এভারেস্টের পাদদেশে পিয়ানো ক্লাস
2023-06-20 14:07:00

তিব্বতের শিকাজে শহরের তিংরি জেলার চুসিচুং উপজেলার ওয়ান ছুয়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়টি  হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্টের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত একটি প্রাথমিক স্কুল। স্কুল ও এভারেস্টের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৪০ কিলোমিটার। এ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী তান চেং চি চুও পিয়ানো ক্লাসে অংশ নিয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের শখ অনুযায়ী তথ্য প্রযুক্তি, চারুকলা, রেডিও, ক্রীড়া, নৃত্য, পিয়ানো ও হস্তশিল্পসহ ১৬টি বিষয়ের যো কোনো একটি বাছাই করতে পারে। প্রতি সপ্তাহে তারা আধা বেলা তাদের পছন্দের বিষয়ের ক্লাসে অংশ নেয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে স্কুলটি এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

 

তান চেং চি চুও জানায়, সে এ শখের ক্লাস অনেক পছন্দ করে, বিশেষ করে পিয়ানো ক্লাস। তার বাবা-মাও ছেলের পিয়ানো শিখার খবর শুনে অনেক খুশি। কারণ তার পরিবার এমনকি সারা গ্রামের কেউই পিয়ানো বাজাতে পারে না।

 

বর্তমানে স্কুলটিতে মাত্র একটি পিয়ানো আছে, তাই ক্লাসে সবাই ইলেকট্রনিক পিয়ানো ব্যবহার করে। তবে এটি দেখে তাদের নতুন শিক্ষক পা সাং অনেক অবাক হয়েছেন। তিনিও তিংরি জেলার মানুষ এবং তিন বছর আগে নরমাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর তিনি এখানে একজন পিয়ানো শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো পিয়ানো শিখেছেন। তিনি বলেন, যখন আমি প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম, তখন আমার স্কুলে কোন পিয়ানো ছিল না। তাই তখন পিয়ানো শিখা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। পা সাং বলেন, ওই সময় কোন শখের ক্লাসও ছিল না। তবে এখন শিক্ষার্থীদের জীবনে দুনিয়া-কাঁপানো পরিবর্তন এসেছে। 

 

দুনিয়া-কাঁপানো পরিবর্তন শব্দটি স্কুলে সব সময় শোনা যায়। স্কুলের উপ-প্রধান তান পা রেন ছিং প্রায়ই এটি ব্যবহার করেন। তিনি নিজের প্রাথমিক স্কুলের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘যখন আমি একজন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন আমার খাবার হিসেবে চা ও সাম্বা ছাড়া আর কিছু থাকতো না। ক্লাস রুমে টেবিল বা চেয়ার ছিল না। আমরা নিজেরা একটি নরম মাদুর নিয়ে এসে মাটিতে পেতে ক্লাসে অংশ নিতাম। আমাদের ডর্মে বিছানাও ছিল না। বাসা থেকে বিছানাপত্র এনে মাটিতে ঘুমাতাম। এমনকি ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডও ছিল না, শিক্ষকগণ কাঠ দিয়ে বা সরাসরি দেয়ালে একটি ফ্রেম আঁকতেন। তারা ব্যাটারি ভেঙ্গে ভেতরের কালো পাউডার ও পানি মিক্স করে ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি করতেন।

 

তান পা রেন ছিং-এর বয়স এখন ৪১ বছর। তিনি প্রায় ৩০ বছর আগের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি চীনের নানা জায়গায় গিয়ে স্থানীয় স্কুল পরিদর্শন করেছি, বড় শহরের ভাল স্কুলেও আমি গিয়েছি। এখন আমি বলতে পারি, তিব্বতের স্কুল ও বড় শহরের স্কুলের মধ্যে অবকাঠামো ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই।’ 

 

১৯৮৩ সালে ওয়ান ছুয়ান স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৮০ লাখ ইউয়ান ব্যয়ে স্কুলটিকে সম্প্রসারিত করেছে। ২০১৬ সালে সরকার ৪ কোটি ইউয়ান দিয়ে আবারও স্কুলকে সম্প্রসারিত করেছে। এখন স্কুলে রয়েছে ৬টি শ্রেণীর ২০টি শাখা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯২১ জন। সব ধরণের আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জাম স্কুলটিতে রয়েছে। জাতীয় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুল স্মার্ট শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা বড় বড় শহরের শিক্ষা সুবিধা উপভোগ করতে পারে।

 

স্কুলটিতে রয়েছে ল্যাবরেটরি, ক্যালিগ্রাফি ক্লাসরুম, কম্পিউটার ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, আর্ট রুম ইত্যাদি। এছাড়া একটি ফুটবল মাঠ এবং একটি ইনডোর জিমনেসিয়ামও রয়েছে স্কুলে। বড় বড় শহরের প্রাথমিক স্কুলের তুলনায় ওয়ান ছুয়ান স্কুলের অবকাঠামো আরও ভাল।

স্কুলটির উপ-প্রধান তান পা রেন ছিন বলেন, গেল কয়েক বছর ধরে তিব্বতে শিক্ষার উন্নয়ন বেগবান হয়েছে। গ্রাম ও জেলার স্কুলগুলোর মধ্যে ব্যবধান কমাতে চেষ্টা করছেন তারা।

 

