দেহঘড়ি পর্ব-০২৪
2023-06-25 19:51:25

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

বাতের চিকিৎসায় টিসিএম

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আপনার শরীরে কি অসাড়তা বোধ হয়? দাঁড়ালে কি হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করেন? হাত, পা ও আঙ্গুলে ব্যাথা লাগে? কিংবা পিঠের নীচের অংশে ব্যথা অনুভব করেন, যা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে? এসব লক্ষণ থাকলে, আপনি সম্ভবত আর্থ্রাইটিস বা বাতে আক্রান্ত। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি বা টিসিএম ও আকুপাংচার কেবল আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ও প্রদাহ উপশম করতে সাহায্য করে না; বরং এটি আপনাকে চলাফেরার স্বাধীনতা ফিরে পেতে এবং বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।



আর্থ্রাইটিস হলে অস্থিসন্ধি ফুলে যায় এবং ব্যথা অনুভূত হয়। এটি ব্যাপক বিস্তৃত একটি রোগ। সব বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে বয়স্ক মানুষের মধ্যে এ রোগের হার বেশি। এ রোগ তীব্র হলে মানুষ কর্মে অক্ষম হয়ে পড়ে। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষই ব্যথার ওষুধ গ্রহণ করে এবং অস্বস্তি নিয়ে জীবনযাপন করে।

প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় মূলত ব্যথানাশক বা এনএসএআইডি দিয়ে ব্যথা উপশম ও প্রদাহ কমানোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এই ওষুধগুলো ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা বা মানুষের চলফেরার সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি ওষুধগুলোর অনেকগুলি অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে।

বাতের ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এ রোগের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী অস্থিসন্ধিতে তরুণাস্থি ছিড়ে ছিড়ে এর পরিমাণ কমে যাওয়া। আঘাতের কারণেও তরুণাস্থির ক্ষতি হতে পারে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা লুপাসের মতো রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী রোগের কারণে ইমিউন সিস্টেম সাইনোভিয়াম টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ টিস্যুগুলো সাইনোভিয়াল তরল তৈরি করে, যা জয়েন্টগুলোকে তৈলাক্ত রাখে। বিজ্ঞান এখনো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সঠিক কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি, তবে এটি কিছুটা বংশগত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তার প্রতি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাও অস্থিসন্ধিতে ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে। একে বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীল আর্থ্রাইটিস। অতিরিক্ত ওজন বাতে অবদান রাখে। কারণ অতিরিক্ত ওজন অস্থিসন্ধিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

টিসিএম তত্ত্ব অনুসারে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘বি সিন্ড্রোম’ শ্রেণির অধীনে পড়ে। এ শ্রেণির রোগ হয় তখন, যখন শরীরের মেরিডিয়ান পথ দিয়ে জীবনীশক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ‘ছি’ বা রক্তের ঘাটতির কারণে শীত, ক্লেদ, বাতাস বা তাপ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে, যার ফলে ‘বি সিনড্রোম’ সৃষ্টি হয়।

টিসিএমে এটাও বিবেচনা করা হয় যে, একটি সমস্যা অভ্যন্তরীণ কারণ থেকে এসেছে নাকি বাহ্যিক কারণ থেকে এসেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্থ্রাইটিস একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে হয়, যা জন্মগত। ‘ছি’র ঘাটতি একটি অভ্যন্তরীণ কারণ হতে পারে। নিজেদের সহজাত অবস্থার জন্য কিছু লোকের এই কারণগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বাতের দুই ধরনের প্যাটার্ন আছে -- ঠাণ্ডা প্যাটার্ন ও তাপ প্যাটার্ন। ঠান্ডা প্যাটার্নের বাত তখন হয়, যখন বাইরের উৎস থেকে আসা ঠান্ডা অস্থিসন্ধিকে কঠিন করে দেয়। এমন হলে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় এবং ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এই কারণে টিসিএম চিকিৎসকরা দীর্ঘ সময় ধরে ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় না থাকার পরামর্শ দেন।

হিট প্যাটার্নের বাত হলে অস্থিসন্ধিগুলো লাল হয়ে যায়, ফুলে ওঠে এবং মুখ রক্তাভ হয়।। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা কারণ ও লক্ষণের ভিত্তিকে আলাদা হয়। একজন টিসিএম চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করে দেন।

তেতাল্লিশটি ক্লিনিকাল গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টিসিএম কেবল বাতের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে না, এটি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতাও বাড়ায়।

চীনের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও হাঁটুর অস্টিওআর্থারাইটিসের প্রধান টিসিএম ওষুধ হলো ‘বি-ছি’ ক্যাপসুল। এ ক্যাপসুলের মূল উপাদান হলো রেড সেইজ, সেমেন স্ট্রাইচনি, চীনা যষ্ঠিমধু, কডোনপসিস পিলোসুলা, অ্যাস্ট্রাগুলাস মংহোলিকাস, বাঞ্জ ও নটোজিংসেন। এতে আরও থাকে তানশিনোন আইআইএ সালফোনিক সোডিয়াম, সালভিয়েনোলিক অ্যাসিড বি, গ্লাইসাইরিজিন, ব্রুসিন, স্ট্রাইকাইন, ক্রিপ্টোটানশিনোন ও লিকুইরিটিন।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

