"পেইচি ছিয়ানচিন ইয়াওফাং": চীনে ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের প্রথম বিশ্বকোষ
2023-06-09 16:46:14

"পেইচি ছিয়ানচিন ইয়াওফাং" তথা "জরুরি অবস্থার জন্য জরুরি প্রেসক্রিপশন", যাকে সংক্ষেপে "জরুরি প্রেসক্রিপশন"-ও ডাকা হয়, ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবাসম্পর্কিত বইগুলোর অন্যতম। এটি একটি চিকিত্সাবিষয়ক মাস্টারপিস, যা "মেডিসিনের রাজা" নামে পরিচিত সুন সি মিয়াও তাঁর সারা জীবনের সাধনায় লিখেছেন। এর ৩০টি ভলিউম রয়েছে। এতে থাং রাজবংশ আমলের আগের রোগনির্ণয় ও চিকিত্সা-অভিজ্ঞতা সংকলিত হয়েছে। এটি পরবর্তী প্রজন্মের ডাক্তারদের ওপর বড় প্রভাব ফেলে।

বইটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে জীবন সম্পর্কে সুন সি মিওর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলতেন, "মানুষের জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হাজার সোনার সমতুল্য। একটি প্রেসক্রিপশন দিয়ে যদি জীবন রক্ষা করা যায়, তাহলে তার পুণ্য হাজার সোনাকে ছাড়িয়ে যাবে।" পরে তিনি "ছিয়ানচিন ইফাং" নামে একটি বই লেখেন, যার মূল বিষয়বস্তু ছিল ওষুধ, টাইফয়েড জ্বর, স্ত্রীরোগ, শিশুরোগ, বিবিধ রোগ, আকুপাংচার এবং মক্সিবাস্টন।

"ছিয়ানচিন ইয়াওফাং"-এর প্রথম অধ্যায়ে তালিকাভুক্ত "মহান ডাক্তারের আন্তরিকতা ও দক্ষতা" এবং "মহান ডাক্তারের অনুশীলন" হচ্ছে চীনা চিকিত্সা নীতিশাস্ত্রের ভিত্তি। বইয়ের মধ্যে স্ত্রীরোগবিদ্যা ও শিশুরোগবিদ্যার ওপর নিবেদিত আলোচনা, সুং রাজবংশ আমলে স্ত্রীরোগবিদ্যা ও শিশুরোগবিদ্যার জন্য আলাদা ভিত্তি স্থাপন করে।

মেডিকেল বিভাগে চিকিত্সার জন্য অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গকে মূল হিসাবে বিবেচনা করতে হয় এবং কম বা বেশি ঠান্ডা ও গরমের কথা বিবেচনায় রেখে প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়। একাডেমিক চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে, সুন সি মিওর "ছিয়ানচিন ইয়াওফাং" অভ্যন্তরীণ বিভাগ (মেডিসেন বিভাগ), বাহ্যিক বিভাগ (অস্ত্রোপচার বিভাগ), স্ত্রীরোগবিদ্যা (গাইনোকলোজি), শিশুরোগবিদ্যা (পেডিয়াট্রিক্স), মুখের বৈশিষ্ট্য, আকুপাংচার এবং পুষ্টির মতো চিকিৎসা শ্রেণীবিভাগের ভিত্তি তৈরি করেছে এবং পরবর্তীতে ক্লিনিকেল চিকিত্সার প্রচারে ভূমিকা রেখেছে।

সুন সি মিয়াও অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে নির্দেশিকা হিসাবে নিয়েছিলেন এবং প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ভিসেরা পরীক্ষাকে মূল মানদণ্ড হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে প্রতিটি ভিসেরাকে সাধারণভাবে তালিকাভুক্ত করেন। তিনি আগের চিকিত্সা বই "সু ওয়েন", "লিংশিউ" এবং সুবিখ্যাত ডাক্তার পিয়ান ছুয়ে, হুয়া থুও এবং চাংচুংচিং  নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন।

সুন সি মিয়াও প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু ওষুধই নয়, প্রেসক্রিপশনও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ওষুধ রোগ নিরাময় করতে পারে; তবে, এগুলোর থেরাপিউটিক প্রভাব আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্দিষ্ট নীতি অনুসারে নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন লিখতে হবে। তিনি মনে করেন, “বিভিন্ন ওষুধের পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া যেমন থাকতে পারে, তেমনি পরিপূরক চরিত্রও থাকতে পারে। পরিপূরক চরিত্র থাকলে একাধিক ওষুধে রোগ নিরাময় না-হলেও, অভ্যন্তরীণ অঙ্গের জন্য তা কল্যাণকর হতে পারে।”

সুন সি মিয়াও সামগ্রিকভাবে রোগনির্ণয় ও চিকিত্সার ওপর জোর দিতেন। তিনি বলেন, "ঔষধ জানা কিন্তু মক্সিবাস্টন না-জানা, শরীরের সম্পূর্ণ চিকিত্সার জন্য যথেষ্ট নয়; আবার শুধু মক্সিবাস্টন জানা, কিন্তু আকুপাংচার না-জানা বাইরে থেকে ভিতরের পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট নয়।"

