চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-২২: বর্ণাঢ্য আয়োজনে চীনজুড়ে ড্রাগনবোট উৎসব
2023-06-24 18:59:54


ড্রাগন বোট উৎসব বা তুয়ান উ চিয়ে উৎসব চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। প্রতি বছরের পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। বলা হয়, এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চীনের দুই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। শুধু চীনেই না, পৃথিবীর অনেক দেশেই বেশ ঘটা করে উদযাপিত হয় এ উৎসব।  নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ও বিশেষ খাবার চংজি গ্রহণের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে চীনবাসী।



 

বিস্তৃত জলাশয়ের বুকচিরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে ড্রাগন-প্রতিকৃতি খচিত নৌকা। ড্রামের তালে তালে বৈঠা চালাচ্ছে নৌকা বাইচে অংশ নেওয়া প্রতিযোগিরা।

সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে আসা দর্শকরাও উন্মুখ হয়ে আছেন কে হবে বিজয়ী হবে তা দেখতে।

মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উসুয়ে শহরে এভাবেই ঐতিহ্যবাহী ড্রাগন বোট উৎসব উদযাপন করতে দেখা যায় ।

একজন দর্শনার্থী এভাবে প্রকাশ করলেন তার উচ্ছ্বাস।   

‘আমরা খুবই আনন্দিত। আমাদের শিশুরাও বেশ খুশি’।
এদিকে পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশের নিংপো শহরেও ড্রাগন বোট উৎসব উপলক্ষ্যে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়।

এখানকার একজন দর্শনার্থীর মধ্যেও সঞ্চারিত প্রতিযোগিতার উত্তেজনা।

‘আমি এই প্রথম ড্রাগন বোট প্রতিযোগিতা দেখছি। আমি খুবই এক্সাইটেড’।

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুইচৌ প্রদেশের থংরেন শহরে নৌকাবাইচ দেখতে ভিড় জমান বিপুল দর্শনার্থী। তারা আনন্দ-উল্লাস ও চিৎকারের মাধ্যমে প্রতিযোগিদের মনোবল যোগান। 

এখানকার একজন বাসিন্দা জানালেন শুধু প্রতিযোগিতা দেখতেই তিনি ফিরে এসেছেন নিজ এলাকায়।

‘শুধুমাত্র ড্রাগন বোট প্রতিযোগিতা দেখতে আমি থংরেনে ফিরে এসেছি। থংরেনের দলটি বেশ ভালো পারফর্ম করছে। তাই নিজ চোখে প্রতিযোগিতা দেখতে চলে এলাম’।
এদিকে দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশেও বেশ বড় আকারের নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পার্ল নদীতে কুয়াংচৌ আন্তর্জাতিক ড্রাগন বোট ইনভাইটেশনাল টুর্নামেন্ট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ১২৫টি ড্রাগন বোট টিমে মোট ৫ হাজার ক্রীড়াবিদ অংশ নেয়।   

প্রতিযোগিরা বলেন, নৌকাবাইচের সময় নৌকাকে সর্বোচ্চ গতিতে নিয়ে যেতে দলের সকল সদস্যদের সমান তালে বৈঠা চালাতে হয়। পাশাপাশি পানিতে বৈঠা  চালনার গভীরতা ও প্রতিটি ব্যক্তির শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। 

ড্রাগন বোট উৎসবে ‘চংজি’ নামের একটি বিশেষ খাবার খাওয়ার রীতি আছে চীনাদের। আঠালো ভাত দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির এই খাবার বেশ উপভোগ করেন  চীনারা।

ড্রাগন বোট উৎসব চীনের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলেও এটি শুধু দেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ইতালি ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ আয়োজন করে উদযাপিত হয়েছে এই উৎসব।    

ড্রাগন বোট উৎসবকে শুধু চীনের নয়, এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল উৎসব হিসেবেও আখ্যায়িত করেন অনেকে।

২. কবির প্রতি ভালোবাসার গল্প

চীনের মানুষ যে কবি এবং কবিতাকে কত ভালোবাসেন তা বোঝা যায় বা তুয়ান উ চিয়ে বা ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল থেকে। একজন কবির স্মৃতিকে ধারণ করতেই এ উৎসবের সূচনা। খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০ শতকের দিকে একটি বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে এই দিবস।

সে সময় চীনে সাতটি রাজ্য ছিল- ছি, চু, ইয়ান, হান, চাও, ওয়েই এবং ছিন। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ছিন রাজ্য।

 রাজ্যগুলোর মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। চু রাজ্যের বিখ্যাত কবি ছু ইউয়ান ছিলেন রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারী।

রাজা ও জন্মভূমির প্রতি তার বিশ্বস্ততা ছিল অবিসংবাদিত। অভিজাত রাজপরিবারের সন্তান ছু ইউয়ান ছিলেন রাজার প্রধান পরামর্শদাতা। তিনি চু রাজ্যকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য রাজাকে বিভিন্ন সুপরামর্শ দিতেন। ছু ইউয়ান রাজাকে পরামর্শ দেন ছি রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে জোটবদ্ধ হয়ে ছিন রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। কিন্তু ছু ইউয়ানের পরামর্শ রাজা অগ্রাহ্য করেন। এর পিছনে রয়েছে চিরকালের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজ দরবারে ছু ইউয়ানের প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত অন্য মন্ত্রী ও পারিষদরা তার বিরুদ্ধে রাজার কান ভারি করে।

