আকাশ ছুঁতে চাই ২৩
2023-06-22 19:25:34

১. ড্রাগনবোট ফেস্টিভ্যাল : সাও ইর গল্প

২. প্রতিবন্ধকতাজয়ী পিয়ানো শিক্ষক চেং তানি

৩. নারীদের শিল্প:  থুবু কাপড়

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

চীনে এখন চলছে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের মৌসুম। ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল নিয়ে বিভিন্ন লোকজ কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এরমধ্যে একটি কাহিনী হলো একজন বাবা ও মেয়ের শ্রদ্ধা ও স্নেহের অসামান্য কাহিনী।

ড্রাগনবোট ফেস্টিভ্যাল : সাও ইর গল্প

চীনের একটি বড় উৎসব ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল বা তুয়ান উ উৎসব। এই উৎসবের পিছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি লোককাহিনী। এর একটি কাহিনী হলো বাবার প্রতি একজন মেয়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার করুণ কাহিনী।

প্রাচীনকালে সাও ই নামে এক তরুণী মধ্য পূর্ব চীনের চেচিয়াং প্রদেশে বাস করতেন। সাও ইর জন্ম ১৩০ খ্রিস্টাব্দে বা ১৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।  সাও ই তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবা ও মেয়ে বাস করতেন নদীর তীরে। সাও ইর বাবা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন তার বাবা একটি নদীতে ডুবে যান। বাবার মৃতদেহের সন্ধানে সাও ই আহার নিদ্রা ত্যাগ করে নদীর তীরে ঘুরতে থাকেন এবং মর্মস্পর্শী বিলাপ করতে থাকেন। পঞ্চম চান্দ্র মাসের পঞ্চম দিনে সাও ই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

গ্রামবাসীরা সাও ই এবং তার বাবাকে খুব পছন্দ করতেন। তারা নিখোঁজ বাবা মেয়ের সন্ধ্যানে নদীতে নৌকা ভাসান। নদীর দানবরা যেন তাদের মৃতদেহ খেয়ে না ফেলতে পারে এজন্য ছোট ছোট খাবারের পুঁটুলি তারা নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে থাকেন।

 পাঁচদিন পর পিতা ও কন্যার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা যায় সাও ই তার বাবার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে আছেন। বাবার প্রতি কন্যার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে গ্রামবাসীরা চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না।  বাবার প্রতি কন্যার এই মহান ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ স্মরণে সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন গ্রামের মানুষ। নদীটির নামকরণও করা হয় সাও এর নামে। সাও নদীটি হলো হাংচৌ প্রদেশে প্রবাহিত ছিয়াংথাং নদীর একটি শাখা নদী। ঘটনাটি ঘটে ১৪৩ খ্রিস্টাব্দে বা ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সাও ইর স্মরণে উত্তর চেচিয়াং-এ ড্রাগন বোট উৎসব পালন করা হয়।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: রহমান

 

 

প্রতিবন্ধকতাজয়ী পিয়ানো শিক্ষক চেং তানি

প্রতিবন্ধকতা কোন বাধা নয়। এই কথাটি নতুনভাবে প্রমান করেছেন চীনের চিয়াংসি প্রদেশের বাসিন্দা চেং তানি। চোখে দেখতে না পেয়েও পিয়ানোয় সুর তোলেন তিনি। অনেকটা সময় পিয়ানোর সাথে  কাটিয়ে এখন শেখান পিয়ানো বাজানো।

পূর্ব চীনের চিয়াংসি প্রদেশের নানচাং শহরের চিয়াংসি চোংশান ডান্স স্কুল। আলো আঁধারি ছোট্ট ঘরে সাত সুরের মূর্ছনা। পিয়ানোতে তখন চলছে দশ আঙুলের জাদু। এক সুর থেকে আর এক সুরে উত্তরণ ঘটছে এক অদ্ভুত দক্ষতায়, মুগ্ধ হয়ে সেই তালে নাচছেন শিক্ষার্থীরা। মোহনীয় আবহে এভাবেই পিয়ানো শেখান শিক্ষক চেং তানি।

 

৩১ বছর বয়সী চেং তানি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই নারী ভর্তি হন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি বিশেষায়িত স্কুলে। সুরের প্রতি আলাদা টান কাজ করায় সুস্থ দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের পাশাপাশি গান বাজানো শিখেছেন তিনি। গানের প্রতি তার আবেগ তৈরি হয় সেই ছোট্ট বয়সেই।

 

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, চেং তানি চিয়াংসির চোংশান ডান্স স্কুলে পিয়ানোর শিক্ষকতা শুরু করেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন সকালে অনুশীলন করতে এবং ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিতেহয় তাকে। শিক্ষার্থীদের যাতে নিপুনভাবে শেখাতে পারেন সেজন্য বাসায় অতিরিক্ত সময় চর্চা করেন তিনি।

 

বর্তমানে চেং তানি প্রতি ১৫ দিনে একবার একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী পিয়ানো শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। হাটাচলায় অসুবিধা থাকলেও নিজের জানা জ্ঞান অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান এই শিক্ষক।

