বয়স্কদের যত্ন ও চীনা যুবক-যুবতীদের নতুন চাকরির সুযোগ প্রসঙ্গ
2023-06-12 14:58:42

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে বয়স্ক লোকের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিষয়টি চীনে এখন একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়। ক্রমবর্ধমান প্রবীণদের যথাযথ যত্নের ব্যাপারটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যু। এ প্রেক্ষাপটে চীনে প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নতুন ধরনের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক তরুণ-তরুণী এই সুযোগ গ্রহণ করছেন। আজকের আসরে আমরা এই নতুন চাকরি ও চাকরির সুযোগ গ্রহণকারীদের সম্পর্কে আলোচনা করবো।

 

চীনের প্রবীণদের যত্নের সাথে সম্পর্কিত যেসব চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলোর সুন্দর সুন্দর নামও আছে। যেমন, ‘স্নান সহকারী’, ‘হাসপাতালে যাওয়ার সহকারী’, ‘প্রবীণদের স্বাস্থ্যরক্ষক’ ইত্যাদি। এসব কর্মী বা সহকারী প্রবীণদের যত্ন নেন, বিভিন্ন ধরনের সেবা দেন। দিন দিন এসব পেশা ও সেবার মানও বাড়ছে।

 

১৯৯২ সালে জন্মগ্রহণকারী নারী ইন ইয়ু হুই বর্তমানে ৫০০ জনেরও বেশি প্রবীণ ব্যক্তির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।  তাঁদের মধ্যে অনেকের বয়স ৯০ বছরেরও বেশি। শানতুং প্রদেশের ওয়েহাই শহরে জন্মগ্রহণকারী এ মেয়ে এসব প্রবীণের কাছে নাতনীর মতো। তাঁর প্রধান কাজ প্রবীণদের দেখাশোনা করা। তাঁদের হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাওয়া, দৈনিক খাবার খাওয়ানো, তাদের জন্য ডায়াপার কেনা ও চুল কাটানোর ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন কাজ নারী ইন ইয়ু হুই’র চাকরির মূল অংশ। প্রতিদিন তাঁর মোবাইল ফোন ব্যস্ত থাকে। তিনি মনোযোগ দিয়ে প্রত্যেক প্রবীণের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন।

 

নিজের এ চাকরি সম্পর্কে ইন বলেন, “প্রবীণরা একসময় যুবক বা যুবতী ছিলেন। তাঁরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হয়েছেন। তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা এখনও তরুণ। তাই, বৃদ্ধ হওয়ার পর তাদের মানসিক অবস্থা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, মোকাবিলা করতে হবে। তাদের মনের অবস্থা ভালো করে বুঝতে হবে।”

 

অনেক বয়স্ক লোক একা একা বাড়িতে থাকেন। বয়স্ক হওয়ার কারণে তাঁরা ভালো করে নিজেদের যত্ন নিতে পারেন না। তাই ইন ইয়ু হুই তাদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দেন, টয়লেট পরিষ্কার করে দেন। এ কাজে অভ্যস্ত হতে তাঁর সময় লেগেছে।

 

প্রবীণদের পরিষেবাকেন্দ্রে মোট ৮ জন পেশাদার নার্সিং কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন প্রবীণদের দেখাশোনা বিভাগ থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং তাদের বয়স ৩০ বছরের চেয়ে কম। ১৯৯৯ সালে জন্মগ্রহণকারী মেয়ে লিউ রুই প্রবীণদের পরিষেবা ও যত্ন বিষয়ে স্নাতক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কাজে যোগ দেন।

 

