"শান হাই চিং” তথা ‘পর্বত ও নদীর ক্লাসিক’-এ, চীনের যুদ্ধরত আমল থেকে শুরু করে হান রাজবংশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। “শান হাই চিং”, "ই চিং" এবং "হুয়াংতি নেইচিং"-এই তিনটি বইকে ‘প্রাচীন আমলের অলৌকিক বই’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
"শান হাই চিং"-এ প্রাচীন ভূগোল, ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাণী, উদ্ভিদ, ঔষধ, ধর্ম, নৃতত্ত্ব, সমুদ্রবিদ্যা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিপুল তথ্য-উপাত্ত স্থান পেয়েছে। এটি প্রাচীন সমাজজীবনের একটি বিশ্বকোষ।
“শান হাই চিং"-তে প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে; গ্রেট ওয়াইডারনেস যুগের জীবনযাত্রা ও মানুষের তত্কালীন কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়েছে; প্রাচীনকালের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক অবস্থার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে; এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনেক দরকারী তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
"শান হাই চিং" পদ্ধতিগতভাবে ও ব্যাপকভাবে চীনের ভূগোলকে প্রাক-ছিন যুগে লিপিবদ্ধ করেছে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাদের অতীতকে জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এতে রয়েছে প্রাচীন হ্রদ, জলাভূমি, মরুভূমি, পাহাড় ও নদী, খনিজ পদার্থ, বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী, এবং মানবসমাজের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী সম্পর্কে বিপুল তথ্য-উপাত্ত।
"শান হাই চিং"-এ দক্ষিণে গুয়াতুংয়ের দক্ষিণ চীন সাগর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম পর্যন্ত, পশ্চিমে কায়দাম অববাহিকা ও পামির মালভূমি পর্যন্ত, উত্তরে বৈকাল হ্রদ ও বেরিং প্রণালী পর্যন্ত, পূর্বে কোরিয়ান সাগর পর্যন্ত, এবং দক্ষিণ-পূর্বে তাইওয়ান দ্বীপ পর্যন্ত ভৌগোলিক তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আজও চীনে পরিবেশগত সুরক্ষা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার উপায় অন্বেষণের সময় "শান হাই চিং"-এর নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়।
"শান হাই চিং" প্রাচীনকালের বিপুল ঐতিহাসিক উপকরণ ধরে রেখেছে, যা পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পৌরাণিক কাহিনী চীনা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্স। "শান হাই চিং"-এ বিশ্বের সৃষ্টি, বন্যা, জাতির উত্পত্তি, বিভিন্ন উপজাতি এবং প্রকৃতিসংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত আছে। এসব কাহিনী প্রাচীন মানুষের বিশ্ববোধকে প্রতিফলিত করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যের উপজীব্য। বিশেষ করে রোমান্টিক সাহিত্যের জন্য। বলতে গেলে, এটি পরবর্তী প্রজন্মের চীনা সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক মোটিফকেও নির্দিষ্ট আকার দিয়েছে।
"শান হাই চিইং"-এ অলৌকিক প্রাণীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এসব প্রাণীর কোনো কোনোটির অস্তিত্বের কথা আধুনিক প্রাণীবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন। যেমন ডাংকাং এক ধরনের পুরুষ শূকর, লু শু ডাং হল জেব্রা, লিন হল কিংবদন্তি প্রাণী ছি লিন, ফেনহুয়াং হল বার্ড অফ পেরাডাইজ বা রঙিন তানসেন, ইত্যাদি। জি সুই, মালয়ন কুমির চীনের ভূমি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, তবে "শান হাই চিং" লেখার সময় সেগুলোর অস্তিত্ব ছিল। এ ছাড়াও, বড় পান্ডা, এশিয়ান হাতি, অ্যালিগেটর এবং বনমানুষের মতো বিপন্ন প্রজাতির উল্লেখও আছে বইটিতে।
