ভিন্ন পেশায় যুবকদের একদিনের চর্চার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গ
2023-05-29 17:30:54

বন্ধুরা, যদি একদিন আপনার অন্যদের জীবনের অভিজ্ঞতা অনুভব করার সুযোগ আসে, তাহলে আপনি কি তাদের মতো জীবন কাটাবেন? সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন পেশার যুবকদের জন্য এমন একটি সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। তারা ভিন্ন পেশায় একদিনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং সে অনুভূতি সবার সাথে শেয়ার করেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা ও চর্চা নিয়ে কথা বলব।

 

লি সিন বেইজিং সিয়েহ্য হাসপাতালের একজন নার্স। একটি গাড়ি-দুর্ঘটনায় তিনি মেরুদন্ডে আঘাত পান। তখন থেকে তিনি আর স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটতে পারেন না। এখন তাকে হুইলচেয়ারে বসে চলাচল করতে হয়। দুর্ঘটনার পর তাঁর মানসিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে। অনেক দিন ধরে মানসিক চিকিত্সা গ্রহণের পর তিনি ধীরে ধীরে বাসা থেকে বের হতে শুরু করেন এবং সাঁতার কাটা, সার্ফিং করা, ও প্যারাসুটিংসহ বিভিন্ন চরম খেলাধুলা শিখতে শুরু করেন। এবার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতার চর্চায় তিনি পানির নিচে মারমেইড হিসেবে কাজ করেন। পানির নিচে মারমেইড এক ধরনের ক্রীড়া, যা মাত্র কয়েক বছর হলো চীনে চালু হয়েছে। এ ক্রীড়ার প্রশিক্ষক চাং মেং ডাইভিং পছন্দ করতেন। এ কারণেই মূলত তিনি মারমেইড ক্রীড়ায় অংশ নেওয়া শুরু করেন। তবে পরে তিনি এ ক্রীড়ার প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি টানা ৫ বছর ধরে মারমেইড প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তবে নার্স লি সিনের জন্য এটি নতুন চ্যালেঞ্জ। চাং মেংও এর আগে কখনও কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধীকে প্রশিক্ষণ দেননি।

 

সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক ক্লাসে শেখার পর, লি সিন মারমেইডের কাপড়চোপড় পরে, ১২ মিটার গভীর সুইমিং পুলের কাছে পৌঁছান। গভীর পুল দেখে তিনি প্রথম খানিকটা ভয় পান। তবে প্রশিক্ষক চাংয়ের সাহায্যে ধীরে ধীরে সাহস ফিরে পান লি সিন। দীর্ঘকাল ধরে হুইলচেয়ারে বসে থাকার কারণে পানির নিচে তাঁর বিভিন্ন ভঙ্গি ঠিক করা একটু কঠিন ব্যাপার। তবে, টানা ৩ ঘন্টা চর্চার পর তিনি পানির নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ রাখা এবং সঠিক সাঁতারের ভঙ্গি শেখেন। অবশেষে তিনি একজন সুন্দর মারমেইডে পরিণত হন।

 

এ সম্পর্কে লি সিন বলেন, “আমি ভাবতে পারিনি যে, শেষপর্যন্ত এসব ভঙ্গি শিখতে পারব। শিখতে পেরে আমার বেশ আনন্দ লাগছে। সুইমিং পুলে নেমে মনে শান্তি পেয়েছি। এ ক্রীড়া যেন আমার জীবনের চাপ খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে। ভয় কেটে যাওয়ার পর আমার আর কোনো সমস্যা হয়নি। আমি সাফল্যের সাথে কাজটি করতে পেরে বেশ আনন্দিত।”

 

অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যের সমুদ্রে উদ্ধারকারীর কাজের অভিজ্ঞতা

ইয়াং তুও তুও বর্তমানে আইন বিভাগের একজন তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তিনি দুই বছর সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার তাঁর একদিনের কাজ হলো সমুদ্রে উদ্ধারকারী কর্মীর। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, চীনা গণমুক্তি ফৌজের সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সেনাবাহিনীর সাথে বন্যা প্রতিরোধক কার্যক্রম ও উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। তবে, সমুদ্রে উদ্ধারকাজ তাঁর জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি সামুদ্রিক উদ্ধারকারী জাহাজে ওঠেন এবং লাইফবোটে বসে সমুদ্রে পৌঁছান। জাহাজের ক্রুদের সাথে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া লোকদের উদ্ধারকাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি।

 

ডাইভিংয়ের মাধ্যমে উদ্ধারকাজ তার জন্য দ্বিতীয় প্রকল্প। ডাইভার ৩০ কেজি ভারি সরঞ্জাম বহন করে বারবার পানির গভীরে ডুব দেন। এভাবে তারা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া লোকদের খুঁজে বের করে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। তবে, সাধারণত জলের ৬ থেকে ৭ মিটার নিচে নামলেই কানে অনেক ব্যথা অনুভূত হয়। এটা একটা সমস্যা।

 