মেয়ে লিউ রুই’র জন্মস্থান চীনের হ্যপেই প্রদেশের পাওতিংয়ের গ্রামাঞ্চলে। প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার এই নতুন শিল্পের ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্রবীণদের দেখাশোনার কাজ সহজ নয়। তবে, প্রবীণদের জীবনের অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জানার জন্য এই পেশাটি বেশ কাজের।” তাঁর কাজের তাত্পর্য সম্পর্কে লিউ বলেন, একবার একজন বৃদ্ধাকে খাবার দেওয়ার সময় তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি লাঞ্চ খেয়েছো? বৃদ্ধার প্রশ্ন শুনে লিউ আপ্লুত হন।

 

নার্সিং কর্মী ইন বলেন, যুবক-যুবতীদের প্রাণশক্তি ও প্রাণবন্ত চরিত্র বয়স্কদের মেজাজ-মর্জির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মিস ইন বৃদ্ধা চাওয়ের গল্প তুলে ধরেন। চাও সুস্বাদু খাবার খেতে বেশ পছন্দ করেন। মিস ইনের সাথে তিনি অনেক নতুন খাবার খেতে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় গেছেন। পিজা, বুফে, লবস্টার ইত্যাদি তিনি ইনের সাথে খেয়েছেন। চাওয়ের সাহচর্যে মিস ইনও তাঁর ভালোবাসা অনুভব করেন। একসময় চাও আলঝাইমার রোগে আক্রান্ত হন। ইন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আশা করি, তিনি আমাকে ভুলে যাবেন না।’

 

আগেই বলেছি, বর্তমানে চীনে বয়স্ক লোকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই, তাদের যত্ন নিতে পারদর্শী নার্সিং কর্মীদের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। বিশেষ নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় পাস করে তাদেরকে এই পেশায় ঢুকতে হয়।

 

যুব নার্সিং কর্মী ইন খাই ইয়ু বলেন, প্রবীণদের যত্ন নেওয়া নার্সিং কর্মীদের বেতন বেশি নয়। বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী  কর্মীরাই নার্সিং কর্মীদলের মূল শক্তি। ২০২০ সালে চীনের পেশাদার নার্সিং কর্মীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশের বয়স ৪৬ বছরের চেয়ে বেশি ছিল।

 

মিস ইন বলেন, বয়স্কদের নার্সিং পরিষেবা দানকারীদের সামাজিক মর্যাদা একটু কম। তাই অনেক যুবক-যুবতী এ চাকরি করতে চান না। তা ছাড়া, শুরুর দিকে কাজটি তেমন আকর্ষণীয় মনে হয় না। কিন্তু কয়েক বছর একাধারে কাজ করে গেলে তখন পেশাটি প্রায় সবারই ভালো লাগতে শুরু করে।

 

বয়স্কদের বহুমুখী নার্সিং চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সও সম্পন্ন করেছে ইন খাই ইয়ু। দৈনন্দিন যত্ন, মৌলিক নার্সিং, সাধারণ রোগের নার্সিংসহ বিভিন্ন কাজে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি, জাপানের বীমা নার্সিং ব্যবস্থা সম্পর্কেও তাঁর ভালো জানাশোনা আছে। জাপানের বীমা নার্সিং ব্যবস্থা জাপান থেকে আসা এক ধরনের নার্সিং ব্যবস্থা, যা বয়স্কদের যত্ন নেয়। জাপান সরকার এ বিশেষ বীমা ব্যবস্থা চালু করেছে। জাপানি নাগরিকরা ৪০ বছর বয়স থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত এ বীমার জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম জমা দেন এবং ৬৫ বছর বয়স থেকে সরকার তাদের হয়ে প্রিমিয়াম দেয়।

 

বীমার আওতায় নার্সিং কর্মীর বেতন ও ব্যবস্থাপনার খরচ বহন করা হয়। তাদের নার্সিং ব্যবস্থায় দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ, কাপড়চোপড় ধোয়া, শপিং ও রান্নার কাজে সহায়তা, বাড়িঘরে বয়স্কদের স্নানে সাহায্য করা, শরীরচর্চা, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত বয়স্কদের বাড়িতে যান নার্সিং কর্মীরা। তাদের খাওয়া, থাকা, পুনর্বাসন ও বিনোদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা সহায়তা দেন।

