চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীনে দশ দিনব্যাপী সফর করছেন।
বৈশ্বিক মহামারী প্রশমনের পর এই প্রথম বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ চীন সফর করলেন। বেইজিং সফরকালে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান চায়না মিডিয়া গ্রুপের (সিএমজি) বাংলা বিভাগের পরিচালক ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দীকে একান্ত একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি চীন সফর এবং দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।
আনন্দী: মহামারীর পর আমন্ত্রণিত আপনি প্রথম বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে চীন সফর করতে এসেছেন। আপনাদের আগমন চীন ও বাংলাদেশের প্রতি একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তাই না?
ফারুক খান: আমরা জানি আপনাদের বাংলা বিভাগ বাংলা ভাষাভাষীর জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে করে থাকে। বাংলাদেশেও অনেকে এই অনুষ্ঠান দেখে ও শ্রবণ করে। সিএমজি কে সাক্ষাৎকার দিতে পেলে আমি আনন্দিত।
বিশেষ তাৎপর্য আছে এজন্য যে,’কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ আমাদেরকে জানিয়েছে এবারের সফরের বেশকিছু বিশেষত রয়েছে। প্রথমত, করোনার পর এটাই প্রথম কোনো বিদেশী দলের সফর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে এবং অন্য কোনো জায়গা থেকে এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি দল (১৭ জনের)। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ আর আওয়ামীলীগের বন্ধুত্ব ও সমঝোতা অনেক গভীরে এবং সে সঙ্গে আমাদের উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব কতটা গভীর। এটা একটা উচ্চ প্রমাণ বলে আমি মনে করি।
আনন্দী: এবারের সফরের প্রধান প্রধান কর্মসূচী কী?
ফারুক খান: আমাদের কর্মসূচি মোট দশ দিনের। দশ দিনের মধ্যে তিন দিন বেইজিংয়ে এরপর আমরা নানজিং যাবো, সেখানে আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের মিটিং আছে। তারপর আমরা ইনছুয়ানে যাবো। কমিউনিস্ট সদস্যদের সঙ্গে দেখা করবো, তাঁরা কীভাবে তৃণমূল পর্যায় কাজ করে, সেটা দেখবো। সেখানকার মানুষ কীভাবে বসবাস করেন, সেটাও দেখবো আমরা। অবশ্য এর মাধ্যমে চীনে যে প্রচন্ড উন্নয়ন হয়েছে, আধুনিকায়ন হয়েছে, সেটাও দেখবো।
আনন্দী: চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আর সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনা জনগণ এখন পুরোদমে চীনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আধুনিকায়নের নির্মাণকাজ করছেন।এবারের সফরে আপনি চীনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আধুনিকায়নের কোনো নতুন ধারণা পেয়েছেন?
ফারুক খান: আমি যখন গতবার এসেছিলাম (২০১৯) সালে তখন কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে জানতে পারি। তখন আমরা চীনের আধুনিকায়নও দেখেছি। কোভিড সত্ত্বেও চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আপনারাও জানেন, কোভিডের সময় চীন আমাদেরকে প্রায় পাঁচ মিলিয়ানের উপরে ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দিয়েছে।
এছাড়াও প্রায় ৭৭ মিলিয়ন ভ্যাকসিন আমরা কিনেছি এবং বাংলাদেশ সম্ভবত প্রথম দেশ যেখানে চীন বিক্রি করেছিল।
এর বাইরেও বাংলাদেশ থেকে আমরা চীনে বিভিন্ন কিট ও কাপড়চোপড় উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলাম। অর্থাৎ কোভিডকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য উভয় দেশ পরস্পরকে সমর্থন করেছে, সহযোগিতা করেছে। চীনের একটা চিকিৎসক দলও বাংলাদেশে গিয়েছিল আমাদের করোনা পরিস্থিতি দেখতে এবং আমাদের পরামর্শ দিতে। আমি মনে করি, আধুনিকায়নের মধ্যে কোভিড আমাদের উভয় দেশকে কিছুটা পিছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমরা দু’পক্ষের সাথে খুব জোরালোভাবে যোগাযোগ করেছি। এবারের সফরে আমরা যেখানে যাবো, সেখানের জনগণের সঙ্গে কথা বলবো। নিজের চোখে চীনের আধুনিকায়ন দেখবো।
আনন্দী:চলতি বছর ‘ওয়ান বেল্ট এ্যান্ড ওয়ান রোড’ উদ্যোগ উত্থাপনের দশম বার্ষিকী। বাংলাদেশে নির্মাণরত ‘ওয়ান বেল্ট এ্যান্ড রোড’ সংক্রান্ত প্রকল্পও কম নয়। যেমন, চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র, কর্ণফুলি নদীর টানেল ইত্যাদি। আপনি কী মনে করেন, এ প্রকল্পগুলো চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেমন ভূমিকা পালন করছে?