সুন সি মিয়াও ওষুধ সম্পর্কে ভালো জানতেন, আকুপাংচারে দক্ষ ছিলেন, এবং মক্সিবাস্টনেও ভালো ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রোগের চিকিত্সার ক্ষেত্রে, আমাদের অবশ্যই একে অপরের শক্তি থেকে শিখতে হবে এবং আমাদের দুর্বলতাগুলো পূরণ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের চিকিত্সা-পদ্ধতি আয়ত্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনে নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে হবে।

সুন সি মিয়াও চিকিত্সাবিদ্যায় অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন, যার মধ্যে চিকিৎসার সমস্ত দিক জড়িত। তিনি জ্বরজনিত রোগ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং “ছিয়ানচিন ইয়াওফাং”-এ জ্বরজনিত রোগ ও এর চিকিত্সা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। সুন সি মিয়াও "প্রথমে নারী তারপর শিশু, প্রথমে বেরিবেরি এবং তারপর স্ট্রোক, টাইফয়েড জ্বর, কার্বাঙ্কল, ডায়াবেটিস, শোথ, সাতটি ছিদ্রের রোগ, পাঁচটি পাথরের বিষ, জরুরি অবস্থার জন্য প্রেসক্রিপশন, এবং স্বাস্থ্য সংরক্ষণের কৌশল, মোট ২৩২ ধরনের রোগের জন্য সম্মিলিত পাঁচ হাজার তিনশো প্রেসক্রিপশন" লিপিবদ্ধ করেন।

"ছিয়ানচিন ইয়াওফাং" ডায়েট থেরাপির পক্ষে। "কারুর জীবনের ভিত্তি অবশ্যই খাদ্যের ওপরে নির্ভর করে; রোগ নিরাময়ের দ্রুততা অবশ্যই ওষুধের ওপর নির্ভর করে।" সুন সিমিও জোর দিয়ে বলেন, "ওষুধ হল সৈন্যদের ব্যবহারের মতো, এবং এর প্রকৃতি শক্তিশালী। যদি এটি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তবে কেবল এতে রোগ নিরাময় হয় না, বরং শরীরের ক্ষতিও হয়।" যদি খাদ্য দিয়ে রোগ নিরাময় করা যায়, তবে ওষুধ সেবন করবেন না; যদি আহারে আরোগ্য না হয় তবে ওষুধ খান। সুন সি মিয়াও বিশ্বাস করতেন যে, খাবার "আত্মাকে খুশি এবং সতেজ করে, স্বাস্থ্য এবং রক্তকে পুষ্ট করার" শক্তি রয়েছে। যেমন, রাতকানা চিকিত্সার জন্য ভেড়ার কলিজা খাওয়া কল্যাণকর।

"ছিয়ানচিন ইয়াওফাং"-এর একটি বিশেষ কলাম "ডায়েট থেরাপি" রয়েছে। এতে শস্য, মাংস, ফল, শাকসবজি এবং অন্যান্য খাবারের সহায়ক থেরাপিউটিক প্রভাবগুলো বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, "যে মানুষ অসুস্থতা কমাতে এবং রোগ উপশমে খাদ্যের ব্যবহার জানে, তাকে ‘ভালো কর্মী’ বলা যেতে পারে।” তিনি বিশ্বাস করতেন, যারা খাবার ঠিকমতো খায়, তাঁরা সারাবছর ভালো থাকে। তিনি বলতেন, সন্ধ্যায় বেশি না-খাওয়া ভালো; সন্ধ্যায় মাতাল না-হওয়া ভালো; সন্ধ্যায় দূরে না-যাওয়া ভালো।  

তিনি মাসাজ, হাঁটাহাঁটি, হালকা শ্রম, খাদ্যের থেরাপি, এবং স্বাস্থ্যবিধির সংমিশ্রণের পক্ষে ছিলেন। তিনি রোগপ্রতিরোধ ও চিকিত্সার ক্ষেত্রে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। "ছিয়ানচিন ইয়াওফাং” অনেক ভুল আচরণও লিপিবদ্ধ করেছে, যা শুধুমাত্র রোগের মূল কারণ নয়, রোগের পুনরাবৃত্তির কারণও বটে।

সুন সিমিয়াও-এর "ছিয়ানচিন ইয়াওফাং”-য়ে বলা হয়েছে যে, ডায়াবিটিস নিবারণ করা যায়। কিন্তু এর জন্য মশলার ব্যবহার কমাতে হবে। এতোটুকু মশলা ব্যবহার করবেন, যেটুকু শস্যের স্বাভাবিক গন্ধ দূর করে না-দিতে পারে। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে, সুন সি মিয়াও-এর লেখায় অনেক ঘাটতিও রয়ে গেছে। তবে, তা “ছিয়ানচিন ইয়াওফাং”-এর মহান অর্জনকে খর্ব করেনি। উত্তর সং রাজবংশ আমলের একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী লিন ইয়ি, "ছিয়ানচিন ইয়াওফাং” এবং “ছিয়ানচিন ইফাং” সংশোধন করার সময় বলেন: "এই দুটি বই, শুরু থেকে সুই রাজবংশ পর্যন্ত, চিকিত্সা তত্ত্ব থেকে শুরু করে প্রেসক্রিপশন, এমনকিছু নেই যা গ্রহণ করেনি, এবং প্রচুর নতুন বিষয় যুক্ত করেছে। (ইয়াং/আলিম/ছাই)