প্রতিবেদন- আফরিন মিম

সম্পাদনা- শান্তা মারিয়া

নারীদের শিল্প:  থুবু কাপড়

চীনের একটি বিখ্যাত লোকশিল্প হলো থুবু। এটি বিশেষ একধরনের কাপড় যা  মূলত নারীরা বুনন করে থাকেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই বুনন শিল্প নারীরা ধারণ করছেন। এটি মূলত শানসি প্রদেশের একটি কারুশিল্প। সম্প্রতি এই বিশেষ কারুশিল্প ব্যবহার করে নারীদের ভাগ্য বদলে দেয়া হচ্ছে। শুধু নারীদেরই নয় পুরো একটি গ্রামের অর্থনীতি জেগে উঠেছে নারীদের শ্রমে। শুনবো এই বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন।

শানসি প্রদেশের ইয়ংচি শহরের তোংখাইচাং গ্রামে গেলে দেখা যাবে একদল নারী বিশেষ ধরনের তাঁতে কাপড় বুনতে ব্যস্ত। তারা এক বিশেষ সুতী কাপড় বুনছেন। এই কাপড়ের  নাম থুবু। এটি হুইছাং হাতে বোনা কাপড় নামেও পরিচিত।

আপস

এই কাপড় মূলত নারীরাই বুনে থাকেন। থুবু কাপড়ের এক হাজার বছরের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ২০২১ সালে হুইছাং কাপড় বুনন কৌশলকে জাতীয় অবৈষয়িক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তোংখাইচাং গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নিজস্ব তাঁতে প্রবীণ নারীরা এই কাপড় বুনে থাকেন।

যুগ যুগ ধরে সংসারের প্রবীণ নারীরা এই বিশেষ শিল্পে দক্ষ করে গড়ে তোলেন তরুণ প্রজন্মের নারীদের।

থুবু কাপড়ের রয়েছে এক বিশেষ ধরনের নকশা যা কাপড়টিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। ওই নকশা এবং ফেব্রিকের কারণে কাপড়টির রয়েছে ভিন্ন রকম চাহিদা।

তোং খাইচাং গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টি সেক্রেটারি ইয়ু ইয়ানফিং নিজেও এই কাপড় বুনতে পারেন। তিনি একজন কালচারাল ইনহেরিটর। তিনি গ্রামের পার্টি সেক্রেটারি হিসেবে নারীদের এই বিশেষ শিল্পকে ব্যবহার করে এলাকার উন্নয়ন ঘটানোর কথা ভাবতে থাকেন।

 

২০০৫ সালে তিনি গ্রামের বাসিন্দাদের আয় বৃদ্ধির একটি প্রকল্প হাতে নেন। তিনি থুবু বুননে দক্ষ স্থানীয় নারীদের নিয়ে একটি সমিতি গড়েন। বুননের জন্য প্রয়োজনীয় তাঁত, চরকা এবং অন্যান্য মেশিন কেনা হয়। শুধু ট্র্যিাডিশনাল চরকা নয়। তিনি ভাবেন এটি বাণিজ্যিক রূপ দিতে হলে প্রয়োজন হবে আধুনিক প্রযুক্তির। তাই উপযোগী আধুনিক সেলাই মেশিনও কেনা হয়।

২০০৬ সালে ঐতিহ্যবাহী থুবু কাপড়ের শিল্প গড়ে তুলতে একটি সমবায় সমিতি স্থাপন করা হয় যেখানে ৬০ জন নারী কাজ শুরু করেন। এই সমিতি তেকে যথেষ্ট আয় হতে থাকে। ঘুরতে থাকে ওই ৬০ জন নারীর ভাগ্যের চাকা। তখন ইয়ু ইয়ানফিং ভাবেন এটিকে কিভাবে আরও বড় শিল্পে রূপ দেয়া যায়।

২০১২ সালে একটি সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

 

নারীদের বোনা এই কাপড় ক্রেতাদের কাছে ভালো সাড়া পায়। থুবু কাপড়ে তৈরি পোশাক, হাতব্যাগ, বেডকভার, জুতাসহ প্রায় ১০০ রকম পণ্য বাজারে দেয়া হয়। ক্রেতারা দারুণ পছন্দ করেন এসব সামগ্রী।

বর্তমানে ৮০০ মানুষ এই কারখানায় কাজ করছেন যাদের অধিকাংশই নারী। এই শিল্পের মোট মূল্য ২০ মিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছেছে।

নারীদের বোনা থুবু কাপড়কে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটন শিল্পও গড়ে উঠেছে। পর্যটকরা এখানে এসে কাপড় বুনন দেখেন, বিভিন্ন সামগ্রী কিনতেও পারেন।

এই কাপড়েরর বুনন কৌশল বেশ জটিল। ৭২টি ধাপে কাপড় তৈরি হয়। উজ্জ্বল রং, ব্যতিক্রমী নকশা এবং আরামদায়ক হওয়ায় থুবু কাপড়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

নারীদের দক্ষতায় জেগে উঠেছে পুরো গ্রামের অর্থনীতি।

প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া

সম্পাদনা: রহমান

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

 

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া, 

অডিও এডিটিং: রফিক বিপুল