হেলিকপ্টারের উদ্ধারকাজ জাহাজের উদ্ধারকাজের চাইতে দ্রুততর গতির। হেলিকপ্টার গাড়িচালক, বিমানচালক ও উদ্ধারকারীদের পরিবহন করতে পারে। এভাবে সমুদ্র থেকে উদ্ধারকৃত লোকদের পরিবহন করা যায়। এ সম্পর্কে পেইহাই সমুদ্রের উদ্ধারকারী উড়ন্ত দলের প্রধান মা হং রু বলেন, সমুদ্রের উদ্ধার কাজ জঙ্গিবিমান চালানোর মতো বিপদজ্জনক। কুয়াশা, বাতাসসহ বিভিন্ন চরম আবহাওয়া বিমানচালকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, চরম আবহাওয়ায় যদি কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাড়াতাড়ি উদ্ধারকাজে যোগ দিতে হবে। দেরি করলে সমস্যা হবে।

 

নিজের উদ্ধার কাজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে মা বলেন, ২০১৮ সালে টাইফুন ‘মোচিয়ে’ শানতুং প্রদেশ অতিক্রম করে। সেই সময় সমুদ্রে অনেক জাহাজ বিপদে পড়ে। মা হং রু’র উদ্ধারকারী দল হেলিকপ্টার চালিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। সেই সময়  টাইফুনের গতিবেগ ছিল প্রচণ্ড। প্রতিকূল পরিবেশে তারা হেলিকপ্টর চালিয়ে জাহাজের মোট ৪ জন ক্রুকে উদ্ধার করেন। এ সম্পর্কে মা বলেন, “আমাদের দায়িত্ব যারা বিপদে পড়ে, তাদের উদ্ধার করা। তাই, আমাদের মূল কাজ অন্যদের জীবন বাঁচানো। উদ্ধারকারীদের নিজেদের জীবন উত্সর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।”

 

উদ্ধারকারীদের কাজ চর্চা করার পর ইয়াং তুও তুও মনে করেন, উদ্ধারকারীরা কেবল কয়েক মাস ধরে অন্যদের জীবন উদ্ধার করার দক্ষতা শেখেন না, বরং তাদের মানসিক অবস্থার চর্চা করতে হবে; তাদের বিভিন্ন চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। তা ছাড়া, অন্যদের সাহায্য করা এবং বিপদজ্জনক অবস্থায় কিভাবে অন্যদের উদ্ধার করা যায়—তাও তাদের শিখতে হয়। যদি কেউ উদ্ধারকারীর কাজকে সাধারণ চাকরি মনে করে, তাহলে ভুল করবে।

 

ম্যাসাজ ডাক্তার হিসেবে একদিনের অভিজ্ঞতা

ইন্টারনেটের প্রকৌশলী ইয়াং ছেন ইয়াং চাকরির কারণে নিয়মিত বিজনেস ট্রিপ করেন। তাই, তিনি সহজে ক্লান্তি বোধ করেন। তিনি প্রতি মাসে হাসপাতালে ম্যাসাজ গ্রহণ করেন। এবার তাঁর নতুন চাকরি, হাসপাতালের ম্যাসাজ ডাক্তার হিসেবে কাজ করা। তাঁর শিক্ষক যুব ডাক্তার স্যুয়ে পাওশান। ডাক্তার স্যুয়ের পরামর্শে শিক্ষার্থী ইয়াং মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ম্যাসাজের পদ্ধতি শেখেন ও চর্চা করেন। অনুশীলনের সময় শিক্ষার্থী ইয়াং তাঁর শিক্ষকের শরীর ম্যাসাজ করেন। তবে মাত্র কয়েক মিনিট পর তাঁর হাত ব্যথা করতে থাকে। তখন তিনি বলেন, আগে ম্যাসাজ গ্রহণের সময় তিনি কখনও ভাবতেই পারেননি যে, কাজটা এতো কঠিন!

 

যুব ম্যাসাজ শিক্ষক স্যুয়ে বলেন, একজন ম্যাসাজ ডাক্তারকে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জনকে সেবা দেন। একটি ছোট ক্লিনিক রুমে তারা প্রতিদিন ২০ হাজার পদক্ষেপ ফেলেন। অনেক যুবক দীর্ঘকাল ধরে টেবিলে বসে কাজ করার ফলে মেরুদণ্ডের সমস্যায় পড়েন। তাই ক্লিনিকের রোগীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ যুবক, যারা ইন্টারনেট কোম্পানিতে কাজ করেন। তাদের দৈনিক কর্মসময় কমপক্ষে ১০ ঘন্টা। তাই দীর্ঘকাল ধরে তারা ঘাড়ের গুরুতর ব্যথায় আক্রান্ত হন। সহজে ঘাড় ঘোরানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সাধারণত ডাক্তার স্যুয়ে আকুপাংচার ও ম্যাসাজসহ বহুমুখী চিকিত্সাপদ্ধতিতে তাদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেন।

 

