামাজিক সুফল ছাড়াও পদ্মা সেতুর রয়েছে অন্য তাৎপর্য্য। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গেলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে স্বপ্নের সেতুন নির্মাণ। এমনই একটি সংকটময় মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো কোনো মহল তখন এ সিদ্ধান্তকে হঠকারী বলতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো একটি বড় অবাকাঠামো নির্মাণ করে গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তাই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গৌরব আর মর্যাদারও প্রতীক হয়ে উঠেছে।
গত বছর ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন, এ সেতু শুধু একটি সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার আমাদের গর্ব; সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক।
পদ্মা সেতুর মূল সেতু নির্মাণ, নদী শাসন ও রেল প্রকল্পে কাজ করেছে চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী চীনও এ গৌরবের অংশীদার।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পদ্মা সেতু উদ্বোধন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ এমন সেতু নির্মাণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের স্বপ্ন অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেতুটি তার কাছেও সাহসের একটি প্রতীক-বলেছিলেন চীনের সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত।
উদ্বোধনের এক বছর পেরিয়ে যথার্থই পদ্মার বুকে বাংলাদেশের সাহস আর মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু- থাকবে বহুকাল!
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।