চীনা বাদ্যযন্ত্র সুওনা হোনের বাদক লিউ উয়েন উয়েন
2023-06-15 15:02:01

লিউ উয়েন উয়েন শাংহাই কনসারভেটরি অব মিউজিকের একজন তরুণ শিক্ষক। তিনি হলেন সুওনা হোন বাজাতে পারা চীনের প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সক্রিয় হন। তার মাধ্যমে অনেকে চীনের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সুওনা হোনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।

 

লিউ উয়েন উয়েন চীনের শানতোং-এর চি নিং শহরের সুওনা হোন চর্চাকারী একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বছর বয়সে তিনি সুওনা হোন নিয়ে খেলতেন। বড় হওয়ার পর তিনি বাবা মা’র সঙ্গে অসংখ্য থিয়েটার মঞ্চে পরিবেশন করেছেন।

 

লিউ উয়েন উয়েন স্বীকার করেন, প্রথমে তিনি সুওনা হোন বাদ্যযন্ত্র পছন্দ করতেন না। কারণ এই বাদ্যযন্ত্রের শব্দ অনেক বেশি এবং তিনি মনে করতেন, সুওনা হোন ফ্যাশনেবল নয়।

 

একবার তিনি সুওনা হোনের শিল্পী লিউ ইংয়ের বাজানো সঙ্গীত শুনেন। তখন তিনি এ বাদ্যযন্ত্রের প্রতি গভীরভাবে মুগ্ধ হন। তিনি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন যে চীনের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র সুওনা হোনের শব্দ কতটা চমৎকার। তারপর তিনি মন থেকে ভালোভাবে সুওনা হোন শেখার সিদ্ধান্ত নেন।

 

লিউ ইংকে চীনের আধুনিক সুওনা হোনের প্রথম লোক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২০০৮ সালে লিউ উয়েন উয়েন শাংহাই কনসারভেটরি অব মিউজিকে ভর্তি হন এবং লিউ ইংয়ের কাছে সুওনা হোন শিখতে শুরু করেন।

 

অধ্যয়নের জন্য একটি পেশাদার কলেজে প্রবেশ করা লিউ উয়েন উয়েনের সুওনা হোন শিখার যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। যদি আমরা বলি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে বাবা-মা’র কথা শুনে পরিবারের প্রভাবে সুওনা হোন বাজাতেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি সত্যিই সুওনা হোনের প্রেমে পড়ে যান।

 

লিউ উয়েন উয়েন খুব ভালো করেই জানেন যে একটি দক্ষতা যতই চমৎকার হোক না কেন, এটি প্রদর্শনের জন্য একটি মঞ্চ প্রয়োজন। তিনি খুশি যে তিনি তার মঞ্চে খুঁজে পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সারা বিশ্বে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। ফলে লিউ উয়েন উয়েনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিবেশন করার সুযোগ পেয়েছেন।

 

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ‘পাই সিও ছাও ফোং বা শত শত পাখি ফিনিক্সকে শ্রদ্ধা জানায়’ নামের মিউজিক বাজানোর অভিজ্ঞতা লিউ উয়েন উয়েনের মঞ্চ পরিবেশনায় নতুন একটি দরজা খুলে দিয়েছে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক প্রথম শ্রেণীর মঞ্চে পরিবেশন করার সময় লিউ উয়েন উয়েন একটু নার্ভাস ছিলেন। তবে বিখ্যাত পরিচালক থান তুনের কথা তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।

 

থান তুন বলেন, ‘তুমি সুন্দর পশ্চিমা-স্টাইলের পোশাক পরেছো, আমাদের চীনের সবচেয় ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রটি ধরে রেখেছো। তুমি খুব মার্জিতভাবে মঞ্চে উঠেছো এবং আমাদের লোকসঙ্গীত ‘পাই সিও ছাও ফোং’ বাজিয়েছো। তোমার পিছনে বিদেশী সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা তোমার জন্য আবহ সঙ্গীত বাজাচ্ছিলো, কী অপরূপ ছিল সেই মুহূর্ত!’

