দেহঘড়ি পর্ব-০২০
2023-05-28 13:05:23

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় টিসিএম

চোখকে বলা হয় আত্মার জানালা। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে চোখকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়; একে শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের জানালা মনে করা হয়। কারণ টিসিএমে মনে করা হয়, চোখ দেহের সকল অভ্যন্তরীণ-প্রত্যঙ্গর সঙ্গে সংযুক্ত। এর প্রতিটি অংশ দেহের মূল জীবনীশক্তি বা ‘ছি’ উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। এসব অঙ্গকে টিসিএমে ‘জ্যাং’ অঙ্গ বলে অভিহিত করা হয়। যেমন আইরিস বা চোখের মনি লিভারের সঙ্গে যুক্ত, চোখের কোণ বা ক্যান্থি যুক্ত হৃদযন্ত্রের সঙ্গে, চোখের উপরের ও নীচের পাতা প্লীহা, কনজাংটিভা বা চোখের কর্নিয়ার আচ্ছাদন ও ফুসফুসের সঙ্গে এবং চোখের তারা কিডনির সঙ্গে যুক্ত।

টিসিএমে মনে করা হয়, ছয়টি বাহ্যিক প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান দৃষ্টিশক্তি কমাতে পারে। প্যাথোজেনগুলো হলো তাপ, শীতলতা, বায়ু, ক্লেদ, শুষ্কতা ও গ্রীষ্মের তাপ। এর মধ্যে তাপের কারণে চোখে কনজেক্টিভাইটিস হয় বা চোখ ওঠে। এর ফলে চোখ ফুলে যায়, প্রদাহ তৈরি হয় এবং লালচে হয়ে যায়। শীতলতার কারণে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয় যেমন ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং গ্লুকোমার মতো রোগ সৃষ্টি হয়। এতে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। বায়ুর কারণে আকস্মিকভাবে দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করতে পারে। অন্যদিকে ক্লেদজনিত কারণে চোখ দিয়ে শ্লেষ্মাজাতীয় পদার্থ নিঃসরণ হতে পারে এব চোখ ফুলে যেতে পারে। শুষ্কতার ফলে চোখে চুলকানি ও লালভাব দেখা দেয় আর গ্রীষ্মের তাপের কারণে প্রদাহ হয় এবং শ্লেষ্মাজাতীয় পদার্থের নিঃসরণ ঘটে।

এই ছয়টি কারণের মধ্যে বাতাস ও আগুন চোখের তাপশক্তি বা ‘ইয়াং’য়ে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। চোখ যখন খোলা হয়, তখন সেটি বায়ু থেকে আসা প্যাথোজেনের কাছে নাজুক হয়ে পড়ে। প্যাথোজেন চোখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। বায়ু থেকে সৃষ্ট চোখের ব্যাধিগুলো দ্রুত তীব্র অবস্থায় মোড় নেয়।

শীতলতা ও ক্লেদের ফলে ঠান্ডাশক্তি বা ‘ইয়িন’য়ে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। টিসিএমে মনে করা হয়, দুর্বল দৃষ্টিশক্তির সবচেয়ে বড় কারণ হলো শীতলতা ও ক্লেদ, যার ফলে চোখের নড়াচড়া কমে যায়। শীতলতাসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে অত্যাবশ্যক উষ্ণতা ও পুষ্টি থেকে চোখ বঞ্চিত হয়। শীতলতা চোখের চারপাশের পেশী, শিরা ও ত্বকে অবস্থান নেয়, যার ফলে দৃষ্টিশক্তির আরও অবনতি ঘটে।

চোখের রোগ ও দৃষ্টিশক্তি কমার টিসিএম চিকিৎসা দেওয়া হয় মূলত বিভিন্ন ভেষজের ভিন্ন ভিন্ন ফর্মুলেশনে। জানিয়ে দিচ্ছি চোখের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রধান ভেষজগুলো সম্পর্কে:

চন্দ্রমল্লিকা ফুল বা চু হুয়া: এ ভেষজ লিভার পরিষ্কার করে। এর ফলে চোখের লালচে ভাব কমে, চোখের টিস্যু ছেড়া হ্রাস পায়, চোখের ফ্লোটার দূর হয় এবং ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার হয়।

সেলোসিয়া বীজ বা ছিং সিয়াং চি: চোখের ব্যথা, লালচে ভাব ও ফোলা কমায় এবং ছানি প্রতিরোধ করে এই ভেষজ।

সিউডিগিনসেং শেকড় বা সান ছি: এটা চোখের ছেড়া রক্তনালী মেরামত করে এবং ‘রক্তের দাগ’ পরিষ্কার করে।

সিকাডা মোল্টিং বা ছান থুই: এই ভেষজ ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার করে এবং লালভাব কমায়। চোখের ব্যাথা এবং ফোলাভাব দূর করার জন্যও এ ভেষজ ব্যবহৃত হয়।

চীনা ওল্ফবেরি ফল বা ছৌ ছি চি: লিভার ও কিডনিতে ‘ছি’য়ের ঘাটতিতে দূর করে এই ভেষজ। এর মধ্য দিয়ে এটা ঝাপসা দৃষ্টি পরিস্কার করে এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস রোধ করে।

প্যাগোডা ফুল বা হুয়াই হুয়া মি: লিভারের তাপের কারণে মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া এবং চোখ লাল হয়ে ওঠার চিকিত্সায় এটি ব্যবহৃত হয়।

