উত্তর চীনের খাদ্য ভাণ্ডার
2023-06-07 17:39:55

আপনারা জানেন যে চীন একটি বড় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদক দেশ। চীনের লোকসংখ্যা ১৪০ কোটি এবং সবার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উত্তর-পূর্ব চীনের হেই লং চিয়াং প্রদেশ চীনের বৃহত্তম ধান উত্পাদন এলাকা। গত মাসে আমি হেইলং চিয়াং প্রদেশের ফু চিন জেলায় গিয়েছিলাম। এ অঞ্চলকে ‘উত্তর চীনের খাদ্য ভাণ্ডার’ বলা হয়। এটি চীনের বৃহত্তম ধান চাষ এলাকাও বটে। ২০২২ সালে ফু চিন জেলার খাদ্য উত্পাদন পরিমাণ ছিল ৩২০ কোটি কেজি। এখানকার বাম্পার ফলনের পেছনের রহস্য জানতে গিয়ে আমি নানা তথ্য সংগ্রহ করেছি।

 

ফু চিন জেলা শান চিয়াং সমতল ভূমিতে অবস্থিত। শান চিয়াং মানে তিন নদী। সুং হুয়া নদী, হেই লং চিয়াং নদী ও  উসুলি নদী প্রবাহিত এলাকায় বিশাল যে সমতল ভূমি সৃষ্টি হয়েছে- সেটিই শান চিয়াং। পাশাপাশি, শান চিয়াং সমতলভূমি বিশ্বের মাত্র তিনটি কালো মাটির সমতলের অন্যতম। কালো মাটি বিশ্বে সবচেয়ে উর্বর জমি। তার গড় গভীরতা হল ৩০-১০০ সিএম এবং সর্বোচ্চ গভীরতা হতে পারে ২ মিটার। কালো মাটিও চীনের বৃহত্তম বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদনকারী এলাকা। ফু চিন উত্তর চীনের একটি জেলা। উত্তর চীনের আবহাওয়া অন্য জায়গার তুলনায় একটু ঠাণ্ডা বলে মে মাসের শেষ দিকে এখানে ধানের চারা রোপণ মাত্র শেষ হয়।

 

আমি লক্ষ্য করেছি, এখানে মানুষের বদলে অধিক পরিমাণে মেশিন দিয়ে কৃষি কাজ করা হয়। তাহলে কৃষকরা কীভাবে ধান ক্ষেত ব্যবস্থাপনা করেন?  এর উত্তর পেতে আমি সুই থিয়ান নামের একটি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সমবায়ের পরিচালক লিউ ছুনের সঙ্গে কথা বলেছি।

 

তিনি আমাকে জানিয়েছেন,  সমবায় মোট ৭০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করে এবং অধিকাংশ ধানের চারা মেশিন দিয়ে রোপণ করা হয়। পাশের ছোট্ট একটি ক্ষেতে আমরা পরীক্ষা করছি। বিভিন্ন ধরনের ধান আমরা এখানে চাষ করি। কোন ধরনের ধানের বেশি ফলন হয় এবং কোনটির চালের মান ভাল- তা পর্যবেক্ষণ করি। পরে এ ধরনের ধান আমরা কৃষকদের হাতে তুলে দিই। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন? ড্রোন এখন জমি উর্বর করার কাজ করছে। আমাদের জন্য এখন ধানের চাষ খুব সহজ ও সুবিধাজনক হয়। পুরো প্রক্রিয়াই মেশিন দিয়ে করা যায় । যেমন: ফোনের সাহায্যে কখন বা কত বার সেচ করা যায় - তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ধান ক্ষেতে স্থাপন করা হয় নানা  রকম ক্যামেরা। এসবের সাহায্যে বাসায় বসে আমরা ফোনের মাধ্যমে ধান ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে পারি। মানুষের তুলনায় মেশিন বেশি কার্যকর এবং ব্যয়ও কম হয়।

 

আধুনিক কৃষি এখন চীনে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। কৃষকরা কৃষি কাজে এখন আবহাওয়া নয়, বরং প্রযুক্তির উপর বেশি নির্ভর করেন।

 

আমরা ধান ক্ষেত নয়, বরং একটি ধানের পার্কে গিয়েছিলাম। পার্কের ভেতরে রয়েছে জাহাজ আকারের একটি ভবন। এটি আসলে একটি আধুনিক কৃষি তথ্য ও পরিচালনা কেন্দ্র। আমি পার্কের দায়িত্বশীল ব্যক্তি চাং ইউয়ুর সঙ্গে  কথা বলেছি। তিনি আমাকে নিয়ে এ কেন্দ্রে দেখতে বেড়িয়েছেন। বড় একটি মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে জানিয়েছেন, আমাদের ব্যবস্থাপনায় সারা জেলার কৃষি বিষয়ক নানা তথ্য পাওয়া যায়। যেমন: যদি আমরা গ্রিন হাউসের অবস্থা দেখাতে চাই, তাহলে আমরা ওই অঞ্চলের চিত্র  এ স্ক্রিনে প্রচার করি। পাশাপাশি, গ্রিন হাউসের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তথ্যও মনিটরে দেখা যায়। ফু চিন জেলায় ৬৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশন আছে এবং ওই স্টেশনগুলোর সব তথ্য এ মনিটরে দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা এসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কৃষকদেরকে পেশাদার পরামর্শ দেন। পরামর্শগুলো বিশেষ একটি ফোন অ্যাপের মাধ্যমে দেখতে পারা যায়। এ অ্যাপে সরকারের নতুন নিয়ম ও নীতি, চরম আবহাওয়ার পূর্বাভাস ইত্যাদি রয়েছে। কৃষকরা এসব তথ্য পেয়ে বুঝতে পারেন পরবর্তীতে তারা কী কী কৃষি কাজ করতে পারবেন।

 

দু’জনের কথা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি,  আধুনিক কৃষিতে প্রযুক্তি কত বেশি ভূমিকা পালন করছে। ২০২২ সালে ফু চিন জেলা টানা ১৯ বছরের মতো খাদ্যের বাম্পার ফলন প্রত্যক্ষ করেছে। এখানকার সব খাদ্য উচ্চ মানের এবং কৃষি খাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান ৭০ শতাংশের বেশি।

 

ধান ক্ষেতে আমি কয়েকজন কৃষককে দেখেছি। তারা বিশেষ একটি কাজ করছেন। তারা ধান দিয়ে চিত্র আঁকছেন। প্রতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে অনেক পর্যটক এখানে ধানের চিত্র দেখতে  আসেন। কৃষকরা রঙিন ধানের চারা রোপণ করেন এবং দু’মাস পর বিভিন্ন রঙের ধান নানা চিত্র তৈরি করে। উঁচু একটি টাওয়ার থেকে নীচে তাকালে এ সুন্দর ধান ক্ষেতের চিত্র দেখা যায়। এটি স্থানীয় পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

 

এই উর্বর ভূমিতে আমি এক ধরনের সমৃদ্ধ শক্তি অনুভব করি। শুধু বিশ্ববিখ্যাত চাল নয়, বরং বহু পরিশ্রমী মানুষও এখানে রয়েছেন। তাদের  মাধ্যমে আমি চীনা গ্রামের নতুন রূপ দেখি এবং এ জায়গার প্রেমে পড়ে গেছি। (শিশির/এনাম/রুবি)