বইটি প্রাণীদের স্থানান্তর, বিলুপ্তি ও বিবর্তনসম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছে; বিভিন্ন প্রাণীর জীবনপদ্ধতি বর্ণনা করেছে; এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তাদের নামকরণের ভিত্তি স্থাপন করেছে। বইটি চীনাদের কুকুর, ঘোড়া, ভেড়া, গবাদি পশু, শূকর এবং অন্যান্য প্রাণী লালনপালনের কথাও লিপিবদ্ধ করেছে। এতে বলা হয়েছে, কীভাবে এসব প্রাণী লালনপালন করতে হবে।
"শান হাই চিং"-কে ফার্মাকোলজিক্যাল জ্ঞানের ভাণ্ডারও বলা যেতে পারে। ওষুধের প্রকারভেদ, উৎপত্তি, ফর্ম, কার্যকারিতা এবং স্বাদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে বইয়ে। এসব তথ্য পরবর্তীতে "পেন ছাও কাং মি” (মেটেরিয়া মেডিকার সংকলন) এবং অন্যান্য নথিতে স্থান পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বইটিতে বলা হয়েছে বিভিন্ন ওষুধ তিনটি ভাগে বিভক্ত: উদ্ভিদ থেকে পাওয়া ওষুধ, প্রাণী থেকে পাওয়া ওষুধ, এবং খনিজদ্রব্য থেকে পাওয়া ওষুধ। প্রতিটি বিভাগের আবার বেশ কয়েকটি করে উপ-বিভাগও রয়েছে। এতে বিভিন্ন ওষুধের উত্পত্তিস্থল, ভৌগোলিক অবস্থা এবং সেসব ওষুধের ওপর পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন উদ্ভিদের রূপ, শাখা, বিভিন্ন গাছের পাতা, ফুল, ফল, টেক্সচার ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে এতে।
"শান হাই চিং"-এর টোটেম উপাসনার উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে সূর্য ও চাঁদের টোটেম, পশুর টোটেম এবং ড্রাগন ও ফিনিক্স টোটেম, যেগুলির সমৃদ্ধ ধর্মীয় অর্থ রয়েছে এবং প্রাচীনকালে আদিম ধর্ম বা আদিম ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। একই সময়ে, "শান হাই চিং" জ্যোতির্বিদ্যা এবং ক্যালেন্ডারকে পৌরাণিক কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট গল্পের সাথে যুক্ত করেছে এবং সূর্য, চাঁদ এবং তারার গতিবিধি রেকর্ড করেছে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জ্যোতির্বিজ্ঞানসম্পর্কিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। "শান হাই চিং" চীনের প্রাক-ছিন যুগে হাজার হাজার কৃষিসংস্কৃতির বিপুল সংখ্যক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অর্জন রেকর্ড করেছে এবং প্রাচীনকালে কৃষি উত্পাদনের পাশাপাশি জল সংরক্ষণ, যানবাহন ও নৌকা তৈরি, গবাদি পশুর ব্যবহার, সঙ্গীত ও নৃত্যের উত্স এবং বিভিন্ন খেলাসম্পর্কিত অনেক তথ্য-উপাত্তও রেকর্ড করেছে।
“শান হাই চিং”-এর প্রভাব চীন ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বেই কমবেশি প্রসারিত হয়েছে। "শান হাই চিং"-কে একসময় পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি এবং জাদুবিদ্যার গ্রন্থ হিসাবে গণ্য করা হতো। এখন এ মতামত পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, "শান হাই চিং"-এ ইতিহাসের একটি বড় অংশ রয়েছে এবং এটি প্রাচীন বিশ্ব সংস্কৃতির একটি দুর্দান্ত রেকর্ড। আমরা "শান হাই চিং" অধ্যয়নের মাধ্যমে বিশ্ব সংস্কৃতির রহস্য আরও বেশি করে উন্মোচনের অপেক্ষায় আছি। (ইয়াং/আলিম/ছাই)