বাডলিয়া ফুলের কুঁড়ি বা মি মাংহুয়া: এ ভেষজ আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়ায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী চোখের চিকিত্সার জন্য যেসব রোগী টিসিএম ব্যবহার করেছেন, তারা ওষুধ ও কর্টিকালস্টেরয়েড ড্রপের উপর তাদের নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া চোখের রোগের চিকিৎসার জন্য চাইনিজ হার্বাল থেরাপি নিতে শুরু করেছেন, এমন রোগীরা এটাও আবিষ্কার করেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন একজিমা, হাঁপানি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও কমেছে এ চিকিৎসার কারণে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

তালিয়ান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল

তালিয়ান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; চীনের উত্তরাঞ্চলীয় লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী তালিয়ানে। গত ৮ দশকেরও বেশি সময়ে চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসা-শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে একটি অত্যাধুনিক শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান।

 এক লাখ ৮২ হাজার বর্গমিটার স্থানজুড়ে মোট ৩টি ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল, যার শয্যাসংখ্যা ৩ হাজার ৭শ। এর বহির্বিভাগে প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় আর ভর্তি করা হয় ৯০ হাজারেরও বেশি রোগী, যাদের মধ্যে ৩০ হাজারের সার্জারির প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি অন্যতম শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত চিকিৎসা গবেষণা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেও পরিণত হয়েছে।

হাসপাতালটি ৮টি বিভিন্ন স্তরে ১৮টি একাডেমিক বিষয়ে ক্লিনিকাল শিক্ষাদানে নিযুক্ত রয়েছে। এখানে রয়েছে  ২৩টি শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ, ৩৯টি তৃতীয় স্তরের শাখা, ৮২টি ক্লিনিকাল বিভাগ, ১৩টি পরীক্ষা বিভাগ, ২৫টি প্রশাসনিক বিভাগ এবং ২৫টি শিক্ষাকেন্দ্র। এ হাসপাতালে পরিচালিত হয় সমন্বিত চীনা ও পশ্চিমা মেডিসিন এবং ক্লিনিক্যাল মেডিসিন – এ দুটি প্রথম-স্তরের ডক্টরাল প্রোগ্রাম। প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল লিয়াওনিং প্রদেশে সমন্বিত চীনা ও পশ্চিমা মেডিসিনের মূল পরীক্ষাগার।

জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশন স্বীকৃত ৬টি জাতীয় পর্যায়ের মূল ক্লিনিকাল স্পেশ্যালিটি রয়েছে এ হাসপাতালে। এগুলো হলো নার্সিং, কার্ডিওভাসকুলার, নেফ্রোলজি, আইসিইউ, সমন্বিত চীনা ও পশ্চিমা মেডিসিন এবং অর্থোপেডিক সার্জারি। এছাড়া এ হাসপাতালে ৮টি প্রাদেশিক-পর্যাযের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র, ৭টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এবং ১৫টি পৌরসভা-পর্যায়ের মূল কার্যক্রম রয়েছে। এখানকার সিনো-ইউকে রিজেনারেটিভ মেডিসিন সেন্টার হলো "বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তি", যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় দ্বারা স্বীকৃত। এ হাসপাতালে কর্মীর সংখ্যা ৩ হাজার ৯শ জন, যাদের মধ্যে ৬শ জনেরও বেশি জ্যেষ্ঠ পেশাদার। এখানে কর্মরত বেশ কয়েকজন দেশবরেণ্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, ৪০ জনের মতো বিশেষ সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ এবং একজন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পদকপ্রাপ্ত নার্স।

২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাসপাতালটি ৮০৩টি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সাফল্যের জন্য জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের ১২১টি পুরস্কার অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্লিনিকাল চিকিৎসায় শত শত নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে এখানে। হাসপাতালটির চিকিৎসা-প্রযুক্তি গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ের। অনেকগুলো দেশ ও অঞ্চলের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ হাসপাতালের।

প্রথম অধিভুক্ত হাসপাতাল পরপর তিনবার জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যায় অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়া এটি চীনের ‘শীর্ষ শত হাসপাতাল’ তালিকায়  স্থান পেয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের রোগী-সন্তুষ্টি জরিপে হাসপাতালটি পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে, চীনের চিকিৎসাসেবা খাতে সেরা নিয়োগকর্তাদের তালিকায় দ্বাদশ স্থান অর্জন করেছে এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে দেশের শীর্ষ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে পৌঁছেছে।

 

#ভেষজের গুণ

সাদা পিওনির শিকড়

পিওনি বিখ্যাত এর রঙিন পাপড়ির জন্য। বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা বিয়ের সাজসজ্জার জন্যও জনপ্রিয় এ ফুল। কিন্ত আপনি কি জানেন, এই ফুল গাছের শিকড়ে রয়েছে অসাধারন ঔষধি গুণ এবং স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় রক্ত সঞ্চালন, শক্তি বৃদ্ধি ও মেজাজে ভারসাম্য বজায় রাখার দাওয়াই হিসাবে ব্যবহৃত হয় পিওনি ফুল গাছের মূল, চীনা ভাষায় যাকে বলা হয় বাই শাও।

উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কমাতে এই ভেষজটি বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন পুনঃগ্রহণকে বাধা প্রদানের মাধ্যমে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কমায়। এছাড়া পিওনি শিকড়ের সাপ্লিমেন্টেশনের নিয়মিত ব্যবহার মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়, উত্তেজনা থেকে মুক্তি দেয় এবং আরামের অনুভূতি আনে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।