দক্ষিণ চীনের সেরা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র দ্বিতীয় সিয়াংইয়া হাসপাতাল

দক্ষিণ চীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় সিয়াংইয়া হাসপাতাল। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটির অধিভুক্ত একটি হাসপাতাল, যেখানে রয়েছে সব ধরনের বিভাগ। এটি হুনান প্রদেশের বৃহত্তম ‘ক্লাস-এ’ হাসপাতাল। চীনের ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতাল র‌্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায়, সামগ্রিক সক্ষমতায় দ্বিতীয় সিয়াংইয়া হাসপাতালের অবস্থান গোটা চীনের মধ্যে ১৩তম। সাড়ে ৩ হাজার শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে ৪০টি ক্লিনিকাল বিভাগ, ৯টি মেডিকেল ল্যাবরেটরি এবং ১২৭টি ওয়ার্ড এলাকা রয়েছে। এখানে কর্মরত প্রায় ৫ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ৭২২ জন টেকনিক্যাল টাইটেলধারী জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ, ‘হাজার ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম’ এবং ছাংচিয়াং স্কলারস প্রোগ্রামের ৪ জন পণ্ডিত, ২ জন জাতীয় অসামান্য যুব প্রতিভা, জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনে অসামান্য অবদান রেখেছেন এমন ৭ জন তরুণ বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রীয় পরিষদ থেকে বিশেষ ভাতাপ্রাপ্ত ৬২ জন বিশেষজ্ঞ এবং ৪২ জন ‘খ্যাতিমান সিয়াংইয়া চিকিৎসক’। এখানকার বিশেষজ্ঞ ও কর্মীরা আন্তর্জাতিক একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে ৩৯টি এবং আন্তর্জাতিক একাডেমিক ম্যাগাজিনে ৩০টি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তারা চীনা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও চীনা মেডিকেল ডক্টর অ্যাসোসিয়েশনের কমিটিতে ৯টি চেয়ারম্যান বা ভাইস-চেয়ারম্যান পদ অলঙ্কৃত করেছেন।

দ্বিতীয় সিয়াংইয়া হাসপাতালে ২৩টি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল বিভাগ রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মনোরোগ, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি, ডার্মাটোলজি, জেরিয়াট্রিক্স, ক্লিনিকাল ফার্মেসি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিভাগ দেশসেরা। সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটির অধীনে এখানে ২ হাজার ২শ জনের বেশি স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরাল পর্যায়ের ছাত্র রয়েছেন। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ৬টি প্রথম-স্তরের ডক্টরাল প্রোগ্রাম এবং ৩১টি সেকেন্ডারি ডক্টরাল প্রোগ্রামের জন্য এখানে রয়েছেন ১১০ জন ডক্টরাল সুপারভাইজার।

এখানে রয়েছে ২টি জাতীয় ক্লিনিকাল মেডিসিন গবেষণা কেন্দ্র, ১টি রাষ্ট্র-প্রদেশ পর্যায়ের যৌথ পরীক্ষাগার, ৬টি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং ১৭টি প্রাদেশিক ও মন্ত্রণালয়-স্তরের পরীক্ষাগার ও গবেষণাকেন্দ্র।

এখানকার শিক্ষার্থীরা জাতীয় ক্লিনিকাল দক্ষতা প্রতিযোগিতায় ৬টি বিশেষ পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া হাসপাতালটি ১০টি রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার জিতেছে এবং বিগত পাঁচ বছরে ৪২০টি জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১২টি মূল গবেষণা প্রকল্প, ১৮টি জাতীয় সহায়তা প্রকল্প, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রযুক্তিগত প্রভাবের দিক থেকে এ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলজি, সাইকিয়াট্রি, রিউমাটোলজি, অটোইমিউন ডিজিজ, নেফ্রোলজি ও ডার্মোলজি দেশের শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে।

 

#ভেষজের গুণ

সুপার ফুড গোজি বেরি

নানা স্বাস্থ্যগত গুণের কারণে গোজি বেরিকে সুপার ফুড বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেষজ হিসাবে এ ফলের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। হালকা মিষ্টি স্বাদের ফলটি শরীরে মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্তের ঘাটতি পূরণ করা এবং ‘ছি’র ঠান্ডাশক্তি ‘ইয়িন’ ও তাপশক্তি ‘ইয়াং’য়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ফলটি শুকনো কাশি সারতে সাহায্য করে এবং শুষ্ক ফুসফুসকে আর্দ্র করে। এছাড়া এটি দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, প্রস্রাবের সমস্যা সমাধান করে এবং প্রজনন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে গোজি বেরির। পাশাপাশি এ ফলটি অকাল বার্ধক্য, পিঠ ও হাঁটুর ব্যথা, পুরুষত্বহীনতা, ডায়াবেটিস, মাথা ঘোরা, ঝাপসা দৃষ্টি ও শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করতে পারে। এটি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে চিন্তায় ভারসাম্য আনতে এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।

পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনে করা হয়, গোজি বেরিতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এবং এটি ডিএনএ, লিপিড ও প্রোটিনের ক্ষতি প্রতিরোধে ভালো কাজ করে। ক্যান্সার প্রতিরোধেও অবদান রাখে এই ফল।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।