 

লেই সিয়াও চিং বেইজিংয়ের একটি নার্সিং পরিষেবা কোম্পানির নার্সিং কর্মী। তিনি সিনিয়র কর্মীর যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বর্তমানে বয়স্কদের পরিষেবা শিল্পে দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিদের দরকার। নতুন জ্ঞান ও তথ্য জানা এ পেশায় খুব জরুরি। তা ছাড়া, এই পেশায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে।  সম্প্রতি লেই’র কোম্পানি আরও উন্নত ‘স্নান সহকারী সরঞ্জাম’ কেনা হয়েছে। তিনি এ নতুন সরঞ্জামের ব্যবহারপদ্ধতি শিখেছেন। এখন তিনি এই সরঞ্জাম ব্যবহার করে বয়স্কদের সংশ্লিষ্ট সেবা দিতে পারেন।

 

সম্প্রতি বেইজিংয়ের শিচিংশান এলাকার নার্সিং কর্মীদের প্রতিযোগিতায় লেই সিয়াও চিং চ্যাম্পিয়ন হন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আজকাল নার্সিং সেবার বিষয় অনেক বিস্তারিত ও নির্দিষ্ট। ৪৮ বছর বয়সী নারী লেই সিয়াও চিং চীনের হ্যনান প্রদেশের চৌখৌ শহরের শাংসুই জেলার লোক। টানা ১০ বছর ধরে তিনি নার্সিংসেবা দেওয়ার কাজে জড়িত আছে। তিনি এ শিল্পের দ্রুত উন্নয়নের স্বাক্ষী।

 

বর্তমানে লেই সিয়াও চিংয়ের নার্সিং পরিষেবার মধ্যে রয়েছে: বয়স্কদের জন্য স্নান সহায়তা দেওয়া; খাবার খাইয়ে দেওয়া; বয়স্ক রোগীদের বেডসোর প্রতিরোধ করা; বিছানায় শুয়ে থাকার ভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়তা দেওয়া, ইত্যাদি। গত কয়েক বছরে বয়স্কদের স্নানের সহকারীদের চাহিদা অনেক বেড়েছে। তখন তিনিও নতুন দক্ষতা শিখে নেন। বয়স্কদের স্নানে সহায়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, বস্তুত এর জন্য অনেক কৌশলী হওয়া দরকার। কারণ, বয়স্কদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে স্নানের উপযোগী সময় খুঁজে বের করতে হবে। যদি তাঁদের শরীর দুর্বল হয়, তাহলে অন্য সময় বেছে নিয়ে স্নান করাতে হবে। স্নানের মোট সময় আর পদ্ধতি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই।

 

নার্সিং কর্মী লেই মনে করেন, বয়স্কদের পরিষেবা বিষয়ে মানুষের বোঝাপড়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অতীতে অধিকাংশ লোক মনে করতেন, নার্সিংয়ের কাজ মানে বয়স্কদের যত্ন নেওয়া। কিন্তু আধুনিক পেশাদার নার্সিংয়ের কাজ অনেক পরিণত ও বিস্তৃত।

 

৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে স্নানে সহায়তা করতে গিয়ে লেই যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা তাঁর স্মৃতিতে এখনও অম্লান। শুরুর দিকে বৃদ্ধা অনেক লজ্জা পেতেন; লেই’র সহায়তা গ্রহণ করতে চাইতেন না। তবে, ধীরে ধীরে তাঁর লজ্জা কাটতে থাকে। লেই যত্নের সাথে বৃদ্ধার শরীর পরিস্কার করতে থাকেন। বৃদ্ধা কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তাঁর চোখে লেই ঠিকই কৃতজ্ঞতার ছায়া দেখতে পেতেন। বৃদ্ধার কৃতজ্ঞতার হাসি লেই’র জন্য ছিল বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক।

  (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)