ফারুক খান: প্রথমেই আমি বলবো , বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সাথে জড়িত আছে। কারণ আমরা মনে করি যে, যখন এক দেশ আরেক দেশের সাথে যোগাযোগ বাড়বে তার মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের সমৃদ্ধি ও উন্নতি আসবে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের মাধ্যমে সারা বিশ্বে একটা সেতু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সার্বিক উন্নয়নে উন্নিত হবে বলে আমরা মনে করি। এর অংশ হিসাবে চীন বাংলাদেশে পদ্মসেতুর রেললাইন, কর্ণফুলি ট্যানেল, আট’টি চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু, বঙ্গবন্ধু প্রদর্শনী কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র, এগুলোর মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে, জনগণের সাথে সম্পর্ক বেড়েছে। আমি মনে করি, যখন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, তখন যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই এমওইউ-এর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগের বাস্তবায়নের পথে চলছে, এখনো তিন ভাগের প্রায় ২ ভাগ বাস্তবায়ন হওয়ার বাকি আছে, যতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, ইতোমধ্যে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নত হয়েছে। আমি এতটুকু আপনাকে বলতে পারি, ঢাকা থেকে আমার নির্বাচন এলাকা মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে কিন্তু পদ্মা সেতু না থাকার কারণে আমাকে ওখানে যেতে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা লাগতো। এখন পদ্মা সেতু হওয়াতে এবং কিছু দিনের মধ্যে পদ্মা সেতুর ওপর রেল লাইন বাস্তবায়নে আমাদের যাত্রা সময় হ্রাসে দেড় থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের উদ্দেশ্য একটা চমৎকার সংযোগ স্থাপন করা, যোগাযোগ ভালো করা। এভাবে একজন অন্যজনের সাথে অংশীদার হতে পারে। আমি মনে করি, আমাদের সঙ্গে যে চুক্তিগুলি হয়েছে, সেগুলি বাস্তবায়নের ফল ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি,উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে এবং আগামীতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নে বড় অবদান রাখবে। আমরাও চীনের মতো আধুনিকায়নের পথে যেতে পারবো।
আনন্দী:এবার চীন সফরের সময় কি কি ক্ষেত্রে আপনার জানা ও দেখার আগ্রহ বেশি রয়েছে? যেমন চীনের গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ইত্যাদি।
ফারুক খান: সকল ক্ষেত্রে আগ্রহ আছে আমাদের, কারণ চীনের সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে, আপনি যেটা বললেন, প্রথমেই আমি মনে করি চীনের রেলওয়ের উন্নয়ন। এটা যদি আমরা বাংলাদেশে নিতে পারি তাহলে আমাদের যোগাযোগ আরো আধুনিক ও সহজ হবে। এছাড়াও পরিবেশের কথা আপনি বলছেন। আমি আজকে এক সেমিনারে ছিলাম, সেই সেমিনারে বলা হয়েছে যে, চীন আধুনিকায়ন করছে পাশাপাশি তাঁরা পরিবেশ রক্ষাও করছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম যে, পৃথিবীতে সবসময় আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের একটা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যখন আপনি আধুনিকায়ন করবেন, আপনাকে গাছপালা কাটতে হবে, অনেক ক্ষেত্রে পাহাড়-নদী বাঁধা হবে অর্থাৎ আপনি পরিবেশকে বিরক্ত করছেন। বিষয়টি চীন যেভাবে উন্নয়ন করেছে, তারা কিভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে পরিকল্পনা করেছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে আমাদের অধ্যাপক সাহেব উত্তরে বলেছেন, সমন্বয়ের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে।
চীন যখন উন্নয়নমূলক কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করে, তখন তারা মনে করেছে, এখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে পরিবেশের কী ক্ষতি হতে পারে? এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সে ক্ষতি কীভাবে পূরণ করা যায়।
শুধু বাংলাদেশে নয়, এখন সারা বিশ্বে পরিবেশ একটা বড় সমস্যা। আমি মনে করি যে, যারা অতি দরিদ্র সেখান থেকে চীন প্রায় ১০০ কোটি লোককে বের করে নিয়ে এসেছে।বাংলাদেশে এখন প্রায় ৫ শতাংশ লোক যারা খুবী গরীব। আমরা প্রকল্পগুলি দেখবো, যারা সফলভাবে এ প্রকল্পগুলি হাতে নিয়েছে, যাতে বাংলাদেশও চীনের মতো অতি দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারে। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা চীনের মতো একটা আধুনিক দেশ হতে পারবো। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের উন্নয়ন, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু জাতীয় পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর কন্যা বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের শ্রদ্ধেয় সভাপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য একই সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। আমি মনে করি, এবারের সফর থেকে আমরা যে ধারণা নিয়ে যাবো,তার সফল বাস্তবায়ন আমরা বাংলাদেশে করতে পারবো।
আনন্দী: আমাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফারুক খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাংবাদিক ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী, চায়না মিডিয়া গ্রুপ