ডাক্তার স্যুয়ের দাদা একজন চিকিত্সক ছিলেন। তাই ছোটবেলা থেকে তিনি দাদার কাছ থেকে বিভিন্ন ম্যাসাজের পদ্ধতি শিখে ফেলেন। উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তাঁর কাজিনের সাথে ইট হাতের রাখার চর্চা করতেন। এভাবে হাত ও আঙ্গুলের পেশী শক্তিশালী হয়। ইট হাতে চর্চাশেষে রাতে ঘুমানের সময় দুই হাত অনেক ব্যথা করতো। তবে, অনেক চর্চার পর তাঁর হাত ও আঙ্গুলের শক্তি অনেক বেড়ে যায়।

 

হাসপাতালের ম্যাসাজ ডাক্তারের সাতে ম্যাসাজ পার্লারের ম্যাসাজকর্মীদের পার্থক্য কী? একদিনের অনুশীলনের পর শিক্ষার্থী ইয়াং বলেন, ম্যাসাজ পার্লালের কর্মীদের প্রধান কাজ ভোক্তাদের ক্লান্তি দূর করা। তাদের ম্যাসাজ কেবল পেশীর ব্যথা দূর করতে পারে। তবে, মেরুদণ্ডের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে না। তবে, হাসপাতালের ম্যাসাজ ডাক্তার চিকিত্সার উদ্দেশ্যে রোগীদের অবস্থা বিবেচনা করে ম্যাসাজসেবা দেন, তাদের হাড় সঠিক অবস্থানে সেটিং করেন এবং আকুপাংচারসহ বিভিন্ন চিকিত্সা দেন। তাই হাসপাতালের ম্যাসাজ-চিকিত্সা আরও পেশাদার এবং ম্যাসাজ ডাক্তারদের কাজ কল্পনার চেয়েও বেশি ক্লান্তিকর। তারা রোগীদের শরীরে সঠিকভাবে আকুপয়েন্ট খুঁজে বের করেন এবং ম্যাসাজ করার সময়ও একের রোগীর ক্ষেত্রে একেক মাত্রা ব্যবহার করেন। এটা সহজ কাজ নয়।

 

প্রবীণদের মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শকের কাজ

ছোটবেলা থেকে মৃত্যু সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না মিস থাংয়ের। সম্প্রতি তাঁর বাবা অসুস্থতার কারণে আইসিইউতে ভর্তি হন। তখন একদিন তাঁর মনে হয়, মৃত্যু প্রত্যেকের জীবনের অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

তাই যখন একটি বিশেষ চাকরির সুযোগ আসে, তখন মিস থাং সাহসের সাথে সেটি অনুশীলন করেন। তিনি প্রবীণদের মৃত্যুসম্পর্কিত মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক হিসেবে একদিনের জন্য কাজ করেন।

 

সুংথাং হাসপাতাল ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি চীনের প্রথম হাসপাতাল যেখানে বয়স্ক প্রবীণদের মৃত্যুসম্পর্কিত মানসিক প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। এ পর্যন্ত এখানে ৪০ হাজার জনেরও বেশি চীনা প্রবীণের জন্য বিদায়ী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এখানকার রোগীরা কেউ কেউ বয়স্ক হওয়ার কারণে নিজের যত্ন নিতে পারেন না বা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কেউ কেউ অন্যান্য গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে আর বেঁচে থাকতে পারেন না। তবে জীবনের শেষপ্রান্তে তাদের মূল উদ্দেশ্য মর্যাদাসহ দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া। এ প্রেক্ষাপটে তাদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শকের চাকরি সৃষ্টি করা হয়।

 

হাসপাতালের ওয়ার্ডে হেড নার্স তুং ওয়ে স্বেচ্ছাসেবক মিস থাংয়ের সাথে প্রবীণদের গল্প শেয়ার করেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি এ হাসপাতালে কাজ করছেন। তাই, এখানে বসবাসকারী প্রবীণদের চরিত্র সম্পর্কে তিনি অনেক জানেন। তিনি থাংকে বলেন যে, কেবল প্রবীণদের চরিত্র সম্পর্কে জানলে তাদের মানসিক চাহিদা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। তাই, তাদের নার্সিং কাজ যেন অভিনেত্রীদের মতো। প্রতিদিন তাদের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। এভাবে প্রবীণদের মনে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।

 

স্বেচ্ছাসেবকের কাজ সম্পর্কে মিস থাং বলেন, “নানী চাং আন্তরিকতার সাথে আমার হাত ধরে আমার সাথে কথা বলেন, তাঁর হাত শুকনো, তবে গরম।” একদিনের মধ্যে তিনি অনেক প্রবীণের সাথে পরিচিত হয়েছেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলেছেন ও আড্ডা দিয়েছেন।

 

একদিনের স্বেচ্ছাসেবকের কাজ শেষ করে থাং বলেন, “এখানকার একদিনের কাজ আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। তাদের সাথে থাকায় জীবনের অনেক কষ্ট আমার কাছে আর কষ্টই মনে হয় না। আমার মন আগের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত হয়েছে। কারণ, মৃত্যুর তুলনায় জীবনের অনেক কষ্ট তেমন কষ্টই নয়।”

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)