অবকাঠামো ছাড়াও, তিব্বতের স্কুলগুলো কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বিশেষ সাহায্য পায়। ১৯৮৫ সাল থেকে সব পশুপালক ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে বিনামূল্যে খাবার, থাকা ও শিক্ষাদান চলছে।

 

চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তা তান চুও মু জানায়, স্কুলের খাবার বাসার খাবারের চেয়ে বেশি সুস্বাদু। কারণ বাসায় তারা কম মাংস ও শাকসবজি খায়, তবে স্কুলে তারা মাংস ও সবজি ছাড়া দুধ, ডিম, রুটিও খেতে পারে।

 

পঞ্চম শ্রেণীর আ ওয়াং নি ছু জানায়, তাদের ডর্মে কার্পেট আছে। স্কুল তাদেরকে ইউনিফর্ম দেয়। গ্রীষ্মকাল ও শীত্‌কালের পৃথক চারটি ইউনিফর্ম রয়েছে। তাই পোশাক ও খাবার বাসা থেকে আনার দরকার পড়ে না। দুপুর ও রাতের খাবারে তিন ধরনের খাবার ও সুপ থাকে। স্কুলব্যাগ, বালিশ, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট এবং সাবানও স্কুল থেকে পাওয়া যায়।

 

দরিদ্র শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে ৪৫৪ ইউয়ানের ভর্তুকি পায়। প্রতিবছর তারা ১০ বার এ ভর্তুকি পায়। ভবিষ্যতে তারা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলে আরও বেশি ভর্তুকি পাবে। কারণ তারা বড় হলে তাদের ব্যয়ও বাড়বে।

 

২০২১ সাল পর্যন্ত তিব্বতে প্রায় ৯০ লাখ ছাত্রছাত্রী এ নীতি থেকে উপকৃত হয়েছে। আর তাদের সাহায্যে সরকার মোট ২ হাজার কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করেছে। এখন শুধু মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থী নয়, বরং কিন্ডারগার্টেনের দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও সাহায্য পায়।

এমন নীতির প্রভাবে তিব্বতে শিক্ষা নিয়ে পশুপালকদের ধারণাও পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন বিশ্বাস করে, শিক্ষা ও জ্ঞান মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে।

 

তা তান চুও মু জানায়, বড় হয়ে সে একজন মহাকাশচারী হতে চায়। তার বাবা মাও তাকে ভালভাবে লেখাপড়া করে নিজের স্বপ্ন পূরণে উত্সাহ দেন।

 

পিয়ানো ক্লাসের শিক্ষার্থী তান চেং চি চুং পড়ালেখায় অনেক বেশি মনোযোগী। তার দাদা-দাদি ছিলেন অশিক্ষিত এবং তাঁরা সারা জীবন কৃষি কাজ করেছেন। তার বাবা মাধ্যমিক স্কুল ও তার মা প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত পড়েছেন।  প্রশিক্ষণ নেয়ার পর গ্রামে তারা অন্যদেরকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তার বাবা-মা আশা করেন, তাদের সন্তান পরিবারের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হবে। আর তান চেং চি চুং একজন পিয়ানো শিক্ষক হতে চায়।

 

তান চেং চি চুংর পরিবারের তিন প্রজন্মের অবস্থা এবং শিক্ষক পা সাং ও স্কুলের  উপ-প্রধানের কথা থেকে তিব্বতের শিক্ষা খাতের পরিবর্তনগুলো আমরা বুঝতে পারি।

 

এক সময় তিব্বতে ৯৫ শতাংশের বেশি দাস অশিক্ষিত ছিল। আর শিশুদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষা গ্রহণ করতো। ১৯৫১ সালে তিব্বতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০০ জন। তখন সরকারী ২০টি এবং বেসরকারি ৯৫টি স্কুল ছিল। স্কুলে ভাষা, পাটিগণিত, বৌদ্ধ শাস্ত্র শেখানো হতো। তবে ২০২২ সালে তিব্বতে প্রাকবিদ্যালয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার যথাক্রমে ৮৯.৩৩ শতাংশ, ৯৭.৭১ শতাংশ, ৯১.১ শতাংশ ও ৫৭.৪২ শতাংশে দাঁড়ায়। তা জাতীয় গড় মানের সমান। বর্তমানে তিব্বতে কিন্ডারগার্টেন থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত টানা ১৫ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তিব্বতে নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৩৩৯টি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ২২ হাজারে পৌঁছেছে।

 

ওয়ান ছুয়ান প্রাথমিক স্কুলের উপ-প্রধান তান পা রেন ছিং আশা করেন, ভবিষ্যতে আরও পেশাদার শিক্ষক তাদের স্কুলে যোগদান করবেন। এখানকার ভৌগলিক উচ্চতা বেশি বলে বসবাস একটি কঠিন। তবে শিক্ষকদের বেতন ভালো। একজন শিক্ষক শুরুতে প্রতিমাসে ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি পেতে পারেন। এ স্কুলকে তিনি শিকাজে, তিব্বত এমনকি চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্কুলে পরিণত করতে চান।

 

ক্লাস রুমে সবাই পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইছে। তারা শিকাজের বিখ্যাত একটি লোকসংগীত গাইছে। আর অদূরে এভারেস্ট পাহাড় দেখা যায়। এভারেস্টের পাদদেশে তিব্বতের স্কুল ও শিক্ষা ব্যবস্থা দিন দিন উন্নত হচ্ছে। (শিশির/এনাম/রুবি)