 

সিডনিতে লিউ উয়েন উয়েনের পরিবেশনা দারুণ সফল হয়েছে। বিদেশী দর্শকেরা বিস্মিত হন যে এই ছোট্ট বাদ্যযন্ত্রটি এত জোরে শব্দ এবং রঙিন পাখির আওয়াজও তৈরি করতে পারে।

 

লিউ উয়েন উয়েনের মঞ্চের যাত্রা এভাবেই ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। তিনি দেখতে পান যে চীনের একটি লোকসঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পশ্চিমা অর্কেস্ট্রার সাথে সুওনা হোনের সহযোগিতায়  কোন বাধা নেই এবং তা বিদেশী শিল্পী ও শ্রোতাদের গভীর সমাদর পেয়েছে।

 

লিউ উয়েন উয়েন আবেগ নিয়ে বলেন, ‘আমার হাতে ধরে রাখা এই সুওনা আমাকে খুব শক্তিশালী করেছে। সম্ভবত আজকের দিনটিতে এত দর্শকের স্বীকৃত পেতে এবং বিশ্বজুড়ে চীনা সঙ্গীতের জন্য প্রশংসা কুড়াতেই আমি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং প্রশিক্ষণ নিয়েছি।’

 

লিউ উয়েন উয়েন তার ‘কারুশিল্প’ উন্নত করে চলেছেন এবং প্রতিদিন অনুশীলন বজায় রেখেছেন। সুওনা ফুঁকার জন্য মুখের চারপাশের পেশীগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা প্রয়োজন। এটি অবশ্যই দীর্ঘসময় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রপ্ত করতে হয়। অথবা মুখের পাশের পেশী গ্রুপের শক্তি খুব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। কয়েক দিন অনুশীলন না করলে টানা ৫ মিনিট মিউজিক বাজাতেও কষ্ট হয়। এখন পর্যন্ত লিউ উয়েন উয়েন দিনে ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অনুশীলন করেন।

 

২০২০ সালে শিক্ষক লিউ ইং-এর অনুপ্রেরণায় লিউ উয়েন উয়েন পিএইচডি করার জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিলো তার জীবনের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

 

এটা কতটা কঠিন? মঞ্চে পরিবেশনার সবচেয়ে কঠিন দিক হলো টানা ৬০ মিনিট ধরে কোনো বাধা ছাড়াই সুওনা বাজানো এবং সর্বোচ্চ পারফরমেন্সের মান বজায় রাখা। কিন্তু পিএইচডির জন্য অনেক বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টা চালাতে হয়।

 

সবাই জানেন, সুওনা বাজানোর জন্য অত্যন্ত উচ্চ ফুসফুসের ক্ষমতা এবং শারীরিক শক্তি প্রয়োজন। বেশি চর্চা করার সময় লিউ উয়েন উয়েনকে দিনে চার বেলা খেতে হয়।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। লিউ উয়েন উয়েন খেয়াল করেছেন যে সুওনা নানা বাদ্যযন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারছে। রক, নাটক এবং আধুনিক পপ উপাদানের সাথেও সুওনাকে একত্রিত করা সম্ভব।

 

তিনি আরও দেখতে পান যে সুওনার জন্য আরও বেশি সংখ্যক সুরকার সঙ্গীত লিখতে শুরু করেছেন। লিউ উয়েন উয়েন গভীরভাবে জানেন যে সুওনা ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন এবং আন্তঃসীমান্ত উদ্ভাবনকে অবশ্যই ঐতিহ্যগত ভিত্তি থেকে দূরে সরে যেতে দেন না।

 

তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির এখনও অনেক কিছু অন্বেষণ করার আছে।’

 

পিএইচডি করার সময় লিউ উয়েন উয়েন শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। এ শিল্পকে ‘বাঁচিয়ে রাখা’ প্রসঙ্গে তিনি নিজের অনুভূতি তুলে ধরেন। ভবিষ্যতে আমার প্রত্যেক ছাত্র ভিন্ন পথে চলতে পারবে; প্রত্যেক পথেই সুওনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। এভাবে এর বিস্তার সম্ভব হবে এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ লোকসঙ্গীত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আধুনিক মঞ্চে সক্রিয় থাকবে।

 

লিলি/এনাম/রুবি