 রাজা ছু ইউয়ানের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন এবং নির্বাসনে পাঠান। নির্বাসনে থাকার সময় ছু দেশপ্রেমমূলক অনেক কবিতা লেখেন যার অনেকগুলো এখনও চীনে বেশ জনপ্রিয়। গ্রামবাসী এই কবিকে ভালোবাসতো। তারা তার কবিতা শুনতো এবং তাকে সমাদর করতো।

এদিকে ২৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ছিন রাজ্য চু রাজ্যের উপর হামলা চালিয়ে রাজধানী দখল করে নেয়। নিজের প্রিয় মাতৃভূমির পরাজয়ের সংবাদ যখন কবির কানে পৌঁছালো তিনি সে দুঃখ সইতে পারলেন না। তিনি মিলোও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলেন। পঞ্চম চান্দ্র মাসের পঞ্চম দিনে এই বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটে।

স্থানীয় লোকেরা যখন তাদের প্রিয় কবির আত্ম বিসর্জনের কথা জানতে পারে তখন তারা নদীতে নৌকা নিয়ে তার মৃতদেহের সন্ধান করতে থাকে। অশুভ আত্মাদের তাড়াতে তারা নৌকার বৈঠা দিয়ে নদীর পানিতে বাড়ি মারে এবং ঢাক পিটিয়ে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে। মাছ যেন কবির মৃতদেহ না খায় এজন্য তারা ভাতের ছোট ছোট পুঁটুলি নদীতে ছুঁড়ে ফেলে।  একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক  নদীতে কিছুটা মদিরা ঢালেন যেন অশুভ দানবরা তা পান করে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ছু ইউয়ান দানবদের গ্রাস থেকে রক্ষা পান। এই ঘটনার স্মরণে এখনও ড্রাগন বোট উৎসব পালন করা হয়।

মধ্য চীনের হুনান প্রদেশে ছাংশা শহরের ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মিলোও নদীতে এখনও নৌকা ভাসানো হয়। কালক্রমে এটি নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। এ সব রীতি রেওয়াজের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয় দেশপ্রেমিক কবি ছু ইউয়ানকে।

৩. বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা: সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে বই

বইয়ের মাধ্যমে ‘সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষাকে গভীরতর করা'- এ থিম নিয়ে ১৫ থেকে ১৮ জুন হয়ে গেলে বিশ্বের বৃহ্ত্তম বেইজিং আন্তর্জতিক বইমেলা। বেইজিং ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় চারদিনব্যাপী মেলাটি।

ন্যাশনাল প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বেইজিং মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট, পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চায়না এবং চায়না রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ আয়োজনে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

চীনসহ ৫৬টি দেশ ও অঞ্চলের আড়াই হাজার প্রকাশক মেলায় ২ লাখের বেশি বই সরাসরি ও অনলাইনে প্রদর্শন করেন। শুধু চীনের বইই ছিল ৮০০ ধরনের।

মেলার গেস্ট অব অনার কান্ট্রি ছিল আলজেরিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি এবং গ্রীসসহ ১৪টি দেশের নিজস্ব জাতীয় বুথ ছিল। মেলার ৬০ শতাংশ প্রকাশকই ছিলেন বিদেশি।

মেলায় বই প্রদর্শনী ছাড়াও ইন্টারনেট প্রকাশনা উন্নয়ন ফোরাম, এবং পাঠ প্রচারসহ হাজারের বেশি সাংস্কৃতিক ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।

বেইজিং বইমেলা দেশে-দেশে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।

বইয়ের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়বে বলে মনে করেন ইরানি অনুবাদক হোসেইন খালিফা।

‘বইমেলার মাধ্যমে আমরা চীনের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেত পারবো। বইয়ের মাধ্যমে আমরা পারস্পরিক শিক্ষা ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরও গভীর করতে পারবো’।

চীনের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী প্রকাশনা সংস্থা চায়না পাবলিশিং গ্রুপ যথারীতি এবারও মেলায় সবার নজর কেড়েছে। প্রকাশনা গ্রুপটি মেলায় অতি উচ্চমানের দেড় হাজার বই নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সাহিত্য-প্রবণতা তুলে ধরে ৫০টি ইভেন্টের আয়োজন করে সংস্থাটি।

চায়না পাবলিশিং গ্রুপের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পিপলস লিটারেচার পাবলিশিং হাউসের প্রেসিডেন্ট চাং ইয়ংছিং তুলে ধরেন তাদের প্রকাশনার বৈশিষ্টের কথা।

‘আমরা সবার জন্য ভালো বই প্রকাশ করছি। আমাদের লক্ষ্য পরিমাণ নয়, বরং গুণগত মান-বিশেষ করে চীনের মৌলিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে’।

 

প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: আবদুল্লাহ আল মামুন, শান্তা মারিয়া, মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।